অনুভূতি গল্পের প্রথম পাঠ
গাড়ী ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে সোজা সানফ্রানসিস্কোর দিকে। আজই হাইকিং শেষ করে নিজেদের গন্তব্যে । ড্রাইভিং সিটে বসে নিবিষ্ট মনে ওরা ফিরে যাচ্ছে ইয়োজেমিটির ইয়েলোস্টোন পার্কের তিনদিনের সামনের দিকে তাকিয়ে আছে আরাফাত। পেশাগত কারণ ছাড়াও হাইকিং এর প্রয়োজনে প্রায় সারা বছর জুড়েই এভাবে লং ড্রাইভে বেরোতে হয় ওকে।
গত দুই বছর ধরে ওর এই ঘুরে বেড়ানোর মজাটা ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। কারণ এখন ওর পাশে আছে ওর মানসীপ্রিয়া খানসা যে ছিল একসময় ওর বৈরীপ্রিয়া। প্রিয়তমা যাযাবরীকে পাবার পর থেকে ওকে নিয়ে যখন তখন মুসাফির হয়ে যেতে আজকাল আর কোনো বাধা থাকে না। বরং বাইরে বেড়ানোর নেশাটা এখন অনেকটা আসক্তিতে রূপ নিয়েছে।
ফলে দুজনেরই জীবনটা বছরের অর্ধেক কাটছে ঘরে তো অর্ধেক কাটছে পথে। তবে এবার ভেবে রেখেছিল এ বছর আর বেরুবেনা। কারণ খানসার বর্তমান শারিরীক অবস্থা। যদিও খানসা এই সীমাবদ্ধতা মানতে রাজী নয়। বাসায় দিয়াও ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু খানসা তাতে পরাস্ত হয়নি।
উল্টো মারইয়াম আঃ এর গল্প শুনিয়ে দিয়ে বলেছে, আমার তো তবু বিশাল লাক্সারী ক্যম্পার ভ্যান আছে। আর সব কাজের কাজী হিসেবে আছে তোমার ভাই। সর্বোপরি, অন্তরের বিশ্বাসে আল্লাহ আছেন আর তাঁর উপর ভরসা আছে। কাজেই আমি যাবোই। দিয়া আর কিছু বলেনি, আরাফাতও আর বাধা দেয়নি। বেরিয়ে পড়েছে দুজনে।
“খানসা এখন তার পাশের সিটেই আধাশোয়া হয়ে বসে আছে। ওর বাম হাতটা রাখা আছে ওর স্ফিত উদরে। সে এখন সাত মাসের গর্ভবতী। ইচ্ছে করেই কোনো ডাক্তারের কাছে যেতে রাজী হয়নি মেয়েটা। আরাফাত প্রথমে বলেছিলো একজন গাইনোকোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে কিন্তু খানসা দেয়নি। সে বরাবরই বড্ড একরোখা। তার এক জেদ। নারী হোক কী পুরুষ। সে তার গায়ে।
কাউকে হাত লাগাতে দেবে না। ওর একরোখামীর মেনে নিয়ে বাড়ীতেই নিয়ম মেনে পরিচর্যা চলছিলো। মারিয়াম আর দিয়ার সাজেশন তো ছিলোই। আরাফাত নিজেও ওকে ধরে ধরে নিয়মিত ব্যায়াম করিয়েছে। ম্যাসাজ করে দিয়েছে ওর সারা শরীরে। বিশেষ করে ওর হোওল এবডনমেন্ট এরিয়া জুড়ে।
আরাফাতের অয়েল ম্যাসাজটা ওর কষ্ট অনেকখানিই কমিয়ে দেয়। বেশ আরাম পায় বলে প্রতিদিনই একবার করে আরাফাত ওর পেটে অয়েল মেসেজ করে দেয়। তাতে স্কিনের ময়েশ্চার ঠিক থাকে বলে স্কিন ফাটার সম্ভাবনাও আশিভাগ কমে যায়। এটি যদিও একটি প্রাচীন দেশী পদ্ধতি তবু এতে বেবীর পজিশন ঠিক থাকে বলে অনেকেই এটা করে থাকে।
তবে অবশ্যই তাকে এক্সপেরিয়েন্সড হতে হবে। এ ব্যপারে আরাফাতের যাবতীয় লেসন ওর বায়োলজীর ক্লাসেই হয়ে গিয়েছিল। এক্সপেরিয়েন্স বলতে একমাত্র খানসা। এছাড়াও খানসার প্রেগনেন্ট হবার পর থেকে ওর যাবতীয় দেখাশোনা আরাফাত নিজ হাতে করছে। প্রথম দিকে খানসার ফুটানো ভাতের গন্ধটা পর্যন্ত সহ্য হতো না।
ফলে মারিয়াম বাড়ীতে না থাকলে রান্না পুরোটাই আরাফাত করতো। এমনকী মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া পর্যন্ত। ওকে নিজে থেকে কিছুই করতে হয়নি। প্রতিরাতে নিয়মিত হাঁটা আর ব্যয়াম সবই আরাফাতের তত্ত্ববধানে চলছে। খানসা নিজেও জানে আরাফাত ওর সামান্যতম উফ শুনলেও পাগল হয়ে যায়। খানসার শরীরে সামান্য ফুলের আঘাতও সে সহ্য করতে পারেনা। ওর সামান্য কাতরতা দেখলেও অস্থির হয়ে ওঠে লোকটা।
প্রেগনেন্সীর প্রথম দিকে তো বারবার বমি করতো বলে বাথরুমের দরোজা লাগাতে দিতো না। একদিন খানসা রাগারাগি করায় সেটা কমেছিল। তার পরের দিনই খানসা বাথরুমে ঢুকে বিকট শব্দে বমি করে মাগো বাবাগো করলে বাইরে থেকে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল আরাফাত। বারবার দরজা ধাক্কাচ্ছিল আর বলছিল, “দরজাটা খোলো খানসা। আই’ল কাম ইন।
খোলো বলছি। জাস্ট ওপেন দা ডোর ড্যাম ইট বলে প্রবল এক ঘুষি বসিয়ে হার্ড প্লাস্টিকের দরজাটাই ফাটিয়ে ফেলেছিল গোঁয়ারটা। পরে খানসা বেরিয়েই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে দুদ্দাড় কিল বসিয়ে বলেছিল,আসছে দরদ দেখাইতে।” আরাফাত ততক্ষণে তার বৈরীপ্রিয়াকে সুস্থ আমাকে অসুস্থ বানিয়ে এখন দেখে শান্ত হয়ে গিয়েছে।
খানসার সব ব্যপারেই ওর একটু বেশী। অস্থিরতা। এ নিয়ে কমিউনিটিতেও বেশ মুখোরোচক গল্প প্রচলিত। আছে। ওরা কেউ নাকী বুঝতেই পারেনি আরাফাতের মতো পৌঁহমান। এমন দ্বৈগ প্রকৃতির বেরোবে। অন্তত খানসার ব্যপারে ওর সমন বেপরোয়া মনোভাব সত্যিই চিন্তার বিষয়। আরাফাত তাদের ধারণা বদলাতে রাজী নয়। স্লৈগ হলে দ্বৈণই সই।
গাড়ী চালানোর ফাঁকে ফাঁকে আরাফাত খানসার দিকে তাকাচ্ছিল। টুকটাক কথা বলে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছিল। পক্ষান্তরে খানসার চেষ্টা চলছিল তার উদগত ব্যথাটা আরাফাতকে বুঝতে দেয়া। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে সে অনেকক্ষণ ধরেই দাঁত কপাটি মেরে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কারণ আরাফাতকে জানালে অযথা কষ্ট পাবে।
‘পেইন হচ্ছে খানসা…?’ আরাফাত আলগো করে নিজের বাম হাতটা ওর গালে ছুঁয়ে জানতে চাইল। প্রশ্নটা খানসার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর করল। ওর ঊর্ধ্বাংশের ওঠানামা দেখে আরাফাত কী বুঝলো কে জানে দ্রুত পথের ধারের বিশাল ওক গাছের নিচে গাড়ীটা পার্ক করল। খানসার দিকে ফিরে বসে ওর কপালে হাত দিতেই দেখল সে ঘামছে।
হিটারটা কমিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে বলল, ‘ব্যথা কী খুব বেশী ??
‘হমমম…!’ মাথাটা ওপর নিচ করতেই ছিটকে কান্নাটা বেরিয়ে এল
ওর, ‘পেইনটা নিতে পারছিনা আরাফ। আমার দম বের হয়ে যাচ্ছে।
ওহ্ মা…!’
আরাফাত যা বোঝার বুঝে ফেলল। দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে খানসার পাশের দরোজা খুলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে পা দিয়ে দরজাটা আটকে দিল। কোনোমতে পেছনের দরজাটা টেনে খুলে খানসাকে নিয়ে শুইয়ে দিল বেডটায়। খানসার আরামের কথা ভেবে একটু একটু করে লাক্সারী করে তুলেছে গাড়ীর ভেতরটা। প্রয়োজনীয় সবরকম সুবিধাই রেখেছে আরাফাত। চট করে গাড়ীর দরোজা বন্ধ করে ওয়াটার টাবটা বের করে ফ্লোরে রাখল। খানসাকে পরীক্ষা কর দেখল।
যদিও বিশ্বাস হতে চাইছিল না যে সাতমাসেই খানসার এরকমটা হবে। কিন্তু তেমনটাই বোধহয় হতে চলেছে। কিছুটা বোধ করছে আরাফাত। যদিও মন বলছে, সবই ঠিক আছে তা অবচেতন মনের ভয় পিছু ছাড়ছে না। তার টুই পাখিটার কিছু হলে দেয় মরে যাবে । নানান উল্টাপাল্টা ভাবনা এসে ভারাকান্ত করে দিতে চাইছে মনটাকে।