জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব : ১৩

জান্নাতি রমনি রহিমা

*******ছদ্মবেশে ইবলীস*****

হযরত আইউব (আঃ) এবং হিমাকে এত শোক রোগ দিয়েও ইবলীস তাঁদেরকে
না। বছরের পর বছর ধরে এত কষ্ট, এত দুঃখ! রোগ যাতনায় একজন দ্রুত যায়। আর একজন বাদশাহর বেগম হতে নেমে এখন অন্যের বাড়িতে দাসীর কাজে রত কিন্তু তবু তারা আল্লাহর নামে পাগল। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁরা আল্লাহকে ভুলে থাকতেপারে না।

অন্তর মাঝে সদা-সর্বদা আল্লাহর নাম স্মরণ করেন। অনাহার ক্লান্ত শরীর তবু সারা রাত অবিদায় কাটিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন। এতদিন চেষ্টা করেও কিছু করতে না পেরে ইবলীস খুবই নিরাশ হয়ে পড়ল। অনেক ভেবে চিন্তে ইবলীস আবার এক নতুন বুদ্ধি ঠিক করল যে, যদি কোন কৌশলে হযরত আইউবের রক্ত মাংসের সাথে অপবিত্র কিছু মিশিয়ে তাঁর মনের জোর নষ্ট করা যায়, তবেই তাকে আয়ত্বে আনা সহজ হবে।

এরপর রহিমা যখন গ্রাম থেকে পাহাড়ের নির্জন পথ ধরে স্বামীর কাছে ফিরেছেন তখন ইবলীস শয়তান তার পরিকল্পনা মত একজন লোকের বেশ যারণ করে রহিমার সামনে উপস্থিত হয়ে বলল, মাগো, এ নির্জন পাহাড়ী পথে তুমি একলা কোথায় থেকে এসেছ, কোথায়ই বা যাচ্ছ? মাগো। তোমার মুখ এত মলিন কেন? রহিমা ইবলীসকে চিনতে না পেরে এবং তাকে একজন ভাল লোক মনে করে নিজেদের দুঃখের কথা খুলে বলেন।

com-islamicstory-Jannatiromoniislamicstory-1

রহিমার দুঃখের কথা শুনে মানুষ রূপী ইবলীস বলল, তাইতো মাগো! যা ভেবেছিলাম, তোমার কোন কঠিন বিপদ! তাইতো এমন সোনার মত মুখ এত বিষণ্ণ মলিন। মাগো! তুমি কোন চিন্তা করও না। তোমার রুগ্ন স্বামীকে আমি এমন ঔষধের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যা খাবার সাথে সাথে তাঁর রোগ ব্যাধি ভাল হয়ে যাবে।

ছদ্মবেশী ইবলীস বলল, মাগো! এটা খুবই সহজ জিনিস। সামান্য কিছু শরাব এবং শূকরের মাংস। ওষুধের নাম শুনে রহিমা চমকে উঠলেন, মনে মনে বলেন, লোকটি বলছে কি? এ যে সাফ হারাম বস্তু। আমার স্বামী প্রাণ গেলেও তো এ হারাম ওষুধ ব্যবহার করবেন না। তাই রহিমা বলেন, দেখুন এ ওষুধ আমার স্বামী কিছুতেই ব্যবহার করবেন না। আল্লাহর হুকুমের খেলাফ কোন কিছু কখনও করেন নি।

এখনও করবেন না। মানুষ রূপী ইবলীস বলল, দেখ মাগো! তোমার চেয়ে আমার বয়স অনেক বেশি। তোমার চেয়ে বহুদিন পূর্বে আমি এ পৃথিবীতে এসেছি। আল্লাহকেও অনেক ডেকেছি। আল্লাহর আদেশ তামিল করাও খুব ভালই বুঝি । শোন, মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, তখন তার প্রাণ রক্ষার জন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করাই নিষিদ্ধ নয়। আমি যা বলি শোন, তুমি আমার কথা মত কিছু গোশত খাইয়ে দাও এবং শরাবটুকু দেহের ক্ষতে মালিশ করে দাও।

দেখবে তোমার স্বামী তা হলে আরোগ্য লাভ করবেন। মানুষ রূপী ইবলীসের কথা শুনে রহিমা কি করবেন তা ভাবতে লাগলেন। স্বামীকে আবার রোগ মুক্ত সুস্থ সবল দেখবেন এটাই তাঁর প্রাণের কামনা। তাই ভাবনা-চিন্তা করে।
বলেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি দৌড়িয়ে গিয়ে স্বামীর কাছে জিজ্ঞেস করে আসি, স্বামী যদি রাজী থাকেন তবে আবার এসে আপনার কাছে থেকে ঔষধ নিয়ে যাব।

মানুষের ভেশে ইবলীস অপেক্ষা করতে রাজী হয়ে বলল, আচ্ছা তাই কর, আমি অপেক্ষা করছি। লোক যে আসলে ইবলীস শয়তান রহিমা তা ভাবতে পারেন নি। রহিমা দ্রুত গতিতে। স্বামীর কাছে এসে অত্যন্ত আগ্রহ ভরে এ লোকের ওষুধের কথা ব্যক্ত করেন।
রহিমার কথা শুনে হযরত আইউব (আঃ) চোখের দৃষ্টি ভীষ্ম হয়ে উঠল। তিনি বলেন,বললে রহিমা! হারাম বস্তুর সাহায্যে আমি আরোগ্য লাভ করব? এ কথা তোমাকে কে তাকে তুমি চিনতে পার নি। সে নিশ্চয়ই অভিশপ্ত ইবলীস শয়তান। ইবলীস আমাদের পরম শত্রু সে আমাদের ঈমান আমান নষ্ট করার জন্যই এ জাল পাতছে। স্বামীর কথা শুনে তার ভুলের জন্য লজ্জিত হয়ে স্বামীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন।
এবারও ব্যর্থ হয়ে ইবলীস শয়তান ভাবতে লাগল, আসলে তারই ভুল হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত রহিমাকে চিনেও তার হুশ হল না রহিমার মত মেয়ের কাছে কেন শরাব আর শুকরের বলে “মানুষের ভুল আছে শয়তানের ভুল হয় না।” কিন্তু দেখা গেল শয়তানেরও ভুল হয়।

********দুর্লভ আত্মত্যাগ******

আজ প্রায় পাঁচ ছয় দিন পর্যন্ত রহিমা স্বামীকে নিয়ে অনাহারে কাটাচ্ছেন। শুধু পানি পান করেই তাঁরা জীবন ধারণ করছেন। কিন্তু ক্ষুধার্ত স্বামীর মুখের দিকে রহিমা আর তাকাতে পারেন না। তাই ভোরে উঠে কিছুক্ষণ স্বামীর দেহের পোকা বেছে দিয়ে স্বামীর কাছে অনুমতি নিয়ে অন্ন সংস্থানের জন্য আবার দূরবর্তী গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। পথ চলতে চলতে তিনি ভাবতে লাগলেন, হায়রে অদৃষ্ট! স্বামীর এমন কঠিন রোগ, অথচ সারা দিন স্বামীকে এ লোকজন হীন অরণ্য ভূমিতে একা ফেলে আমাকে অন্নের সংস্থানের জন্য আমে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হয়।

স্বামীর কাছে থেকে যে তার সেবা করব এমন ভাগ্যও আমার নেই। পরম প্রভুর কাছে তিনি প্রার্থনা জানান, মা’বুদ! আপনি তো সবই দেখেছেন, প্রভু! আমার অবর্তমানে প্রাণের প্রিয় স্বামীর যেন কোন বিপদ না ঘটে। তিনি আল্লাহর কাছে আরও প্রার্থনা করতে লাগলেন, মাবু’দ! হে দয়াময় প্রভু! আপনি স্বামীর রোগ আমাকে দিয়ে আমার স্বামীকে
রোগ মুক্ত করে দিন।

image

কিন্তু এ প্রার্থনা করে তিনি আবার ভাবলেন, যদি আমি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি তবে তো আমি স্বামীর উপরেই বোঝা হয়ে পড়ব। স্বামীকেই তখন আবার খিদমত করতে হবে। স্ত্রী হয়ে স্বামীর পরিচর্চা গ্রহণ করব। এটা যে আরও অন্যায়। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি গ্রামে এসে পৌঁছলেন। গ্রামে এসে তিনি এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি এমনি করে এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরতে লাগলেন ।

কিন্তু কোন বাড়িতে খাবার চাইলে বলে, এমন রমণীকে সাহায্য করলে পূণ্যের বদলে পাপের পরিমাণই বৃদ্ধি পাবে। কাজ করে খেতে পার না? আর কাজের কথা বললে বলে যে, না আমরা এমন গ্রামে গ্রামে বিচরণকারী মেয়েদের দ্বারা কাজ করাব না। এতে ঘরের পুরুষ নষ্ট হয়ে যায় ।

গৃহিণীদের এমন ঘূর্ণিত কুৎসিত ইঙ্গিতে রহিমার লজ্জা হল। তবে লজ্জা ঘৃণা করে স্বামীর জন্য অন্ন সংস্থানের জন্য এক এক করে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরের দ্বারেই ধর্ণা দিয়ে দেখলেন। কিন্তু গ্রামের লোকগণের হৃদয় এতই কঠিন যে কেউই না। চার পাঁচ দিনের অভুক্ত মানুষ সারাদিন ধরে এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। মাথার ভিতরে চরকার মত ঘুরপাক খেতে লাগল।

তাই অবসাদ ক্লান্তিতে পথের পাশে বসে পড়লেন। আর মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলেন। পরম প্রভু
প্রিয় মা’বুদের কাছে বললেন, মা বুদ! এভাবে শূন্য হাতে স্বামীর কাছে কিরূপে ফিরে যাব। কি দিয়ে স্বামীর ক্ষুধা নিবৃত্ত করব। প্রভু! আপনি যদি মানুষের জন্য মানুষের গোশত হালাল করতেন, তবে আমার দেহের গোশত কেটে স্বামীকে খাইয়ে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করতাম।

আমার দেহের গোশতের বদলে যদি কেউ কিছু খাবার দিত? তবু এ স্বামীকে খাওয়াতে পারতাম। পথের পাশে বসে হযরত রহিমা যখন ভাবছিলেন কি করে তিনি তাঁর রোগাক্রান্ত স্বামীর জন্য অন্নের সংস্থান করবেন। তখন সে সময় অন্যদিকে ইবলীস নতুন এক দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হয়ে ভাবতে লাগল, কোন রকমেই তো এ নর-নারী দুই জনকে জব্দ করা যাচ্ছে না, কি করা যায় এখন?

আইউবকে কুন্ঠের মত মহাব্যাধিতে আক্রান্ত করেও লাভ হচ্ছে না । তবে যদি রহিমাকে এরূপ মহাব্যাধিতে আক্রান্ত করা যায় তা হলে হয়ত এদেরকে জব্দ করা যাবে। এখন কৌশল করে রহিমার শরীরে একটা জখম করতে হবে তা হলে তার জখমের স্থান দিয়ে রক্তের সাথে আইউবের রোগ জীবাণু মিলিত হয়ে রহিমাকে এরূপ মহাব্যাধিতে আক্রান্ত করে ফেলবে।

পাপীষ্ঠ ইবলীস রহিমার রক্তের সাথে হযরত আইউব (আঃ)-এর কুষ্ঠ রোগের জীবাণু মিশিয়ে দেয়ার দুরভিসন্ধি করে সে একজন ধার্মিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে ঐ গ্রামের এক বৃদ্ধা রমণীকে বলল, তুমি যদি পথের পাশে উপবিষ্টা ঐস্ত্রীলোকটির দেহ থেকে এক টুকরা গোশত এনে শুকিয়ে রাখতে পার, তবে সে শুকনা গোশত ভিজানো পানি খাইয়ে যেই কোন ভূত প্রেত ও জিনের আছরগ্রস্ত রোগীর আছর তাড়াতে সক্ষম হবে ।

গিয়ে দেখ কোন কিছু দেয়ার বিনিময়ে স্ত্রীলোকটির কাছ থেকে এক খণ্ড গোশত আনতে পার কি না। ধার্মিক রূপী ইবলীসের কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বৃদ্ধা তখনই রহিমার কাছে এসে উপস্থিত হল। নানান প্রলোভনের মাধ্যমে শরীর থেকে এক টুকরা গোশত দিলে তার বিনিময়ে তাঁর দেহের গোশত ছাড়া বৃদ্ধা খাবার দিতে রাজী নয় । তাই ক্ষুধার্থ স্বামীর কথা ভেবে তিনি বললেন, আচ্ছা মা! নিন!

আমার বুকের গোশত কেটে নিন’ বৃদ্ধা তার কাপড়ের ভিতরে একখানা ধারাল ছুরি নিয়েই রহিমার বক্ষ থেকে এক টুকরা গোশত কেটে নিল, যন্ত্রণায় রহিমা ছটফট করতে থাকেন। তাঁর বক্ষ থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বের হল। তিনি দুই হাতে বুকের কাটা স্থান চেপে ধরলেন। বৃদ্ধা একটা পাতার রস বুকের কাটা স্থানে লাগিয়ে দিল। তাতে যখমের রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হল এবং যন্ত্রণাও অনেককমে গেল ।

এরপর বৃদ্ধা রহিমার কাছে কিছু খাবার এনে দিল। খাবার পেয়ে দুর্বল শরীরেও তিনি দ্রুত বেগে স্বামীর কাছে ছুটিতে লাগলেন। রহিমা যখন স্বামীর কাছে এসে পৌছলেন তখন রাত হয়ে গিয়েছে। স্বামী তখন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে বলছেন, মাবুদ! হে দয়াময় প্রভু!আমাকে পরীক্ষা করছেন ? আমি জানি, তুমি আমার সব, আমার বন্ধু। তোমার লক্ষ্যই আমার হিত সাধন।

com-islamicstory-Jannatiromoniislamicstory-1

তুমি যা কর তা আমার জন্যই কর । কিন্তু প্রভু! তোমার কাছে আমার এতটুকু অনুরোধ, রহিমা দুর্বল নারী। তার প্রতি আপনার পরীক্ষার চাপ যেন তত কঠিন না হয়। আমার মনে আশঙ্কা জেগেছে, যদি সে ভুল করে বসে, যদি সে কুল হারিয়ে ফেলে, তবে যে আমার সকলই ব্যর্থ। প্রভু! তোমার করুণার দৃষ্টি সর্বদা বজায় রাখ ।

বিপদে আপদে সর্বাবস্থায় তার হৃদয়ে শক্তি দান কর। রহিমা নীরবে দাঁড়িয়ে স্বামীর প্রার্থনা শুনলেন । স্বামীর প্রার্থনা সমাপ্তির পর রহিমা তার পদধূলি গ্রহণ করে বলেন, প্রিয়তম স্বামী! আজ আসতে খুব বিলম্ব হয়ে গিয়েছে। আমার এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধ মার্জনা করুন। এরপর নিজের বুকের
গোশতের বিনিময়ে সংগ্রহকৃত খাবার স্বামীকে খেতে দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *