জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব : ৫

জান্নাতি রমনি রহিমা 

এত কঠিন পরীক্ষার আইউব (আঃ)  এবং রহিমাকে আল্লাহর রাস্তাচ্যুত করতে না পেরে কুচক্রী উদ্বৃত্ত হয়ে উঠল। মনে মনে বলল, কত আদম সন্তান ধ্বংস করে। কে দেখেই নিতে হবে। প্রয়োজন হলে সময় সিরিয়া রাজ্যে প্রণয়কা সব মিসমার করে দিব। যেমন করেই হোক এ দুটি রচ্যুত করব। কুইবলীস হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমার হযয়ত আইউব (আঃ) তাঁর রাজ দরবারে সভাসদ ও অমাতাগণ বসে আছেন।

দরবারের এ কর্মব্যস্ত অবস্থা মধ্যে দেখা গেল, হঠাৎ সে দরবারের দিকে ছুটে আসছে। তারা দরবারে উপস্থিত হয়ে করে অত্যন্ত ভাবে বলল, সম্মানিত বাদশাহ! আমরা এক মর্মান্তিক করে এনেছি। হযরত আইউব (আঃ) বললেন, বল, তোমরা কি মর্মান্তিক এনেছ। নিত্যদিনের মত আমরা প্রাতকালে পশুপাল নিয়ে ক্ষেত খামারে দেখলাম। হঠাৎ দেখলাম, আকাশের এক কোণ থেকে একটি বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের ন্যায় হয়ে এক তীব্র অগ্নিশিখা আমাদের দিকে ছুটে এল। আমরা ছুটে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলাম।

image

কিন্তু খেতখামারে এবং পশুশালায় যত পশু ছিল সকলই সে লেলিহান অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কথাগুলো বলেই রাখালগণ কাঁদতে আরম্ভ করে। এ মর্মান্তিক এবং শুনে হযরত আইউব (আঃ)-এর ভিতর কোন বেদনার চিহ্ন দেখা গেল না বরং তিনি সহাস্য বদনে বলেন, আল্লাহ্ যা করেন তা আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। হয়ত এ পশুকুল সের ভিতরও কোন মঙ্গল নিহিত আছে।

তাছাড়া পশুগুলোর মালিক তো আল্লাহ আল্লাহই আমাকে তা দান করে ছিলেন আমি তো কয়েক দিনের রক্ষক ছিলাম মাত্র। আল্লাহ যদি নিজের মান নিজে ফিরিয়ে নিয়ে থাকেন তাতো আনন্দের কথা। আল্লাহ অনেক সময় সামাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি ধন-দৌলত দিয়ে দেখেন যে, বান্দা তাকে ভালবাসে না ধন-দৌলতের মহব্বতেই বিভোর হয়ে থাকে।

আল্লাহর এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারে তাঁরাই তাঁর প্রিয় বান্দা। আমাদের জন্য এটাই হয়ত আল্লাহর একটি পরীক্ষা! আমরা যদি এর জন্য দুঃখ না করে বরং ধৈর্যধারণ করি তাহলে আল্লাহ্ আমাদেরকে এর
প্রতিফল দান করবেন। ইবলীসের ধারাণা ছিল, হযরত আইউব (আঃ)-এর পশুকুলকে বিনাশে তার মনে আল্লাহর প্রতি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত ভাব সৃষ্টি করে তাঁকে বিপথে চালিত করতে পারবে। কিন্তু কিছুই হল না।

এবারও ব্যর্থ হল ইবলীস এবং হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমা পূর্বের এর আরও অধিক মাত্রায় আলাদা বাদত করতে লাগলেন।
******মহাবিপর্যয়******
ইবলিশ বার বার ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি বরণ করে প্রতিহিংসা আরো তীব্র আকার ধারণ করল। তাই এবার পণ করে সমগ্র শামদেশে দুর্যোগ সৃষ্টি ইবলীস মনে মনে ভাবে, যদি দেশে শস্য এবং ফলের বাগিচা ধ্বংস করা যায় তাহলে সারাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে এবং প্রজাগণ খাদ্যাভাবে বাদশাহকে অস্থির করে তুলবে। হযরত আইউব তখন দিশেহারা হয়ে পড়বে সে সময় অতি সহজেই কাজ সমাধা করা যাবে।

একদিন অপরাহ্নে দেখা গেল, হঠাৎ ঘন কাল মেঘে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল এবং আবহাওয়া ভীষণ গরম হয়ে উঠল। অসহ্য গরমে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ল। আর এ সম দেশের এক প্রান্ত থেকে ভীষণ গর্জন করে সমুদ্রের জলরাশি উত্তাল তরঙ্গ বেগে চতুর্দি গ্লাবিত করে ছুটে আসছে।

দেখতে দেখতে উত্তাল জলের স্রোতে সারা দেশ প্লাবিত হয়ে গেল। দেশের মানুষ কোন রকমে উঁচু ঘরের ছাদে এবং পর্বত শৃঙ্গে আশ্রয় নিয়ে বাঁচাল। কিন্তু মানুষগণ প্রাণে বাঁচলেও দেশের সব সম্পদ একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেল। উত্তাল জলের স্রোতে দেশের সব পশু সমুদ্রে ভেসে গেল। সমগ্ৰ কাষ ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হয়ে। গেল। সব ফল-ফুলের গাছ উপড়ে পড়ে গেল।

মহাপ্লাবণের তাণ্ডবে সমগ্র শামদেশ এর বৎসজোপে পরিণত হল। মহাপ্লাবণে স্রোতে দেশের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে দেশকে নিয়ে পরিণত করে অবশেষে জলরাশি নেমে গেল বটে কিন্তু দেশের মানুষকে করে গেল রিজ সর্বস্ব হারা। সর্বস্ব হারিয়ে রিক্ত জনগণ উদভ্রান্তের মত বাদশাহ হযরত আইউব (আঃ)-এর দরবারে এসে উপস্থিত হল।

কান্নায় ভেঙে পড়ে তাদের দুঃখ দৈন্যের কথা বাদশাহর কাছে বর্ণনা করতে লাগল। ভয়ঙ্কর দুর্যোগে সর্বহারা জনগণের দুঃখের কথা শুনে হযরত আইউব (আঃ) তাদেরকে প্রবোধ দিয়ে বলেন, ভাইগণ তোমরা ধৈর্যধারণ কর। আল্লাহ সর্বদাই ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন। আল্লাহর আদেশ ব্যতিত দুনিয়ার একটি বৃক্ষপত্রও স্পন্দিত হয় না। ক্ষুদ্র সকল কাজই আল্লাহর ইচ্ছায় সাধিত হচ্ছে।

image

তোমাদের যে সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে ইচ্ছা করলে আল্লাহ্ তার শতগুণ আবার এখনি দান করতে পারেন। স্মরণ রেখ জীবসমূহের রিষকের মালিক আল্লাহ। জীবন সৃষ্টির পূর্বেই তিনি তার রিষকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কাজেই আমাদের ভাবনার কোন কারণ নেই। তোমরা যদি আল্লাহর ইবাদত দ্বারা আল্লাহকে খুশি রাখি তাহলে আল্লাহও তোমাদের খুশি রাখবেন। বিপদ দেখে তোমরা ঘাবড়াবে না।

তোমাদের বর্তমান কোন ভাবনা নেই। রাজভাণ্ডারে যে অফুরন্ত খাদ্য শস্য আছে তাতে আল্লাহর ইচ্ছায় দেশের সমস্ত লোকের একাধারে পাঁচ বছরের খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে এরপর হযরত আইউব (আঃ) দেশের প্রতি ঘরে ঘরে খাদ্যশস্য এবং নগদ অর্থ পৌঁছিয়ে দিলেন দেশের লোকের আর কষ্ট রইল না।

সবার মনে আবার সুখ-শান্তি ফিরে এল। হযরত আইউব (আঃ) এ মহা বিপদ কেটে উঠে আল্লাহর দরবারে সহস্র শোকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। মনের শান্তিতে হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমা আরো অধিকতর ভাবে আল্লাহর ইবাদতে ইবলীস ভেবেছিল বিপদাপন্ন সর্বহারা দেশবাসী হযরত আইউবকে চারদিক থেকে অন্ন বস্ত্রের তাড়নায় দিশেহারা বিব্রত করে তুলবে।

হযরত আইউব (আঃ) চারদিকে অন্ধকার দেখে দিশেহারা হয়ে মুষড়ে পড়ে আল্লাহর প্রতি বিরাগ হয়ে পড়বেন। কিন্তু হযরত আইউব তাঁর ব্যক্তিগত ধন-ভাণ্ডার এবং রাজভাণ্ডার থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও শস্য বিলিয়ে হয়ে উঠল। মনে মনে বলল, এবার দেখব তার অথ, ধন-রত্ন ও শস্যের জোর কত! এবার এ মহাবিপদ সামলে নিতে দেখে ইবলীস নিরাশ হয়ে পড়ল।

এরপর ইবলীস আরো মহা ঝড়ের প্রায় সৃষ্টি করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করে সারা দেশে মহাবিভীষিকা সৃষ্টি করে। আইউবের অহংকার চূর্ণ করব। যতদিন পর্যন্ত আইউব (আঃ) এবং রহিমাকে আল্লাহর পথ থেকে সরাতে না পারব ততদিন আমার এ কাজ চলতেই থাকবে। মহাপ্লাবনের মহা দুর্যোগে রাজ্যের প্রজাগণ স্বর্বস্বহারা হলেও আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত আইউব (আঃ) অতি সহজেই এ মহাবিপদ সামলে উঠেন।

বাদশাহর ভরণ-পোষণ সুষ্ঠু ব্যবস্থায় জন গণের মাঝে আবার শান্তি ফিরে আসে। রাজকীয় অর্থ দ্বারা দেশের সমস্ত ক্ষেত-খামারে আবার কৃষির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাকা ফসলের সোনালী আভায় ক্ষেত খামার জ্বল জ্বল করে। ভরা ফসলের মাঠ। দেখে কৃষকের মন ভরে উঠেছে।

কিছু দিনের মধ্যেই তারা পাকা ফসল কেটে ঘরে তুলবে। এ সময় হঠাৎ আকাশের উত্তর পূর্ব সীমান্তে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে এবং সহসা একখন্ড কাল মেষ উঠে ক্রমে সারা আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে। ঝড়ের সাথে মুষলধারায় বৃষ্টি এবং এপ্তর খণ্ডের ন্যায় শিলা পতন এবং তার সাথে মুহুর্মুহু প্রচণ্ড বজ্রের গর্জন এবং বিদ্যুৎস্ফুরণ চমা দেশ ব্যাপি মহা বিভীষিকার সৃষ্টি করল।

অমানিশার মত কাল অন্ধকার রাতে ঝড়ের এল্য তাণ্ডবে গৃহহারা মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ল। কেড গৃহের তলে চাপা পড়ে প্রাণ ত্যাগ করল, কেউ বৃক্ষের তলে পড়ে মৃত্যু বরণ করল। কত লোক যে ক্ষত বিক্ষত আহত হল, কারও হাত ভাঙল, কারও পা ভাঙল, কারও মাথা ফাটল। সমগ্র দেশ ব্যাপি মর্মান্তিক করুণ আর্তনাদের হাহাকার উঠল। হযরত আইউব (আঃ)-এর সুদৃঢ় রাজ-প্রাসাদও এ মহা ঝড়ের ভাঙব থেকে রক্ষা পেল না।

ঝড়ের তাণ্ডবে কোন ঘরের ছাদ কোন ঘরের দেয়াল প্রাচীর ধসে পড়ল। অন্তঃপুরের বিলাস বহুল কক্ষসমূহ ভেঙে চুরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সমগ্র দেশের বুকে মহা ঝড়ে তাণ্ডব ঘটিয়ে এবার ইবলীস মনে মনে ভাবতে থাকে নিশ্চয়ই সে আইউব এবং রহিমাকে জব্দ করতে পেরেছে।

image

এখন সহজেই তাদেরকে বশে আনতে পারবে। সমগ্র দেশের উপর যে মহাবিপদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এ মহাবিপদে আইউব কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারবে না। বিপদাপন্ন মানুষগণ যখন সাহায্যের জন্য ছুটে আসবে তখন হযরত আইউব ধৈর্য হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে এবং আল্লাহর প্রতি বিরূপ হয়ে পড়বে। এ মহাৰড়ে ধ্বংসলীলাকে আল্লাহর অবিচার ও অন্যায় বলে আল্লাহর সাথে রাগে অভিমানে আল্লাহর ইবাদত মন থেকে মুছে ফেলবে। ইবলীস মনে মনে এ সব জল্পনা-কল্পনা করে আত্ম-তুষ্টিতে তৃপ্তি ও আনন্দের হাসি হাসতে থাকে।

কিন্তু ইবলীস হযরত আইউব এবং রহিমাকে চিনতে পারে নি । কিন্তু তার চিনতেও বেশি দেরি হল না। ইবলীস নিরাশ হয়ে দেখল যে, আইউব রহিমাসহ অন্যান্য বেগম ও সন্তান সন্ততিগণকে নিয়ে একটি অর্ধ ভগ্ন কক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কায়মনো বাক্যে প্রভুর ইবাদতে নিজ দেহমনকে সপে দিচ্ছেন । তখন দেশের বিপদাপন্ন সর্বহারা লোকগণ এসে রাজপুরীর এ অবস্থা দেখে বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করা বৃথা ভেবে মনে মনে বাদশাহর প্রতি অভিশাপ দিতে দিতে চলে যায়।

তারা অনেকেই বলতে থাকে হযরত বাদশাহ কোন মারাত্মক অপরাধ করেছেন বলেই বারবার এ দেশে এরূপ বিপদ আসছে। তা না হলে এরূপ ঘটবে কেন? অতএব পাপী বাদশাহর কাছে।গিয়ে কোন লাভ নেই ভেবে তারা সবাই যে যার পথে ফিরে যায়। কিন্তু। (আঃ)-এর এতে সুবিধাই হয়। এত দিনকার ঝঞ্জাট থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি প্রার্থনা করে বলেন, হে মাবুদ, দয়াময় প্রভু।

আপনি আমাকে এত ধন-সম্পদ ও নিজকে সম্পূর্ণরূপে ন্যস্ত করতে পারিনি। এখন আপনি আমার দায়িত্ব উঠিয়ে নিন আমার মাথার উপর যে বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন এতে আপনার ইবাদত সহজ করে দিন। এখন আমি মন প্রাণ দিয়ে আপনাকে ডাকতে পারব। হে প্রভু রাজত্ব, ঐশ্বর্য, যশঃ গৌরব কোন কিছুরই প্রত্যাশা নেই।

আয় মাবুদ আপনার কাছে করছি, যেন বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় আপনাকে ডাকার প্রবৃত্তি থাকে, আমাকে এ প্রবৃওি দান করুন। এটাই আমার প্রধান সম্পদ। আল্লাহর কাছে হযরত আইডব (আঃ)-এর এরূপ প্রার্থনা করতে শুনে এবং রহিমার ইবাদত দৃশ্য দেখে ইবলীস ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং হয়ে পাপাত্মা ইবলীস মনে শুনে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থে আবার পরিকল্পনার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *