এতীম অনাথ মুহাম্মদ (স)
فأما اليتيم فلا تقهر وأما السائل فلاتنهر (الضحی ۱۰-۹)
(ফায়াম্মাল ইয়াতীমা ফালা-তাকুহার ওয়াম্মাস সা-য়িলা ফালা-তানহার ) অর্থ ঃ অতএব, আপনি এতীমের প্রতি কঠোর হবেন না। এবং সায়েলকে ধমক দেবেন না।” (সূরা আদ দোহা : ৯-১০)
মাতা ও দাদার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেন (৫৭৭-৫৭৮ / ৭-৮ বছর বয়স)
আরবের রীতি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (স) মায়ের স্নেহের বাঁধন খুলে চলে যেতে হয়েছিল দুধ মাতা হালিমার ঘরে। দীর্ঘ দু’বছর তার বুকের দুধ পান করেন।
বড় হলেন দুধমা হালিমার আদর সোহাগ এবং দুধভাই আবদুল্লাহ ও বোন শায়মার স্নেহে লালিত পালিত হয়ে যথার্থ শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর ছয় বছর পা দিতেই মা আমিনার ক্রোড়ে এসে নব জীবন লাভ করতে ছিলেন।
একদিন মা আমিনা তাকে নিয়ে মদিনায় বেড়াতে যেতে মনস্ত করেন। আমিনার বংশের অনেকেই আত্মীয়তা সূত্রে মনিদার সাথে জড়িত । আবার স্বামী আবদুল্লাহও সেখানে সমাহিত হয়ে আছেন।
তাই আত্মীয়দের সাথে দেখা শুনা করার সাথে সাথে স্বামীর কবর যিয়ারত করার আকুলতা বুকে নিয়ে বিবি আমিনা পুত্র মুহাম্মদ (স) কে নিয়ে মদিনা যান।
সেখানে গিয়ে মাতুল গোষ্ঠীর বনি নাজারে বেশ কিছুদিন অবস্থান করার পর বালক মুহাম্মদ (স) ও দাসী উম্মে আইমানকে নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা দিলেন। কিন্তু রাব্বুল ইজ্জত আল্লাহর ইচ্ছা কি মানুষ বুঝতে পারে? পারে না।
আর পারে না বলেই মক্কা ও মদিনার মধ্যপথ আবওয়া নামক স্থানে হঠাৎ বিবি আমিনা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আকস্মিক ভাবে সেখানেই ইন্তিকাল করেন (৫৭৬):)
জন্মের কয়েক মাস আগেই স্নেহময়ী পিতা দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। জন্মের ছয় বছর পর স্নেহময়ী জননীও হারিয়ে গেল চিরতরে।
মায়ের আদর সোহাগ যখন তিল তিল করে ভোগ করার সময়, তখনই মাতা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। এতীম মুহাম্মদ (স) সুদূর বিদেশে মাকে কবর দিয়ে দাসী উম্মে আয়মানের সাথে দেশে ফিরলেন।
এদিকে আবদুল মুহূলিব ছেলের বউ এর মৃত্যু সংবাদ শুনে একেবারে ভেঙে পড়লেন। ছেলে আবদুল্লাহ মারা যাবার পর প্রচন্ড আঘাতে পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলেন।
সে শোকের পাথর ভাঙতে শুরু করছিল মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম লাভ করার পর। হঠাৎ ছেলের বউ ইণ্ডিকাল সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল।
মায়ের মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর অবুঝ নাতির লালন পালনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। মমতা ও অকৃতিম ভালবাসার সঙ্গে তার দেখাশুনা করতে লাগলেন।
এভাবে মুহাম্মদ (স) এর বাল্য জীবন দাদার আদর সোহাগ ও স্নেহ এবং চাচা ও অন্যান্য মানুষের ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে বেড়ে উঠতে লাগল।
নাতির প্রতি আবদুল মুত্তালিবের স্নেহ কত গভীর ছিল আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি একটি ঘটনা থেকে। পবিত্র কাবার তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মুত্তালিবকে মক্কার লোকেরা এত বেশি সম্মান করতো যে, কাবা ঘরে কার্পেট বিছানো অবস্থায় তিনিই প্রধান আসনগ্রহণকারী হতেন।
একদিনের ঘটনা
, একদিন উপস্থিত জনতা তাদের প্রিয় নেতা আবদুল মুত্তালিবের অপেক্ষায় বসে আছেন, এমন সময় বালক মুহাম্মদ (স) কোথা হতে হঠাৎ এসে বিছানো কাপের্টের ঠিক মাঝখানে দাদার বিছানার উপর বসে পড়লেন।
এ ঘটনার ফলে জনগণ বিক্ষপ্ত হয়ে পড়লে উপস্থিত চাচাদের একজন তাকে কোলে করে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিলেন। ঠিক এ সময় আবদুল মুত্তালিব এসে উপস্থিত হলেন।
তিনি ব্যাপারটি দেখে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “আমার নাতি যেখানে বসেছিল তাকে ঠিক সে জায়গাতেই বসিয়ে দেয়া হোক; তিনি আরো বললেন, সে-ই তো আমার বৃদ্ধকালের আনন্দ। তার এ বিশাল স্পর্ধা জেগে উঠেছে তাঁর নিয়তির পূর্ব লক্ষণ থেকে। কারণ সে নিশ্চয়ই একদিন
উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী হবে, যে পদমর্যাদা কোন আরবের কপালে এ যাবত জোটেনি।” এ কথা বলে ডাকে নিজের কোলে নিয়ে নিজের পাশে বসালেন এবং পরম স্নেহে তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে সোহাগ করতে লাগলেন। সোহাগের অতিশয্যে বালক মুহাম্মদ (স) বাক্য হারা হয়ে পড়লেন।
কিন্তু এ স্নেহ সোহাগ, এ অনাবিল শাস্তি বালক মুহাম্মদের বেশি দিন স্থায়ী হল না। যখন তাঁর বয়স ৮ বছর ২মাস ১০ দিন (৫৭৮খৃ:) তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবও এ অস্থায়ী আবাস ছেড়ে চলে গেলেন। দুনিয়ার বুকে তখন মুহাম্মদ (স)
একেবারে নিঃস্ব, একেবারে একা হয়ে গেলেন। বালক মুহাম্মদ (স) এক এক করে বাবা, মা, দাদা সব হারালেন। চাচা আবুতালেব ছাড়া তার পাশে দাঁড়াবার জন্য আর কেউ রইল না। দাদা আবদুল মুত্তালিব নাতিকে তুলে দিয়ে গেলেন আবু তালেবের হাতে। তখন তিনি পিতার অন্তিম আদেশ মাথা পেতে নিলেন।
বস্তুতঃ এই এতীম অসহায় অবস্থার কথা এবং পার্থিব উপলক্ষ্য হতে বঞ্চিত হয়ে আল্লাহর রহমতের ক্রোড়ে প্রতিপালিত
হওয়ার কথা এবং বিশ্বজগতের হেদায়াতকারী হওয়ার কথাটি আল্লাহতায়ালা অলৌকিক ভাবে বর্ণনা করেন
يجدك يتيما ناوي ، ووجدت ها مهدي ، ووجدك عائلة ماعنى (الضحى : ٦-٨) – (আলাম ইয়াজিদকা ইয়াতীমান ফাআ ওয়া ওয়াওয়াজাদাকা খোয়াল্লান ফাহাদা-অওয়াজাদাকা ‘আ-য়িলান ফাআগনা )
الم
অর্থঃ হে নবী! আল্লাহতা’আলা কি আপনাকে এতীম অবস্থায় পান নি। অতঃপর আপনাকে (স্বীয় রহমতের ক্রোড়ে) আশ্রয় প্রদান করেছেন, আর আপনাকে কি পথ হারা পননি। অতঃপর (বিশ্বজগতের হেদায়াতের জন্য) হেদায়াত প্রাপ্ত করেছেন।
আর আপনাকে কি তিনি সহায় সম্বল হীন (পরমুখাপেক্ষী) অবস্থায় পাননি। অতঃপর তিনি (নেতৃত্ব প্রদান করত:) অভাবমুক্ত করেছেন।” (সূরা আদ দোহা : ৬-৮)
বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী (স) পৈত্রিক সূত্রে উত্তরাধিকারী হিসাবে শুধু মাত্র একটি উটনী ও একটা দাসী লাভ করেছিলেন। দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের সূচনা হয়।
তার পর হযরত খাদিজার ব্যবসায় শরীক হয়ে অতঃপর তার সাথে। বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সফলতা লাভ করেন। আর এক স্থানে আল্লাহ বলেন
وإن كنت من قبله لمن الفيلين (يوسف : ۳) অর্থ ঃ আর যদিও আপনি ইতি পূর্বে এসব বিষয় গাফিল বা অনবহিত ছিলেন।” (সূরা ইউসুফ : ৩)
মোটকথা, বাল্যকালেই মহান রব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিপালনের সমস্ত উপলক্ষ্য ও পার্থিব যাবতীয় উপকরণ হতে বঞ্চিত করে নিজের জন্য মনোনীত করে কিভাবে পূর্ণ প্রতিপালনের প্রকাশ ক্ষেত্র করেছেন তার চিত্র ও হাকিকত কে অতুলণীয় ভঙ্গীতে তুলে ধরেন । আল্লাহ বলেন –
الم نشرح لك صدرك ووضعنا عنك وزرك الذي انقض ظهرك (الم نشرح : ۱-۳)
(আলাম নাশরাহ লাকা ছদরাকা ওয়াওয়াদ্বোয়া’না ‘আনকা ওয়িযরিকাল্লাযী আনকাদ্ধ জহরাকা) অর্থ : হে নবী! আমি কি আপনার বক্ষদেশ আপনার জন্য উন্মুক্ত করে দেইনি? আমি আপনার উপর থেকে ভারী বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যা আপনার কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিল। (সূরা আলাম নাশরাহ : ১-৩)
— অর্থ উন্মুক্ত ও প্রশস্তকরা। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা প্রিয় হাবিবের বক্ষকে জ্ঞান, তত্ত্বকথা ও উন্নত চরিত্রের জন্য مرح এমন বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন যে, বিশ্ব বিখ্যাত কোন পণ্ডিত ও দার্শনিক তার গরিমার কাছে পৌঁছতে পারেনি।
এরকম আরো নতুন নতুন ঘটনা পরতে চাইলে আমাদের ওয়েবসাইট এ নজর রাখতে পারেন।
ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।