কবরে আগুন ও আযাবের একটি ঘটনা।
কয়েক বছর আগের কথা। আমি একটি জামাতের সাথে মানসেরা গিয়েছিলাম। গ্রামের একটি মসজিদে তবলীগের বয়ান হচ্ছিল।
মসজিদের কাছেই কিছু লোক বসে গল্প করছিল। আমরা লোকগুলোকে মসজিদের বয়ান শোনার জন্য দাওয়াত দিলাম। আমাদের কথা রক্ষা করে সবাই এলো। কিন্তু একটি লোক সেখানেই ঠায় বসে রইল, মসজিদে এল না।
বয়ান শেষ হওয়ার পর সে লোকটি আমাদের নিকটে এসে বলল, আমি আপনাদের কথা রক্ষা করতে পারিনি বলে লজ্জিত। আমি মাজুর মানুষ।
জনসমক্ষে গেলে মানুষের কষ্ট হয়। তবে আপনারা আমার নিকট থেকে কবরের আযাব সম্পর্কিত একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতে পারেন। হয়ত বা এর দ্বারা অনেক সংশয়বাদী লোকের সন্দিহান মনের বদ্ধ দুয়ার খুলে যেতে পারে।
১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়কার কথা। সীমান্তের কাছাকাছি একটি পুরাতন কবরস্থানের মধ্যে কিছু অস্ত্র মজুদ করা হয়েছিল ।
অন্য কয়েকজন সিপাইর সাথে আমি এ অস্থায়ী অস্ত্র ডিপোর পাহারায় নিয়োজিত ছিলাম। একদিন দিনের বেলায় কোন কাজকর্ম ছিল না।
সঙ্গীরা ছোট্ট একটি তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমি রাইফেল কাঁধে নিয়ে কবরস্থানের মধ্যেই ঘুরাফিরা করছিলাম। হঠাৎ একটি পুরাতন কবরের ভিতরে থেকে ভীতিজনক শব্দ কানে আসতে লাগল।
মনে হচ্ছিল যেন মটমট করে হাড় চূর্ণ করা হচ্ছে আমার মনে দারুণ কৌতুহল সৃষ্টি হল। যে কবরটির ভিতর থেকে শব্দ শুনা যাচ্ছিল, রাইফেলের কিরিচ দ্বারা সেটির ইট-পাথর সরাতে লাগলাম।
মাটি যতই সরাচ্ছিলাম, শব্দ ততই পরিষ্কারভাবে কানে আসতে লাগল । দারুন ভয় ও কৌতুহল নিয়ে কবরের মাটি সরিয়ে দেখতে পেলাম, মানুষের একটি কংকাল পড়ে আছে। এর উপরে ইঁদুরের আকৃতি বিশিষ্ট একটি জীব বসে রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর পর জন্তুটি কাফনের উপর ঠুকর মারছে আর গোটা কংকালটি মটমট শব্দ করে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমার মনে দুঃখ হল। ভাবলাম বন্য জন্তুটি ঠুকরে কবরের লাশকে কষ্ট দিচ্ছে এটিকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ।
রাইফেলের আগা দিয়ে ওটিকে মারতে উদ্যত হলাম । হঠাৎ জন্তুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি কবরের মাটি খানিকটা ঠিক করে সেখান থেকে ফিরে চললাম। হঠাৎ দেখি, কবরের সেই জন্তুটা আমার দিকে তেড়ে আসছে।
আমার হাতে রাইফেল ছিল। সহজেই যে কোন হিংস্র জন্তু মারতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল যে, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটতে লাগলাম।
বেশ কিছুদুর গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম, জন্তুটি আমার দিকে ছুটে আসছে। সামনেই একটা জলা ছিল। আত্মরক্ষার জন্য আমি জলার পানিতে নেমে পড়লাম। ফিরে দেখলাম, জন্তুটি পানির কিনারায় এসে থেমে গেছে।
আমি হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে সেটির গতিবিধি লক্ষ্য করলাম। জন্তুটি তখন পানির মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে ক্রুদ্ধ শ্বাস ছাড়ছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সমগ্র জলার পানি ফুটতে শুরু করেছে। অনুভব করলাম হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডোবা আমার শরীরের সমস্ত অংশ যেন পুরে যাচ্ছে।
ততক্ষণে জন্তুটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি অতিকষ্টে কিনারে উঠলাম। পা যেন চলছিল না। সহকর্মীদের ডাক দিলাম । তারা আমার দুপায়ের ভয়ংকর অবস্থা দেখে আমাকে এবোটাবাদ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
পায়ের জ্বালা কমলো না। উপরন্ত ধীরে ধীরে মাংসে পচন ধরল। এবোটাবাদ থেকে আমাকে রাওয়ালপিন্ডি প্রধান সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলো।
কিন্তু পায়ের জ্বালা এবং পচন থামানো গেল না। শেষ পর্যন্ত আমাকে আমেরিকা পাঠানো হলো। সুদূর আমেরিকা থেকেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি।
ধীরে ধীরে পায়ের মাংস পঁচে গলে খসে গেছে। এখন শুধু হাড়গুলি অবশিষ্ট আছে। পচা মাংসে এমন দুর্গন্ধ হয়েছিল যা সহ্য করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নিজের সুদীর্ঘ দুর্ভোগের কাহিনী বলতে বলতে লোকটি পায়ের পট্টি সরিয়ে নাঙ্গা হাড় দেখালো। কবর আযাবের সামান্য একটু পরশের সে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া কয়েকদিন পর্যন্ত আমাদের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
কবরে আগুন :
১৯৫৩ সনের ঘটনা। আমি তখন নিশতার মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। এনাটমী পড়ার জন্য মানুষের হাড়-কঙ্কালের প্রয়োজন হতো।নতুন কলেজ, তাই প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামের যথেষ্ট অভাব ছিল। অগত্যা আমাদের কোন কোন সঙ্গী কলেজের পার্শ্বে অবস্থিত গোরস্থানেরএক খাদেমের স্মরণাপন্ন হলেন। খাদেমও কিছু অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় হাড়-কঙ্কাল সরবরাহ করতে সম্মত হল ।
বিশেষ গোপনীয়তা রক্ষা করে ছাত্ররা কয়েকবারই নরকংকাল সংগ্রহ করার পর একদিন আমরা কয়েকজন খাদেম সাহেবের নিকট গেলাম।
কিন্তু এবার কিছুতেই তিনি রাজি হলেন না। আমরা তাঁকে মসজিদের ভিতর বসে তেলাওয়াতরত অবস্থায় পেয়েছিলাম। বার বার তিনি হাতজোড় করে মাফ চাইতে লাগলেন।
আমরা তাঁর চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ভাব লক্ষ্য করলাম। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি বললেন, আজ থেকে তিনদিন আগের কথা। রাতের অন্ধকারে আমি কংকালের সন্ধানে বেশ পুরাতন একটি কবর খুলেছিলাম।
লক্ষ্য করলাম, কবরের ভিতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমার হতভম্ব ভাব কেটে উঠার আগেই আগুনের একটি গোলক আমার দিকে ছুটে আসতে দেখলাম।
প্রাণ ভয়ে মসজিদ পর্যন্ত আসার পর রেহাই পাওয়া গেল। দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করে আমার মনে এমন ভীতি সৃষ্টি হয়েছে যে, এরপর আর কোন কবর খোলার সাহস আমার হয় নাই।
ঘটনাটি সম্পুর্ন পরার জন্য ধন্যবাদ।
আরো এরম ঘটনা পেতে আমাদের ওয়েবসাইট এ নজর রাখুন।
আসসালামু আলাইকুম।