জাদু আর জাদু পর্ব ২

জাদু আর জাদু পর্ব ২

সরাইখানার ধূর্ত মালিক এবার কিছু বলার আগেই ফিটফাট একটা ঘর দিল
ঘুমানোর জন্য । আর রবিনের সামনে এসে হাতজোড় করে বলল,
ভাই, আমার সরাইখানায় তো আজ ভালো কোনো খাবার নেই। কয়েক
টুকরো শুকনো রুটি, একটু পনির আর এক মগ দুধ আছে। কী দিয়ে যে আপ্যায়ন
করব আপনাকে?

image

– না, না। এসব নিয়ে একদম ভাবতে হবে না আপনাকে।
বলল রবিন। বেচারা একটু বোকাসোকা ধরনের। গাধার মতো শুধু কাজ করতে
পারে আর কিছুই সে বোঝে না। সরাইখানার মালিককে বলল,
দেখুন— আমার এই টেবিলটা জাদুর
টেবিল ৷ মজা দেখুন। রবিন টেবিলের দিকে
তাকিয়ে বলল,

জলদি কর, জলদি কর
অমনি টেবিল জুড়ে হাজির হল উৎকৃষ্ট
মানের সব খাবার। সরাইখানার মালিক আর
রবিন পেট পুরে খেল অনেককিছু। তারপর
‘গুটিয়ে ফেল’ বলতেই আগের মতোই
টেবিলটা ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেল ।

সরাইখানার ধূর্ত মালিকটা টেবিল সম্পর্কে
কিছুই বলল না। শুধু মনে মনে ফন্দি আঁটতে
লাগল, গাধা-চুরির মতো টেবিলটাও চুরি
করতে হবে।
রবিন একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ।
মালিকটা ভাবল— এখনই নিরাপদ সময়। একই রকম দেখতে একটা টেবিল এনে
রেখে দিল রবিনের ঘরে। আসল টেবিলটা রেখে দিল নিজের ঘরে। শুধু
সকালবেলায় হুকুম দিল ‘জলদি কর’, তারপর সবকিছু এনে রেখে দিল নকল
টেবিলের উপর।
সকালে রবিন ঘুম থেকে উঠতেই মালিক এসে হাজির |
সব প্রস্তুত আছে। আমিই আপনার টেবিলে হুকুম দিয়ে সব খাবার
আনিয়ে রেখেছি ।
দুজনে পাশাপাশি বসল। রবিন বলল, আমি জলদি করে রওনা দিতে চাই।
বাড়ির জন্য ভারি মন খারাপ করছে। বাবাকে গিয়ে এই টেবিলটা দেখাতে হবে।
খাওয়া শেষে রবিন যখন ‘গুটিয়ে ফেল’ বলতে গেল তখন সরাইখানার মালিক
তাকে থামিয়ে দিল।
image
বাকি খাবার আর প্লেটগুলি আমি রান্নাঘরে নিয়ে যেতে চাই। আমার এখানে
দু-একজন কাজ করে। তারা এঁটোকাটা পেলেই ভারি খুশি হবে। এই খাবারের
বিনিময়ে রাতে তোমার থাকার পয়সা চাই না আমি।

মনের দুঃখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল রবিন। একছুটে সে গেল তার প্রাণপ্রিয়
মার্গারেটের কাছে। মার্গারেট সব শুনে অবশ্যি সান্ত্বনা দিল।
আবার চেষ্টা করে দ্যাখো। বার বার মানুষ বিফল হয় না। এবার হয়তো সফল
হবে তুমি। ভেঙে পড়ো না রবিন।
রবিন আবার শক্তি ফিরে পেল মার্গারেটের কথায়। গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল
সে। আবার কাজ খুঁজতে লাগল । খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে হল না, পথে যেতেই
এক বুড়োর সাথে তার দেখা। ছোট্ট একটা খালের ওপর বুড়োটা একটা সাঁকো
বানাবে। খালের ধারেই একটা গাছ রয়েছে। বুড়ো সেটা কাটার চেষ্টা করছে
হিন গিয়ে বলল,
চাচা, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?
– তুমি কুঠার চালাতে পার?
খুব ভালোমতো পারি।
এই বলে কুড়োলটা হাতে নিল রবিন। তারপর ঠকঠক শব্দ করে গাছটা কাটতে
লাগল। এমনভাবে কাটতে লাগল সে, যেন গাছটা খালের এপার-ওপার হয়ে পড়ে
রবিন কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছটাকে কেটে ছোট একটা পুলের মতো বানিয়ে ফেলল।
বুড়ো লোকটা তো মহাখুশি।
তোমাকে আমি পুরস্কার দিতে চাই বাবা।
রবিন মাথা নামিয়ে রইল। এই সামান্য কাজের জন্য আবার পুরস্কার কী?
বুড়ো তখন পাশের একটি গাছ থেকে ছোট্ট একটা ডাল কেটে রবিনকে দিল
এই নাও তোমার পুরস্কার। ছোট্ট একটা লাঠি। কিন্তু এটা কোনো সাধারণ
লাঠি নয়। জাদুর লাঠি। তুমি যদি বল ‘মার লাগাও’ অমনি লাঠি বেধড়ক মার
রবিন লাঠিটা হাতে নিল। তারপর বলল, “মার লাগাও’। অমনি লাঠিটা নেচে
উঠল। যেন ওর ভীষণ রাগ। বাতাসের মধ্যে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।
বুড়োলোকটা একলাফে সরে গেল সামনে থেকে।
থামতে বল। থামতে বল লাঠিটাকে।
অমনি লাঠি থেমে গেল।
মনে রেখো, লাঠিটা তোমার ভীষণ অস্ত্র। বড় কাজে দেবে তোমার। কারও
ওপর যদি রাগ হয় তখন লাঠিটাই হবে তোমার বিপদ-তাড়ন পাচন। দোয়া করি
বাছা, জীবনে যেন সুখ-শান্তি হয় তোমার।
চুরি
এল একটা। মনে
করল? নিশ্চয়ই
লাঠিটা হাতে নিয়ে ভারি খুশি হল রবিন। মাথায় তার বুদ্ধি
পড়ল, কোথায় গেল তার আসল গাধাটা? টেবিলটাই-বা কে
কেউ চুরি করেছে ও-দুটো। আসল জিনিসের বদলে নকল জিনিস গছিয়ে দিয়েছে
আমাকে। মাত্র একজন লোকই আমার কেরামত দেখেছে। সে হচ্ছে সরাইখানার
মালিক। তন্ত্র চেহারার মুখোশে লোকটা আসলে ভীষণ বদ। রবিন ভাবল, লাঠিটা
হাতে পেয়েছি। এবার আসল গাধা আর আসল টেবিলটাও আমি উদ্ধার করতে পারব। সরাইখানার ধূর্ত মালিকটাই আমার জিনিস চুরি করেছে। এবার তাকে
রবিন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা নাগাদ গিয়ে পৌঁছল সরাইখানায়। লাঠি দিয়ে সে
সরাইখানার মালিক রান্নাঘর থেকে ছুটে এল। কে এত জোরে কড়া নাড়ছে?
দরজায় ঘা দিতে লাগল জোরে জোরে।
বিরক্তভাবে সে দরজা খুলল ।
তোমাকেই তো চাচ্ছি আমি। মনে পড়ে আমায়?
চিৎকার করে বলল রবিন।
রবিনের দিকে বাঁকা চোখে তাকাল মালিকটা ।
তোমাকে চেনার কোনো কারণ নেই। আমার সরাইখানায় অনেকেই আসে।
সবাইকে মনে রাখতে হবে এমন কোনো কারণ নেই।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি এক গুরুত্বপূর্ণ লোক। তাই নয় কি? যা হোক,
ঝটপট বলে ফেল, কোথায় আমার গাধা আর কোথায় আমার জাদু-টেবিল । তোমার
এই বাজে সরাইখানায় রাত কাটানোর সময় তুমি আমার গাধা আর টেবিল চুরি
করেছ। শিগগির জিনিস দুটো আমায় দিয়ে দাও। নইলে তোমার কপালে শাস্তি
আছে । হাতের এই লাঠিটা দেখতে পাচ্ছ?

———

তোমার গাধা আর টেবিল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
রাগে চেঁচিয়ে উঠল সরাইখানার মালিক।
আমায় ভয় দেখিও না। তোমার চেয়ে অনেক বড় ঘুঘু আমি….।
লোকটা আর কথা শেষ করতে পারল না। রবিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
সত্যিই তুমি জানো না যে, কোথায় আমার জিনিস? ব্যাটা চোর! আমার
সঙ্গে জোচ্চুরি!

image

বলতে বলতেই রবিন চেঁচিয়ে উঠল, মার লাগাও।
অমনি লাঠিটা নেচে উঠল । প্রথমে বাতাসে দু পাক ঘুরে নিল । তারপর ছুটে গেল
লোকটার দিকে। তারপর শুরু হল বেধড়ক পিটুনি । এমন পিটুনি জীবনেও খায় নি
বেচারা । লাঠিটা ঘুরতে লাগল বনবন করে। একবার পিঠে, একবার পায়ে, একবার
হাতে সমানে আঘাত করতে লাগল । মাথাতেও বাড়ি মারতে লাগল । লোকটা কখনো
বসে পড়ছে, কখনো শুয়ে পড়ছে। কিন্তু লাঠির মার থেকে তার নিস্তার নেই। মার
খেতে খেতে লোকটা শুয়ে পড়ল মেঝেতে। হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখে লোকটা
আর্তনাদ করতে লাগল— বাঁচাও ৷ বাঁচাও আমায়। রক্ষা কর।
কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগল,

– তোমার গাধা ফেরত দেব আমি। রক্ষা কর আমায় । তোমার টেবিলও ফেরত
পাবে। রক্ষা কর। রক্ষা কর আমায়। লাঠিটাকে থামতে বল । আমি মরে যাব।
আমায় মেরে ফেলো না ভাই।
কিন্তু কোথায় আমার জিনিস?
– উঠোনের শেষমাথায় ছোট্ট ঘরে গাধাটা বাঁধা আছে। টেবিলটা আছে আমার।
শোয়ার ঘরে। এক্ষুনি আমি তোমায় ফেরত দিচ্ছি সব।

রবিন তখন লাঠিটাকে থামতে বলল। লোকটা আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে
গেছে। লাঠিটা আপসে ফেরত এল রবিনের হাতে।
সরাইখানার মালিক তখন ক্ষত-বিক্ষত। কাঁদো-কাঁদো স্বরে কোনোমতে সে উঠে
দাঁড়াল। হাড়গোড় যেন সব ভেঙে গেছে। ব্যথায় ককাতে লাগল সে। অনেক কষ্টে
টেবিল আর গাধা অর্থাৎ জাদুর টেবিল, জাদুর গাধাটাকে নিয়ে এল রবিনের সামনে।
রবিন গাধার কান ধরে আর টেবিলকে হুকুম দিয়ে পরীক্ষা করে নিল— এগুলো সত্যি
সত্যি তার কিনা। তারপর গাধার পিঠে সে টেবিলটাকে আচ্ছা করে বাঁধল। হাতে
রইল জাদুর লাঠি। রাস্তায় যদি আবার কেউ চড়াও হয় তবে এই লাঠিটাই তার
বিপদ-তাড়ন পাচন। লোকটির সঙ্গে কোনো কথা না-বলেই রওনা দিল রবিন।
সৌভাগ্য বুঝি এবার রবিনের হাতে এসে ধরা দিল। যখন সে বাড়ি
পৌছাল— বাবা তাকে দেখে মহাখুশি। গাধার কান টানতেই বাবা পেয়ে গেল
সোনা-রুপার মোহর। আর টেবিলের সামনে চাইতেই এসে হাজির হল জগতের
সব সেরা সেরা খাবার ।

বাবার খুশি আর ধরে না। ছেলের প্রশংসায় তার মুখে ফুলঝুরি ছোটে। রবিন
বাবার নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতার কথা ভুলে গেল । অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে গ্রামের
মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বড় বাড়িটা বানিয়ে দিল বাবাকে। আর বাবাকে সাহায্য
করার জন্য কাজের লোক রাখল অনেকগুলো।
আর মার্গারেট? রবিন ফিরে এসেছে এতেই সে খুশি। আনন্দ আর ধরে না।
কদিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। আর জাদু-টেবিলের সাহায্যে তারা
সারাদিন গ্রামবাসীদের এমন খাবার খাওয়াল যে, গ্রামবাসীরা সে-সব খাবার আগে
কখনো চোখেই দেখে নি।
তারপর রবিন আর মার্গারেট সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল। আর হ্যাঁ—
রবিন বোকা হলেও সে ছিল খুব দয়ালু আর উপকারী। সে মানুষের উপকার করে
বেড়াতে লাগ্ল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *