জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব
***মর্মান্তিক দুঃখের রাত***
মুষলধারে তখন বৃষ্টি পড়ছে। আর তার সাথে বজ্র বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এমন
মহাদুর্যোগের রাতে এ মর্মান্তিক দুঃখ-দুর্যোগ মাথায় করে রহিমা রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে পথ চলতে লাগলেন। ভোরের বাদশাহ সন্ধ্যায় ফকীর, আজ যে ভিখারি কাল সে সম্রাট। এটাই জগতের রীতি। আল্লাহর প্রিয়নবী শামদেশের মহা পরাক্রান্তশালী বাদশাহ হযরত আইউব যার ঐশ্বর্য ও ধন-সম্পদের কোন তুলনা ছিল না। যার আদেশে তাবেদার ছিল লাখ লাখ মানুষ।
হায়রে, অদৃষ্টের অমোঘ বিধানে সে বাদশাহ আজ এক দুর্বল, ক্ষীণকায় অবলা নারীর স্বন্ধে চেপে। ভিবারির বেশে যাত্রা করেছেন, অজানা, অচেনা, অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে। মহাদুর্যোগময় দুঃখের রজনী মাঝে প্রচণ্ড ঝড় বাদলের ভিতর দিয়ে ঘন কাল অন্ধকার পথে রহিমা স্বামীকে নিয়ে সামনের দিকে চলতে লাগলেন।
ভীষণ অন্ধকার পথ ঘাট কিছুই দেখা যাচ্ছে না বারে বারে তিনি হোঁচট খাচ্ছেন, তবুও পথ চলা বন্ধ করছেন না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে, শিলা বৃষ্টির আঘাতে রুগ্ন স্বামীর অবস্থা মৃত প্রায় হয়ে এল। কিন্তু এ মুহূর্তে স্বামীকে নিয়ে কোথায় তিনি একটু আশ্রয় নিবেন, কোথায় যাবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না।
এমন দুর্গন্ধযুক্ত কুণ্ঠ্য রোগীকে নিয়ে তিনি কার গৃহে আশ্রয় নিবেন লোকেরা তো তাকে দেখা মাত্রই দুর তাড়িয়ে দিবে। কিন্তু এভাবে স্বামীকে কাঁধের উপর নিয়ে তিনি আর চলতে পারছেন না তাঁর নিজের চলৎ শক্তিও রহিত হয়ে এল। ভীষণ শীতে সমস্ত শরীরে কাঁপন ধরে হাত পা অবসন্ন হয়ে এল। তাই বাধ্য হয়ে একটি ঘরে আলো জ্বলতে দেখে বহু কষ্টে স্বামীকে কাঁধে নিয়ে সে দিকে অগ্রসর হলেন।
তাঁর পা আর চলতে চাইল না, অবশ হয়ে এল। ঘরের কাছে এসে অতি সাবধানে স্বামীকে কাঁধের উপর হতে নামিয়ে অতি সন্তর্পণে সে ঘরের আঙ্গিনায় ছাদের নিচে অর্ধ শায়িতভাবে বসিয়ে দিলেন। এরপর নিজের হাত দ্বারা
স্বামীর দেহের পানি মুছে দিলেন কিন্তু সিক্ত বসনেই তারা সারা রাত কাটিয়ে দিলেন।
আল্লাহর কুদরত কে বুঝতে পারে। আল্লাহর নবী বিশাল শাম রাজ্যের বাদশাহ এবং তার বেগম আজ নিশিথ চোরের মত অন্যের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু আজ এ মহা দুঃখের দিনে মহা দুঃখ ও দুর্যোগের রাত যেন আর শেষ হতে চায় না। কথায় বলে দুঃখের রাত সহজে কাটে না।” অবশেষে পূর্ব আকাশে আলোর রেখা দেখা দিল। রহিমা আর বিলম্ব না করে লোকজন জেগে উঠার পূর্বেই লোকালয় ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় যাত্রা করেন।
এরপর দীর্ঘ সময় পথ চলে একটি উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে এক গাছের ছায়ায় স্বামীকে শোবার ব্যবস্থা করেন। অবর্ণনীয় দুঃখময় জীবন বিশাল শামদেশের বাদশাহ আইউব (আঃ) আজ খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছেন। একেই বলে বিধির বিধান।
স্বদেশচ্যুত হয়ে এ পাহাড়ের পাদদেশে বন্য ভূমিতে আশ্রয় নিয়ে রহিমার সামনে এখন দেখা দিল খাদ্য সমস্যা। প্রায় দুতিন দিন পর্যন্ত তিনি স্বামীকে নিয়ে অভুক্ত কাটিয়েছেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের ধক্কল এবং অনাহারে রহিমা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু তবু স্বামীর অভুক্তির কথা ভেবে নিজের দৌর্বল্যের কথা ভুলে গেলেন। মৃদুকণ্ঠে স্বামীকে বলেন, আপনাকে একা রেখে কোথাও যেতে মন চায় না।
কিন্তু না গেলেও যে চলছে না! স্বামী আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি কিছুক্ষণেই মধ্যেই ফিরে আসছি। স্বামীকে এ কথা বলে কিছু খাবার সংগ্রহ করার জন্য তিনি লোকালয়ের দিকে দ্রুত ছুটতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি একটি স্বচ্ছ পানির ঝরণা দেখতে পেয়ে পানি পান করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
পিপাসায় তাঁর কণ্ঠ শুকিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পানি হাতে নিয়ে স্বামীর কথা মনে পড়ায় আবার দৌড়ে গিয়ে স্বামীর জন্য নিয়ে এলেন। তারপর অঞ্জলি ভরে স্বামীকে পানি পান করালেন এবং নিজেও প্রাণ ভরে পানি পান করলেন। দুজনে পানি পান করে পরম তৃপ্তিতে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। এরপর স্বামীকে যথাস্থান রেখে আবার রহিমা খাদ্য সংগ্রহের আশায় গ্রামের দিকে দ্রুত ছুটতে লাগলেন।
গ্রামে পৌঁছে দানতো দূরের কথা, “তাঁর স্বামী কুষ্ঠ রোগী, তিনি কুষ্ঠ রোগীর স্ত্রী” এ কথা শুনে কেউ তাে ঘরে ঘরে তিনি সামান্য খাদ্যের জন্য ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু গ্রাম্য লোকেরা খাদ্য তাঁদের নিকটেই দাঁড়াতে দিল না। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে এমনি করে সারাদিন এক এক করে সাতটি গ্রাম ঘুরে দুজন মানুষের একবেলার খাবারও জোগাড় করতে পারলেন অথচ সন্ধ্যাও হয়ে আসছে, কিন্তু স্বামীর জন্য একটুকু খাবারও যদি সংগ্রহ করতে পারতেন। • সারাদিন স্বামী একা রয়েছেন, একা একা তাঁর কি দশা হয়েছে তা ভেবে তার হৃদয় শিহরিয়ে
উঠল। ইচ্ছে হল এ মুহূর্তেই ছুটে গিয়ে স্বামীর পাশে উপস্থিত হন।
কিন্তু তাঁর শক্তি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে আসছে। সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। তবুও তিনি ছুটে চলছেন। কিন্তু সারাদিন পর অনাহার ক্লিষ্ট, মৃতপ্রায় স্বামীর কাছে কোন মুখে এমন শূন্য হাতে গিয়ে উপস্থিত হবেন, এ চিন্তায় তাঁর দেহের শক্তি একেবারেই নিঃশ্বেষ হয়ে আসল। কিন্তু স্বামীর কাছে তাকে পৌঁছতেই হবে। ক্লান্ত দুর্বল শরীরে হাঁটতে পারছেন না। তবুও হাঁটবেন। কিছুদূর হাঁটেন আবার পড়ে যান। উঠে আবার হাঁটতে থাকেন আবার পড়ে যান আবার উঠে পথ চলেন।
এমনি করে পথ চলে রাত প্রায় এক প্রহর কালে রহিমা স্বামীর কাছে এসে পৌঁছে দেখেন, হযরত আইউব (আঃ) মৃতের ন্যায় নিষ্পন্দ অবস্থায় পড়ে আছেন। স্বামীর কাছে এসে তিনি স্বামীর দেহে হাত রাখলেন। রহিমার হাতের পরশ পেয়ে হযরত আইউব (আঃ) বলেন; রহিমা তুমি এসেছ? স্বামীর কথায় রহিমা বলেন, প্রিয় স্বামী। এসেছি সত্য, কিন্তু বলতে বুক ফেটে যাচ্ছে, সারাদিন ঘুরেও আপনার জন্য একলোকমাও খাবার যোগাড় করতে পারি নি।
এখন আপনাকে যে কি খেতে দেব তাই ভেবে পাচ্ছি না। স্বামী ! যে নারী তাঁর স্বামীর এমন দুঃসময়ে তাকে এতটুকু সাহায্য করতে পারে না, যাকে স্বামীর এরূপ
অন্নকষ্ট চোখে দেখতে হয়, তাঁর বেঁচে থেকে কি লাভ? এ কথা বলেই রহিমা কেঁদে ফেলেন। তখন হযরত আইউব (আঃ) শান্তনা দিয়ে বলেন, রহিমা। তুমি অবুঝ বালিকার মত কেঁদো না। এ দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাতো প্রিয় মা’বুদের রহমত। এরফল যে কত উত্তম, এর পুরস্কার যে কত মূল্যবান, তা তো তোমার না বুঝার কথা নয়।
এ দুঃখ কষ্ট ও বিপদে যদি আমরা ধৈর্যধারণ করে প্রিয় মাবুদকে স্মরণ করতে পারি তবেই আমাদের জীবন সার্থক হবে। স্বামীর বাক্য শুনে রহিমার হৃদয় শান্ত হল। তিনি কাঁদা বন্ধ করে স্বামীর পদ প্রান্তে পড়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন আয় মা’বুদ! তুমি তোমার প্রিয় বান্দা আমার স্বামীকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান কর । খোলা আকাশের নিচে বন্যভূমিতে স্বামী স্ত্রীর আরো একটি দুঃখের রাত কেটে গেল।
এবার রহিমা ঠিক করলেন, এখানে আর নয়, এখানকার লোকজন বড়ই নির্দয়, নিষ্ঠুর! ভোরবেলাই স্বামীকে নিয়ে এখান থেকে দূরে কোথায়ও চলে যাবেন। রাত শেষে ভোর হলে রহিমা স্বামীকে নিয়ে সে পানির ঝরণার কাছে এসে তারপর আজলা ভরে পানিতে
হাত মুখ ধুয়ে স্বামী-স্ত্রী কিছু পানি পান করলেন এরপর স্বামীকে কাঁধে তুলে আবার অনিশ্চিত অজানা পথে যাত্রা করলেন। এরপর অনেক লোকালয় অনেক জনপথ অতিক্রম করে। সম্মুখের দিকে চলতে লাগলেন।
চলতে চলতে এক প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলেন, প্রান্তর মাঝে অপেক্ষাকৃত একটি উঁচুস্থানে ক্ষুদ্র একটি বাগিচা দেখতে পেলেন। বাগিচার ভিতর একটি জায়গা তার পছন্দ হল। তাই সেখানে একটি গাছের তলে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে স্বামীকে সেখানে শুয়ে দিলেন।