জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব : ৪

*******ইবলীসের হিংসা******

হযরত আইউব (আঃ)-এর পত্নীগণের মাঝে এমন মধুর সম্পর্ক যেন ইবলীসের আগুন জ্বালিয়ে দিল। দিনরাত ইবলীস শুধু সুযোগ খুঁজতে লাগল কেমন একদিন হযরত আইউব (আঃ) বড় বেগমে চারিতার কথা প্রসঙ্গে অন্য দিনের মত করে জিজ্ঞাসা করেন, রহিমার গুণের কথা আমি যা বলি গমগণ উত্তর দিলেন, আপনি ঠিকই সত্যিই আমরা রহিমার মত নারীকে আমাদের মাঝে পেয়ে গর্ববোধ করছি। কিন্তু বেগম স্বামীর কথায় কেমন যেন বিরক্তবোধ করেন।

বড় বেগম বিরক্ত হয়ে ভাবতে থাকেন, স্বামীতো প্রকাশ্যে আমাদের খুবই ভালবাসা দেখান এবং আদর যত্নও করেন। কিন্তু মুখে যে সারাদিন শুধু রহিমার প্রশংসা শুধু রহিমারই গুণের কারও প্রশংসা তো তাঁর মুখে কখনও শোনা যায়  না আমাদের আর ভিতর কি তিনি কখনও কোন গুণই দেখতে পান না। আমাদের কি কোনই গুণ নেই। মনে তিনি এসব চিন্তা করলেও মুখে কিছুই বলেন না।

শুধু মুখ ভার করে থাকেন। কিন্তু হযরত আইউব (আঃ) নেহায়েত সরল প্রকৃতির মানুষ বলে বড় বেগমের মনের ভাব বুঝতে এ সুযোগটা ইবলীসের দৃষ্টি এড়াল না, ইবলীস এতদিন এ সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। এবার যেন তার সুযোগ পেয়ে যায়। ইবলিশ মানুষের চির শত্রু। সে মানুষের ভাল দেখতে পারে না। পরদিন দুপুর।

হযরত আইউব (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠা বেগমগণ দুপুর কালীন ইবাদতের পর আহারাদি সমাপ্ত করে আপনাপন কক্ষে বিশ্রাম করছেন। আর রহিমা তখন এবং তাঁর সেবায় রত আছেন। রাজপ্রসাদ প্রত্যহই এ দ্বিপ্রহরের সময় কিছুটা নীরব ও শান্ত থাকে। এ সময়ে প্রায় সকলেই বিশ্রাম গ্রহণ করে।

রক্ষীরাও এ সময় তাদের গ্রহরা কিছুটা শিথিল করে থাকে। ফলে বাইর থেকে লোকজন অনায়াসেই এ সময় ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। এ সময় সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত থাকে। এ সময় আউকেও ভিতরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয় না। এমনি সুযোগে ইবলীস এক বৃদ্ধ ভিখারিণীর বেশে সদর তোরণ অতিক্রম করে রাজপ্রাসাদে ঢুকে ধীরে পায়ে অন্দর মহলে প্রবেশ করে।

image

সামনেই একটি দাসীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার মা জননীরা কোথা বলে, তাঁরা এখন আরাম কক্ষে বিশ্রামে রয়েছেন। বৃদ্ধা রূপী ইবলীস বলেন, হায় পোড়া হলে এ সময় আসব কেন। কত আশা নিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করতে বলেন, ভিখারিণী কি চায়? দাসী বলল, বৃদ্ধা আপনাদের সাথে দেখা করতে চায়। বড় বেগম বলতা দাসী বলল, বেগম সাহেবা এক বৃদ্ধা ভিখারিণী।

বড় বেগম বলেন, বৃদ্ধাকে এখানে নিয়ে এস। দাসী ভিখারীনীকে বড় বেগমের কক্ষে নিয়ে আসে। বড় বেগমের কক্ষে প্রবেশ করেই বৃদ্ধা বড় বেগমকে সালাম জানিয়ে বলল, আম্মা। আজ আমার পাল। মনে মনে ভেবেছিলাম রাজ প্রাসাদে এসে যদি প্রথমেই আপনার মুখ দেখতে পাই তবে নিজেকে অসার্থক মনে করব।

ভিখারীর কথা শুনে বড় বেগম বলেন, কেন, বৃদ্ধপী ইবলীস বলল, আপনার তত্ত্বের সীমা নেই আম্মা! আপনার যে কত গুণ তা সবই বেশি জানেন আমাদের বাদশাহ। এ রাজত্ব এ ধন- সম্পদ আরাম-আয়েশ সব কিছুই তো আমাদের ভাগ্যেই জুটেছে। বেগম উত্তর করেন, এ তো তার কত গুণ তা সবচেয়ে বেশি জানেন আমাদের বাদশাহ। এ রাজত্ব, এ ধন-সম্পদ, ফল। বৃদ্ধারূপী ইবলীস এরূপ একটি মনমত কথাই আশা করেছিল।

তাই মনে মনে খুশিহয়ে অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল, কি বললেন আম্মা। গুণীর কদর হয় না? বড় বেগম এ কথার ভিক্ষার জন্য আমাকে বহু ধনী ও জ্ঞানী-গুণীগণের কাছে যাতায়াত করতে হয়। তাই অনেক কোন উত্তর দিলেন না। কিন্তু বৃদ্ধারূপী ইবলীস তাতে দমবে কেন? তাই আবার বলল, রীতিনীতি দেখে শুনে বহু শিক্ষা লাভ করেছি। দুনিয়া থেকে আসল ও গুণের কদর উঠে গিয়েছে।

এখন এখানে নকল আর মেকিরই রাজত্ব চলছে। সাধু সজ্জন লোকেরা বড়ই সরল। তারা অসৎ চতুর লোকের ছলনা বুঝতে পারে না। আপনার ঘরেও সে ছলনা প্রবেশ করেছে। আপনার স্বামী সোনার মানুষ। তার মত সরল ভাল মানুষ দুনিয়ায় আর নেই। তিনি নিজের মতই সকলকে ভাবেন। তিনি নকলকে আসল ভেবেছেন বলেই এরূপ ঘটছে। বৃদ্ধা কথাগুলো যেন বড় বেগমের মনের কথাই।

image

কথাগুলো ভালই লাগে তাই তিনি বলেন, কিন্তুএখন উপায় কি বল! বৃদ্ধার বলল, বাদশাহর মুখে দিন-রাত শুধু রহিমার গুণ বর্ণনা। কেন, আর বেগমগণের কি কিছুই নেই। আম্মা! সব কিছুই ঐ ছলনাময়ী ডাইনী মেয়েটারই কীর্তি। স্বামীকে সেবা যত্নের ভান দেখিয়ে মন জয় করেই এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

আম্মা! আপনার জন্য এর ফল খুবই অশুভ। শুধু আপনার নয়, আপনার আরও যে দুটি হতভাগিনী। আছেন তাদের অবস্থাও আপনারই মতই। আপনাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নষ্ট করার জন্যই এমন ছলাকলা করছে। বাদশাহ যাতে আপনাদের সন্তানগণকে কোন সম্পত্তি দিয়ে না যান তার জন্য স্বামীকে এভাবে মজিয়ে ভুলিয়ে রাখছে যেন বাদশাহ সকল কিছু তাকেই দিয়ে যান।

রহিমা শুধু নিজের স্বার্থের জন্যই এমন গুণপনা এবং ভালমানুষী দেখাচ্ছে। নিজের স্বার্থছাড়া সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সে কিছুই করছে না বুঝলেন তো আম্মা । বড় বেগম বলেন, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু স্বামীকে এসব কথা বুঝাব কেমন করে।

স্বামীর মনের মাঝে রহিমা এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে তাঁকে এসব কথা সরাসরি বললে তিনি হয়তঃ বিশ্বাসই করবেন না। বড় বেগম আর বৃদ্ধার কথাপকথনের মাঝেই সেখানে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বেগম এসে উপস্থিত হয়ে বলেন, বোন! এ বৃদ্ধার সাথে আপনি কিসের আলাপ করছেন?

বড় বেগম তখন সকল কথা তাদের কাছে খুলে বলেন। সব কথা শুনে তারা বুঝলেন বৃদ্ধা তাদের কষ্ট বুঝতে পেরেছে। তাই হয়তঃ হিতাকাঙ্ক্ষীরূপে তাদেরকে সৎ পরামর্শ দান করেছে। বৃদ্ধা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আম্মা আমি ভিখারিণী মানুষ। আপনারা রাজরাণী আপনাদেরকে আমি আর কি বুদ্ধি দিব। তবে একটি কথা মনে রাখবেন, আপনা দের মধ্যে কেউটে প্রবেশ করছে।

তাই সাবধানে থাকবেন। আপনারা বড় ঘরের বড় জনের কন্যা । তাই বড় মন নিয়ে সবাইকে দেখেন, কিন্তু আপনাদের বড় মনের সুযোগে ছোট মনের লোকেরা আপনাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত নষ্ট করার দুরাশায় মেতে উঠেছে কিন্তু বেশি বাড়তে দিবেন না।

যে যেমন তার সাথে ঠিক তেমনি ব্যবহার করবেন। আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করলাম এখন যাই আম্মা! বৃদ্ধা ভিখারিনী উঠে দাঁড়াতেই বড় বেগম তার হাতে কয়েকটি মুদ্রা গুজে দেন। কিন্তু বৃদ্ধা রূপী ইবলীস বলল, আম্মা! আমি ভিখারিণী হলেও এমন ছোট জাতের লোক নই ।

সবার কাছ থেকে কি ভিক্ষা নিতে হয়। মুদ্রা  রেখে বৃদ্ধারূপী ইবলীস কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। বৃদ্ধা এরূপ লোভ সংবরণ করতে এতক্ষণ সময় নষ্ট করে আলাপ করেছেন তাইতো আমার বড় ভিক্ষা। কথাগুলো বলে খুবই বুদ্ধিমতী এবং তাদের নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্ক্ষীনী।

বৃদ্ধারূপী ইবলীস রাজপ্রসাদে থেকে বের দেখে বেগমগণ বিশ্বিতা হয়ে গেলেন। তারা বিশ্বাস করলেন যে, বৃদ্ধা ভিখারিণী হলেও হয়ে গেল বটে, তবে রহিমার সপত্নীগণের মনে যে কুমন্ত্রণা দিয়ে গেল, তারই জন্য এখন তাঁরা রহিমাকে তাদের চরম শত্রু ভাবতে থাকেন।

তারা রহিমাকে ছোট বোনের মত ভালবাসতেন অথচ এখন তাকে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই যেন খুশি হন। তাঁরা প্রতি কথায়, কাজে ও ব্যবহারে এমন কি দাস-দাসী দ্বারা প্রতি মুহূর্তেই রহিমাকে অতিষ্ঠ করে তুলতে থাকে। এমনকি হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছেও তাঁর বিরুদ্ধে নানাবিধ দোষারোপ করে অভিযোগ করেন।

কিন্তু হযরত আইউব (আঃ) অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে সব বিষয় পরীক্ষা করে বুঝেন, রহিয়া একেবারে নির্দোষ বরং তাঁর স্বপত্নীগণই দোষী, তাঁরাই অন্যায়ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। হযরত আইউব (আঃ) তাঁর জ্যেষ্ঠা পত্নীগণের এ অন্যায় ও অপরাধের জন্য তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন ঠিক করলেন কিন্তু তাদেরকে শাস্তি দিবার পূর্বেই রহিমা স্বামীর ইচ্ছার কথা জানতে পেরে স্বামীর দু পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেন, প্রিয়তম স্বামী! যত কঠিন শাস্তি, যত কঠিনদণ্ড দিতে হয় আমাকে দিন। আপনাকে আল্লাহর শপথ দিয়ে অনুরোধ করছি আপনার বড় পত্নীগণকে আপনি ক্ষমা করে দিন!

হযরত আইউব (আঃ)বলেন, রহিমা। তারা তো মহা অপরাধে অপরাধী, তাদেরকে তো ক্ষমা করা যায় না। রহিমা স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে চোখের অশ্রু ফেলে মিনতি করে বলেন, আমি তাঁদের পক্ষ প্রতিশ্রুতি দান করছি, তারা আর কখনও অপরাধ করবেন না। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। এরূপ কান্না এবং আকুল মিনতিতে হযরত আইউব (আঃ)-এর মন নরম হয়ে এল।

তিনি মনে মনে বলেন, হায়রে নিষ্পাপ রহিমা! তুমি জান্নাতের পবিত্র ফুলের মত অনুপম ও সুন্দর। জানিনা কোন মহাপুণ্যের ফলে আল্লাহ্ তোমার মত মহৎ নারী রত্নকে আমায় দান করেছেন। মনে মনে এ সকল কথা ভেবে হযরত আইউব (আঃ) রহিমাকে বলেন, রহিমা আজ তোমার শত্রুগণকে তোমারই অনুরোধে আমি ক্ষমা করলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করলে আর ক্ষমা করা হবে না।

bidobha-20210308160024

রহিমার সপত্নীগণ যখন দেখেন, তারা যাকে শত্রু মনে করেছেন সে রহিমাই তাদের জন্য স্বামীর কাছে মাফ চেয়েছেন। এ ঘটনায় রহিমার সপত্নীগণ অত্যন্ত লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হয়ে স্বামী এবং রহিমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনও এরূপ অপরাধ করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। এতে ইবলীস অত্যন্ত নিরুৎসাহ হয়ে পড়ল।

ইবলীস ভেবেছিল, রহিমাকে সপত্নী সমস্যায় জর্জরিত করে অতি সহজেই আল্লাহর পথ থেকে বিমুখ করতে পারবে। কিন্তু তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ইবলীস খুবই ভাবনায় পড়ল। কিন্তু যেহেতু ইবলীস দমবার পাত্র নয়। তা নাহলে তার নাম ইবলিস কেন ? তাই সে আবার নতুন বুদ্ধি করে হযরত আইউব (আঃ) ও রহিমার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *