কোরান কুমারী
হেফয্খানায় পড়া চলছে তালিবে ইলমরা দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করছে। শিক্ষিকা ঘুরে ঘুরে পড়া শুনছেন। ভুল হলে শুদ্ধ করে দিচ্ছেন। হাতে ছোট্ট একটা ছড়ি। সেটা কেউ কোনও দিন ব্যবহৃত হতে দেখেনি। হাতির দাঁতের মতো। দেখানোর জন্যে। মারার জন্যে নয়। ধরা পড়লো একজন আসেনি।
এই রাবেয়া। জামাল কোথায় রে! -আসেনি! কেন আসল না? -আর পড়বে না। কায়রোতে বাবার কাছে গিয়ে চাকরি করবে! চল তো দেখে আসি! এই খোকারা! তোরা সবাই ভাল করে পড়। কেমন? জামাল বাড়ি আছিস? জি হাজ্জাহ! -বেরিয়ে আয় বলছি! কিরে, তুই নাকি আর হেফয পড়বি না! -জি! তাহলে আমি এতদিন তোর জন্যে শুধু শুধু মেহনত করলাম শুধু শুধু? সময় ব্যয় করলাম? আমার সময় ফেরত দে! ইয়ে মানে সময় কিভাবে ফেরত দেবো? -তাহলে টাকা দে!
-আমি কায়রো গিয়ে চাকরি করে পাঠিয়ে দেবো! -না! বাকিতে ফাঁকি! এখনই দে! আমি টাকা কোথায় পাবো? -তাহলে পড়তে চল! তোর আম্মু কোথায় ডাক! কী ব্যাপার। আপনি ছেলের পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছেন কেন? -আমি কোথায় বন্ধ করলাম? তার মনে কী দুষ্টুবুদ্ধি চেপেছে সেই জানে। বাড়িতে খাবার নেই।
ভূখ-ক্ষুধার কষ্ট দেখে ছেলে আর পড়তে চাচ্ছে না। ঠিক আছে, এবার থেকে তার খাওয়ার দায়িত্ব আমার। মাদরাসায় থেকেই পড়াশুনা করবে। হেফয শেষ করার আগে বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করবে না। এতক্ষণ বলছিলাম নাফীসা আলী (রহ.)-এর কথা। জন্ম ১৯১৬ সালের শেষ দিকে। মিশরের এক গাঁয়ে। কুফরুশ শানহাব।
বাবা-মায়ের আনন্দ আর ধরে না। এমন ফুটফুটে কন্যাসন্তান। পরহজেগার পিতা তখন থেকেই নিয়ত করে ফেলেন আল্লাহর দেয়া এই উপহারকে পরম আদর যত্নে গড়ে তুলতে হবে।
কুরআনের খাদেমা বানাবেন মেয়েকে। হাফেয হবে তার মেয়ে। হবে কুরআনের সেবিকা। একটু বড় হয়ে হাঁটাচলা শুরু করেছে, মুখে একটু আধটু বোল ফুটেছে। মেয়েটা এখন ছোটাছুটি করে উঠোনময় মোরগ তাড়াতে পারে। বাবার পিছু পিছু মসজিদে যেতে পারে। মায়ের আঁচল ধরে কুয়োতলায় যেতে পারে।
হরফ চেনা শুরু হয়েছে। চক-খড়ি দিয়ে টুকটাক হিজিবিজি লেখার চেষ্টাও পূর্ব কোন আভাস ছাড়াই মেয়েটা মারাত্মক রোগে পড়লো। দিনদিন শুকিয়ে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বাবা-মায়ের চোখে ঘুম নেই। আল্লাহর
প্রতিও কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু কচি মা-মণিটার এহেন কষ্টও সহ্য করা। যাচ্ছিল না।
মিশরের এমন অজপাড়া গাঁয় ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই তার ওপর আর্থিক অসঙ্গতির কারণে ভাল কিছুও করা যাচ্ছে না। অবিরাম দু’আ-রোনাজারি আর অক্লান্ত সেবা শুশ্রুষায় আল্লাহ মেয়েটাকে সুস্থ করে দিলেন। মেয়েটা এখনো বিছানায় পড়ে আছে। তবে খাওয়া-দাওয়ার রুচি ফিরেছে।
একটা বিষয় বড়ই ভাবিয়ে তুলছে বাবা-মাকে, মেয়েটা চোখ বুলতে পারছে না। পিটপিট করে তাকালেও পরক্ষণেই আবার বন্ধ করে ফেলছে। আলো সহ্য করতে পারছে না। একদিন মেয়ের কথা শুনে সবাই বজ্রাহত হয়ে পড়লো, -আম্মু! তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন? কষ্ট হলেও আল্লাহর ফয়সালা মেনে নিতেই হয়। তিনি যা করেন বান্দার ভালোর জন্যেই করেন।
এটুকু বুঝ ঘরের মানুষদের ছিল। বাবার কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেও, লক্ষ্য থেকে একচুলও পিছু হটেননি। নিত্যদিন মেয়েকে কোলে-পিঠে করে মাদরাসায় বয়ে নিয়ে যান। আবার ফিরিয়ে আনেন। বাবার সারাদিনের কাজই ছিল মেয়েকে নিয়ে থাকা। তার কুরআন পড়ার কাজে সার্বিক সহযোগিতা করা। আল্লাহর পাক কালাম মুখস্থ করতে উৎসাহ যুগিয়ে যাওয়া। আল্লাহ চোখ তুলে নিলেও অন্য দিক দিয়ে একেবারে উপচে দিলেন।
মেয়েটা অল্প ক’দিনের মেহনতেই পুরো কুরআন কারীম কণ্ঠস্থ করে ফেললো। তার সুললিত পড়া শুনে সবাই বিমুগ্ধ। গ্রামের মাদরাসায় পড়ার পাট চুকলো। এবার? অদূরে একটা জায়গা আছে। সেখানে কুরআনের বড় বড় আলেম-হাফ্যে- কারীরা থাকেন। বাবা মেয়েকে নিয়ে সেখানে হাজির হলেন।
কুরআন কারীমের ওপর আরও উন্নত শিক্ষার সুযোগ এসে গেল। মেয়ের খুশির অন্ত নেই। এর মধ্যে একজন মহিলা উস্তায পেয়ে গেলেন বাবা। শায়খাহ নুর বদবী। উস্তাযও মনের মতো ছাত্রী পেয়ে মনপ্রাণ ঢেলে নিজের অর্জিত ইলম শেখানোয় ব্রতী হলেন। পড়াশুনার পর্ব শেষ হলো। এবার কর্মজীবন।
গ্রামের মেয়ে গ্রামে ফিরে এল। ছেলেবেলার মাদরাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত হলো। গতানুগতিক নয়, ছেলেমেয়েরা যাতে মনের আনন্দে পড়তে পারে, এমন পরিবেশ গড়ে তুললেন আশেপাশে একটা বাচ্চা ছেলেও যেন কুরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে সদা তৎপর থাকলেন।
চোখ নেই তো কী হয়েছে তোর মনের চোখও কি নেই? যার কাছে কুরআন আছে তার আর কোনও চোখের দরকার হয়? যেসব ছেলে-মেয়ে সরকারী স্কুল বা কাজের কারণে দিনের বেলা কুরআন পড়তে পারে না, তাদের জন্যে ফজর আর মাগরিবের পর বিশেষ পাঠের ব্যবস্থা নিলেন। কোনও রকম বিনিময় ছাড়াই। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে।গরীব ছাত্রদের খরচাপাতি চালালেন।
এভাবে একসময় বিয়ের বয়েস এসে গেলো। মেয়ের এদিকে কোনও উদ্যোগ-আগ্রহ না দেখে, বাবা-মা চিন্তিত। আগে বলেকয়েও রাজি করাতে পারেননি। ভাল ভাল প্রস্তাব আসছে। মেয়ে অন্ধ শুনেও অনেকে আগ্রহী হচ্ছে। মেয়ের এক কথা, আরও কিছুদিন পর। ঘরে কানাঘুষা শুরু হলো। বাইরেও। এবারের প্রস্তাবটা ফেলনা নয়।
পাত্র সবদিক দিয়েই যোগ্য। মেয়েকে মাথায় তুলে রাখবে। তার কাজেও বাধা-বিঘ্ন ঘটাবে না। বাবা এক রাতে মেয়ের কাছে প্রস্তাবটা পাড়লেন,
-নাফীসা! মা! আমরা আর কতদিন! পরপারের ডাক তো এসে গেলো! তোর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে, মনটা হালকা হত! -ওটা নিয়ে তোমরা এত ব্যস্ত কেন? আমাকে আমার মতো থাকতে দাও না! -তা কি হয় রে মা! তুই এত গুণী একটা মেয়ে, কতো ভাল ভাল ছেলে তোর পাণিপ্রার্থী! এবার আর না করিস না! -আব্বু!
তাহলে শোন! আমি এতদিন পাশ কাটিয়ে পার পেয়ে গেলেও আর পারবো না বুঝতে পারছি!
আমি অনেক দিন আগেই মনে মনে একটা সংকল্প করেছিলাম যে হায় ! -কী সংকল্প রে মা! -আমি কখনো বিয়ে করবো না! -এ কেমন কথা শোনালি রে মা! -জি আব্বু! আমি আমার জীবনকে কুরআন কারীমের জন্যে হেবা (দান) করে দিয়েছি। আমার ইহজীবন কুরআনের তরেই ওয়াকফ করেছি।
এটাই আমার চূড়ান্ত কথা! আর জোরাজুরি না করলে খুশি হবো। কিভাবে আমি আরও বেশি করে কুরআন কারীমের খেদমত করতে পারি, সেদিকটা দেখ! বাবার মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।যতই দিন গড়াচ্ছে, মুহতারামা নাফীসার কুরআন নিয়ে মেহনতের মাত্রা ও পরিমাণও বেড়েই চলছে।
এক পর্যায়ে এমন দাঁড়ালো, গ্রামের ছেলেবুড়ো সবাই তার ছাত্র। আশেপাশের সমস্ত মায়েরা তার ছাত্রী। সবার আস্থার জায়গা। বড় বড় ব্যক্তিরাও তার কাছে দু’আর জন্যে আসেন। মিশর সরকারও তাকে নানা পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন। বাবা-মা দু’জনেই পরপারে পাড়ি জমালেন। ভীষণ একা হয়ে গেলেন।
কিন্তু কুরআনকে যিনি সাথী হিশেবে বেছে নিয়েছেন তিনি কি কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারেন তাতে কোন সমস্যা নাই? এরই মধ্যে এক অবাক কাণ্ড ঘটলো। স্বপ্নে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলেন।
একবার নয় কয়েকবার। মন ছুটে গেল মদীনার পানে। কিছুতেই দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু সফরের রাহাখরচা? একা তো যাওয়া যাবে না। ভাইদের কাউকে সাথে নিয়ে যেতে হবে! উপায়? মীরাসসূত্রে কিছু পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। সেটাই অবলীলায়
বিক্রি করে দিলেন। হাঁফ ছাড়লেন হজ্জের খরচের ব্যবস্থা হয়েছে। আল্লাহ তার এই নেক বান্দীর মনের আশা পূরণ করলেন। এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলেন। অসম্ভব সুন্দর এক বাগান। নানারকম ফুলফলে শোভিত। বলা হলো এটা তোমার নিজস্ব জায়গা।