কবর দেশের খবর নিয়ে

কবর দেশের খবর নিয়ে

কবর দেশের খবর নিয়ে

চুম্বক যেমন চুম্বককে আকর্ষণ করে মাটিও তেমন মাটিকে টানে। সে টান দৌহিক নয় আত্মিক টান। রূহানি টান। প্রেমের টান। ভয়ের টান। আল্লাহর মাহবুবরা অপেক্ষা করেন পরপারের টান কখন আসবে। আশেকরা প্রতীক্ষায় থাকে মাশুক কখন প্রেমকণ্ঠে ডাক দেবে।

অবাধ্যরা পালাতে চায় মাটির ডাক থেকে। থাকে বেখেয়াল, বেখবর। মাটির ঘরের সামান তৈরিতে করতে থাকে গড়িমসি ।

কিন্তু মাটি। কবরের মাটি। গড়িমসি করে না। সে ডাকছে। ডাকে। বিরতিহীন। প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। প্রতি মুহূর্ত।

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, প্রতিদিন কবর তোমাকে বলে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি আমাকে ভুলে গেছ। আমি সঙ্গীহীন একাকী ঘর। আমি পোকামাকড়ে পূর্ণ এক বিষাক্ত ঘর। (বুখারি)

মাটির এ ডাক প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই কোনো মানুষের। নেই কোনো ধনী বা প্রভাবশালীর। রাজা বা সম্রাটের। আমির বা ফকিরের। সবাইকেই মাটি ডেকে নেবে। মাটির ঘরের বাসিন্দা আমরা মাটিতেই আমাদের সমাধি 1 হবে। সেদিন আমাদের সব আশা ফুরাবে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৫৭)।

আপনি কি জানেন আমরা অনন্তর এক জীবনের দিকে তিলে তিলে এগোচ্ছি, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে আমাদের। দুনিয়ার জীবনে আমাদের স্থায়িত্ব বলতে কিছুই নেই জানার পরও এখানে নিজের, সন্তান সন্ততি, পরিবার-পরিজনের আরামদায়ক জীবনের জন্য কত কিছু না করছি। কোনো মানব শিশুর দুনিয়ার জীবন শুরু করার আগে কত আয়োজন, কত প্রস্তুতি! কোন পোশাকটা তাকে পরানো হবে, কাঁথাটা কেমন হবে, শীতকালে হলে গরম পোশাক-কম্বল, গরমকালে আরামদায়ক, মিহি-নরম কাপড়চোপড়, পাতলা কাঁথার ব্যবস্থা করা, নতুন অতিথির জন্য আয়োজন তার বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি ও অন্য আত্মীয়রা করে থাকেন ।

দুনিয়ার স্বল্পসময়ের জীবনের ছোট্ট একটা অংশের জন্য যদি আমরা এতকিছু করতে পারি, তবে অনন্ত-অসীম জীবনের শুরুর প্রথম স্টেশন কবর- যেখানে আমাদের থাকতে হবে দীর্ঘসময় সে জীবন সম্পর্কে আমরা উদাসীন কেন? সেখানে থাকতে হবে মাটির বিছানায়, থাকবে না কোনো জামাকাপড়, কবরে থাকবে না কোনো মানুষজন। সেখানে থাকবে এক ধরনের জবাবদিহিতামূলক দুশ্চিন্তা ।

কবরে আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে- তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী? রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দেখিয়ে প্রশ্ন করা হবে, এই ব্যক্তি কে? শত, হাজার বছর আগে এসব প্রশ্নের উত্তর দুনিয়ায় নাজিল করে দিয়েছেন আল্লাহ। যারা এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে তারা থাকবে ভালো অবস্থায়। আর যারা উত্তর দিতে পারবে না তাদের আজাবের শুরু হবে কবর থেকেই।

ভয়ঙ্কর জাহান্নাম হবে ঠিকানা। কবর যেহেতু পরকালের প্রথম ঘাঁটি, তাই এতে যেন সমস্যার মুখে পড়তে না হয় সেটি নিশ্চিত করা অনেক বেশি দরকার। ইংরেজি প্রবাদ A good start is half done বা ভালো একটি শুরু অর্ধেক কাজ সমাপ্ত করে দেয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন ফলপ্রসূ, আখিরাতের বেলায়ও তাই। এ জন্য পরকালের যাত্রায় কবরে ভালোভাবে উতরানোর প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। থাকতে হবে দীর্ঘপথ চলার প্রয়োজনীয় রসদ-সামান। এ কাজটা কীভাবে করবেন, কীভাবে অনন্ত-অসীম যাত্রার প্রাণবন্ত একটি প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হবেন, তা জানানোর জন্যই ‘কবর দেশের খবর নিয়ে যাও’ গ্রন্থের আয়োজন।

আমরা যে পরকাল সম্পর্কে, কবর-হাশর সম্পর্কে বেখবর, তা আল্লাহ ভালো করেই জানেন। এ জন্য তিনি বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তার কালামের মাধ্যমে। কিন্তু হায়! আমরা দুর্ভাগারা সে কালামের কাছেও যাওয়ার সময় পাই না। আল্লাহ বলেন, ‘প্রাচুর্যের নেশা তোমাদের গাফেল করে রাখে। এভাবেই তোমরা কবরস্থানে পৌছে যাও। (সূরা তাকাসুর, আয়াত ১-২।) আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

নিশ্চয়ই কবরে যারা আছেন, আল্লাহ তাদের পুনরুত্থিত করবেন।’ (সূরা হজ, আয়াত ৭।) এই যে আমাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, আমরা গাফেল থেকে কবরস্থানে পৌঁছে যাই তথা মৃত্যুবরণ করি। আবার বলা হয়েছে কবরে যারা আছে তাদের পুনরুত্থিত করা হবে। এটা কেন? অবশ্যই দুনিয়ার কাজকর্মের মূল্যায়ন ও বিচার করার জন্য। আল্লাহ তো বলে দিয়েছেন যে, তোমরা পবিত্র বান্দা হয়ে আমার কাছে ফিরে এসো। ভালো কাজে মনোযোগী হওয়া ও পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করার পেছনে ছুটা দরকার। কিন্তু আমার আপনার বাস্তবতা পুরোপুরি পরকালের বিপরীত। সুতরাং আসুন, পরকালের খবর নিয়ে কবরে যাই ।

দুনিয়ার জীবন হচ্ছে সবার জন্য পরকালের সফর। সফরে এসে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার চিন্তা কোনো বোকা মানুষও করে না। বরং স্থায়ী ঠিকানায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভালো জিনিস সংগ্রহে কষ্ট করে কাটিয়ে দেয়, আমাদেরও তেমনই পরকালের জন্য, কবরের জন্য, হাশর ও কিয়ামতের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করার এখনই সময়। এর অর্থ কিন্তু এটা নয় যে আপনি দুনিয়া ত্যাগ করে, জগৎ-সংসারের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কেবল আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবেন। স্ত্রী-পরিজনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কথিত ‘আল্লাহর রাস্তায়’ চলে যাবেন, সে সুযোগ আল্লাহ রাখেননি। দুনিয়ার কাজের মধ্যেই তিনি রেখেছেন পরকালের প্রস্তুতি। আমার ব্যবসা, আমার চাকরি,

আমার দৈনন্দিন সব কাজ আল্লাহর রাসূলের (সা.) দেখানো পদ্ধতি মোতাবেক হলেই আমি সফল। এর জন্য মাত্র দুটি কাজ করতে হবে। আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় করে বাকি যে কোনো কাজ সঠিক পদ্ধতিতে করলেই চলবে।

মনে রাখতে হবে, এ দুনিয়ায় কেবল আমি ও আমরাই প্রথম ব্যক্তি নই। আমাদের থেকে আরও বড় বড় মানুষ, দ্বীনের প্রভাবশালী, দুনিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি এসেছেন। তারা আবার চলেও গেছেন। মূলত আল্লাহ কিছু সময়ের জন্য পাঠিয়েছেন, আবার নিয়ে গেছেন। যাকে সৃষ্টি না করলে সৃষ্টি করা হতো না কিছুই, সে রাসূলুল্লাহ (সা.)ও আজ পৃথিবীতে জাহিরিভাবে নেই, তেমনই নেই আরও বহু আল্লাহর প্রিয় নবীরা (আ.)। একই সঙ্গে নমরুদ, ফেরআউন, কারুন থেকে শুরু করে হিটলার-হালাকু খানরাও বিদায় নিয়েছেন। তাদের ও আমাদের সবার ক্ষেত্রেই জীবন কিছু সময়ের সমষ্টি মাত্র। এটি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যু তথা কবরের দিকে। এসব কথা মনে রাখলে দুনিয়ার জীবনে চলা পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করা সহজ হবে।

  মহান সাধক শেখ সাদীর (রহ.) কবিতায়- এই পৃথিবী কারোর জন্যই চিরস্থায়ী নয় 

শেষ পর্যন্ত তো সবাইকেই আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই অন্ত জীবনের খবরাখবর জানুন এ গ্রন্থ পড়ে।

সুফিসাধক, কবি আল্লমা জালালুদ্দিন রুমি বলেন, ‘হে মানব, বহু ইবলিস বসে আছে আদম সুরতে, ফেলতে হবে সতর্ক পা। সতর্কও থাকবে সব সময়। কোনো প্রতারক যেন ধর্মের নামে গোঁজামিল দিয়ে আমাদের ইহকাল-পরকাল নষ্ট করতে না পারে। মনে রাখতে হবে, ইবলিস কিন্তু আমাদের পথচ্যুত করার শপথ নিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরছে। পরকালের যাত্রার শুরু বা গোড়ায় তথা কবরে যেন ঠিকঠাকভাবে, আল্লাহর বাণী- “তোমরা পরিপূর্ণ মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ মেনে নিয়ে কবরে যেতে পারি।

“মিনহা খালাকনাকুম,

অফিহা নুয়িদুকুম

অমিনহা নুখরিজুকুম

তারাতান উখরা

অর্থ : ‘সৃষ্টি করেছি তোদের মাটি থেকে

ফের ঢোকাব মাটির ভেতর বাড়ি বাড়ি করিস রে মন এই বাড়ি তো তোর না, কবর আসল বাড়ি, মাটি হবে বিছানা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *