অপহরণ এর ১০ম পার্ট।
ঘরের ভিতর গভীর অন্ধকার জমে আছে।
সুইচ বোর্ডটা দরজার পাশে কেয়া জানে। দুপুরের মুখ থেকে এই রুমের ভেতর। যদিও প্রচন্ড এক মানসিক চাপ এবং ভয়াবহ এক উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে,
দুশ্চিন্তায় ঢলঢল মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, বিন্দুমাত্র খিদে অনুভব করেনি, বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি, আনমনে একদিকে তাকিয়ে থেকেছে তো থেকেছেই,
তবু ঘরের ভেতরকার প্রতিটি জিনিস কোন ফাঁকে কেমন করে যেন দেখা হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেও অনেক কিছু দেখে ফেলে মানুষ। সেই দেখাটা লুকিয়ে থাকে চোখের অনেক গভীরে ।
ইচ্ছে করলে উঠে লাইট জ্বালাতে পারে কেয়া। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছিলো না তার। কেয়ার এখনকার যা অবস্থা তাতে আলো কিংবা অন্ধকার দুটোই সমান মূল্যহীন।
আলো থাকলেই তার কী উপকার হবে কিংবা অন্ধকার থাকলে কি ক্ষতি হবে। ঘরের একপাশের দেয়ালের সঙ্গে সিঙ্গেল খাট সাইজের একটা ফোম ফেলা।
ফোমের ওপর অল্প দামী প্রিন্টের একটা চাদর। মাথার কাছে তুলতুলে দুটো বালিশ। তবে চাদর কিংবা বালিশের ওয়্যার খুব একটা ময়লা নয় ।
বোধহয় ধোয়ার পর আর কেউ ব্যবহার করেনি। করলে মানুষের গায়ের গন্ধ লেগে থাকতো এবং নাক খুব সূক্ষ্ম এমন যে কেউ বিছানায় বসলেই সেই গন্ধ টের পেতো।
কেয়ার নাক খুবই সুক্ষ্ম। ময়লা নোংরা বিছানা কেয়ার অসহ্য। সামান্য সুচিবায়ুর মতো আছে তার। সুন্দর বাথরুম না হলে ব্যবহার করতে পারে না সে।
সুন্দর বিছানা না হলে শুতে পারে না। মানুষের গায়ের বদগন্ধ সইতে পারে না । এমন কী নিজের গায়েরটিও। সে কারণে ঘন ঘন শরীরের আনাচে কানাচে স্প্রে করার স্বভাব তার । ব্যাগে দু-তিনটে সুগন্ধি স্প্রে থাকেই। এখনও আছে।
কিন্তু বেশ অনেকগুলো ঘণ্টা সেই স্প্রে ব্যবহার করা হয়নি কেয়ার। গায়ের আনাচে কানাচে ঘেমো গন্ধ জমে উঠছে কিনা জানেও না সে।
দেয়ালে হেলান দিয়ে ফোমের ওপর বসে আছে কেয়া। বসে বাড়ির কথা ভাবছে। এতক্ষণে স্বামী নিশ্চয় বাড়ি ফিরেছেন।
মেয়েরা যে দুপুর থেকে কেয়ার অপেক্ষায় আছে, দেড়টার সময় ফিরে মেয়েদের সঙ্গে খাওয়ার কথা, তারপর কতটা সময় কেটে গেছে, কেয়া ফেরেনি, ফোন করেনি, মেয়েদের কাছ থেকে হায়াত সাহেব নিশ্চয় তা জেনে গেছেন।
মেয়েরাও নিশ্চয় কেয়ার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে, কেয়া যেখানে যেখানে যেতে পারে প্রতিটি জায়গায় ফোন করেছে। হায়াত সাহেবও করেছেন। বেশ অনেকটা রাত হল।
এতক্ষণে নিশ্চয় চিন্তিত হয়েছে সবাই। হয়তো কেয়াকে খুঁজতে বেরিয়েছে। থানা পুলিশ হাসপাতাল প্রতিটি জায়গায় হয়তো ছুটোছুটি করছে। খবর নিচ্ছে।
কেয়ার চিন্তায় কেমন হয়েছে প্রিয় তিনজন মানুষের মুখ! এই মুহূর্তে সেই তিনজন মানুষের মুখ যদি দেখতে পেতো কেয়া।
তারপর, অনেককাল পর আরেকজন মানুষের কথা মনে পড়ল কেয়ার। সতের বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের বছর দেড়েক পর সংসারে এসেছিল সেই মানুষ।
চাঁদের একখানা টুকরো যেন। কেয়ার জগৎ সংসার উজ্জ্বল করে দিয়েছিলো সেই শিশু। তাকে মাটিতে রাখেনি, পিঁপড়েয় খাবে। মাথায় রাখেনি, উকুনে খাবে ।
কেয়া তাকে রেখেছিল বুকে। বুকের গভীরে।
কেয়ার বুক খালি করে সেই ছেলে পালিয়ে গেল সাত মাসের মাথায়। তাকে হারিয়ে কেয়ার জগৎ সংসার ডুবে গিয়েছিল গভীর, গভীরতর অন্ধকারে ।
সেই অন্ধকারে বহুদিন চোখ চলেনি কেয়ার। চারপাশের পৃথিবীর কোনও কিছু দেখতে পায়নি সে। তারপর রূপা হল, দিপা হল, দিন আস্তে ধীরে বদলে গেল।
কেয়ার। কিন্তু সেই ছেলে, সেই সাত মাসের ছেলেটি এখনও গভীর গোপন কোনও মুহূর্তে মা মা বলে কেয়ার মনের অনেক ভেতর থেকে ডেকে ওঠে একাকী নির্জন কোনও রাতে ঘুম ভেঙে হঠাৎ বুকের কাছে সেই ছেলের মুখের স্পর্শ পায় কেয়া।
চোখ খুলে, চোখ বুজে তার চাঁদের মতো মুখখানা দেখতে পায়। বেঁচে থাকলে আজকের এই যুবকদের মতোই হতো তার বয়স।
কেমন দেখতে হতো সে!
রিভলবার হাতের যে যুবকটি কেয়াকে এভাবে তুলে আনলো, কখনও নরম, কখনও রুক্ষ্ম রূঢ় ভাষার কেয়ার সঙ্গে কথা বলল, ডাকাতের মতো নির্মম ভঙ্গিতে ছিনিয়ে নিল কেয়ার ব্যাগের যাবতীয় টাকা,
গায়ের যাবতীয় গহনা, বেশ লম্বা, বেশ সুন্দর, আপাতদৃষ্টিতে রুক্ষ্ম মুখখানার তলায় লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক মায়া, মা ছাড়া যে রূপ অন্য কারও চোখে পড়ে না, বেঁচে থাকলে ছেলেটি কী কেয়ার এমন হতো।
আজ এই যে কেয়া নিখোঁজ হয়ে গেছে, স্বামী কন্যাদের উৎকণ্ঠার চেয়ে ছেলের উৎকণ্ঠা কী বেশি হতো। মায়ের জন্যে ছেলের যে অপরিসীম দরদ, সেই দরদে ছেলেটি কী ভেঙে চুরে খান খান হয়ে যেত!
পাগলের মতো এদিকে যেত ওদিকে যেত, মাকে খুঁজত। তারপর রাত দুপুরে, নির্জন একাকী কোনও রাস্তায়, মাকে খুঁজে ফেরার পথে, পথপাশে, আকাশের তলায় নির্জনে পড়ে থাকা বিশাল কোনও মাঠের কোণে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে মা মাগো করে কাঁদতো!
কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে কেয়া দেখতে পেলো, নির্জন একাকী কালো পথের পাশে, অতিকায় আকাশের তলায় পড়ে আছে সবুজ ঘাসের বিশাল একখানা মাঠ।
মাঠের ঠিক মাথার ওপর ফুলের মতো ফুটে আছে চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। কোথাও কোনও শব্দ নেই, হাওয়ায় চলাচল নেই।
ছবির মতো স্থির হয়ে আছে সব। মাঠের সবুজ ঘাস ভেঙে একাকী হেঁটে যাচ্ছে মাতৃহারা অসহায় এক যুবক।
সেই যুবকের দিকে তাকিয়ে কেয়া ফিস ফিস করে বলল, সন্তান, আমার সন্তান। তারপর হু হু করে কাঁদতে লাগল কেয়া। চোখের জলে চোখ ভেসে যায়। কেয়ার। বুক ভেসে যায়। কেউ তো দেখে না।
পরের পার্ট টি পরতে হলে আমাদের ওয়েবসাইট এ নজর রাখতে পারেন।