জান্নাতি রমনি রহিমা
******পুত্র কন্যার অপমৃত্যু*******
হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমার উঁচু স্তক অবনত করার জন্য এবার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এক নির্মম আঘাত হাবার পরিকল্পনা করে। মনে মনে বলে, এর তাদের উঁচু মস্তক অবনত করেই ছাড়ব। দেখব আইউব ও রাহিমার দৈর্যের আল্লাহ্ সীমা কতদূর। এবার নিশ্চয়ই তাদের দন্ত চূর্ণ হবে।
আইউব (আঃ)-এর পত্নীত্রয়ের গর্ভে সাত পুত্র তিন কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এরপর রাহিনাও কতিপয় সন্তান প্রসব করে ছিলেন। পাপাত্মা ইবলীস এবার পণ করে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে হত্যা করবে। তা হলেই আইউব ও রহিমার ধৈর্য নষ্ট করে আল্লাহর পথ হতে দূরে সরিয়ে নিতে পারবে।
এরপর এক রাতে হযরত আইউব (আঃ) যে বৃহৎ অর্ধভগ্ন কক্ষটিতে পরিবার পরিজন সহ বসবাস করছিলেন তার এক প্রান্তে হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমা আল্লাহর গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। রাতের নিদ্রা ত্যাগ করে সারা রাত আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। তখন কক্ষের অন্য পাশে রহিমার সপত্নীত্রয় শায়িতা ছিলেন এবং আর এক পার্শ্বে নিদ্রামগ্ন ছিলেন। তাদের পুত্র কন্যাগণ ।
আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দা হযরত আইউব (আঃ)-এর অতি আদরের ভালবাসার হৃদয়ের ধন, নয়নের মণি নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক সন্তানগণ নির্ভয়ে নিশ্চিন্তায় নিদ্রার কোলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তারা ভাবতেও পারতেন না যে, এ নিদ্রাই তাদের চিরনিদ্রা। এ নিন্য থেকে তারা আর জেগে উঠবে না। তাদের জনক জননী কল্পনাও করতে পারেন নি যে, তাদের স্নেহের ধন কলিজার টুকরাদের জীবনের চরম শেষ মুহূর্তটি ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তাই ঘটল।
রাত দ্বিপ্রহরে পাপীষ্ঠ ইবলীসের হিংস্র ছোবলে কক্ষের যেই পাশে পুত্র কন্যাগণ ঘুমিয়েছিল সেদিকের বিরাট দেয়াল তাদের উপর ধ্বসে পড়ল। দেয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর পূর্বে তারা শুধু হৃদয় বিদারক করুণ আর্তনাদ করে উঠল। এরপর সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সন্তানগণ সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রহিমার সপত্নীগণ দেয়াল ধ্বসার শব্দ এবং সন্তানগণের করুণ আর্তনাদ শুনে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠলেন।
এমন নির্মম হৃদয় বিদারক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে তারা তিনজনই অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। অন্য সব কক্ষ থেকে দাস দাসীগণ এবং দ্বারী, রক্ষীগণ যে যেখানে ছিল তারা সকলেই ছুটে এল এবং মর্মভেদী বিলাপ করে তারা ক্রন্দন করতে লাগল। কিন্তু হযরত আইউব (আঃ) ও রহিমা আল্লাহর ধ্যানে মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য দর্শন করে এতটুকু বিচলিত না হয়ে কোন দুঃখও করলেন না বরং হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমার গভীর ধ্যান ভঙ্গ হল।
কিন্তু তাঁরা তাঁদের সন্তানদের এমন হযরত আইউব (আঃ) বলেন, আল্লাহ্ যাতে সন্তুষ্ট আমিও তাতে সন্তুষ্ট। আল্লাহ্ যা করেন তা মঙ্গলের জন্য করেন। রহিমা বলেন, আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জ্ঞাপন করেছি। এতদিন এ সন্তানদের প্রতিপালনের দায়িত্ব ছিল এ অযোগ্য নারীর উপর।
আর এখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ স্বয়ং। নিজের কুদবর্তী হাতে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তা অপেক্ষা আনন্দের কথা আমার জন্য আর কি হতে পারে। এ কথা বলেই তিনি আল্লাহর দরবারে দুটি শোকরিয়া সিজদাহ করেন। বহিমা প্রিয় মাবুদের কাছে মুনাজাত করে বলেন, হে দয়াময় প্রভৃ! এতদিন আমি সন্তানদের আদর যত্ন এবং লালন পালনে অনেক সময় ব্যয় করেছি। এখন আমি সে সময় আপনার ইবাদতে এবং প্রাণ প্রতিম স্বামীর সেবায় লাগাতে চাই। প্রভু! আপনি আমার সহায় থাকুন ।
সন্তানদের মায়ায় একটি দিনের জন্যও হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমার মনে সামান্যতম বিশাদের ছায়া দেখা গেলনা বরং তাদের উভয়কেই যেন পূর্বের চেয়ে অধিক নিশ্চিন্ত এবং প্রযুর দেখা গেল। তারাই এখন পূর্ব অপেক্ষা আরো অধিক নিশ্চিন্তে এবং মুক্তমনে আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন।
******এবার বিদায়ের পালা*******
হযরত আইউব (আঃ)-এর এতগুলো সন্তানের একসাথে প্রাণ বিয়োগে ইবলীস ভেবেছিল স্বামী-স্ত্রী দিশেহারা উন্মাদ হয়ে পড়বে। আল্লাহর ধ্যান, ইবাদত, বিসর্জন দিয়ে তাঁরাই আল্লাহর প্রতি অকথ্য গালি বর্ষণ করতে থাকবে। কিন্তু ইবলীস যা ভেবে ছিল তার কিছুই হল না। তারা তাদের প্রাণের পুতুলি সন্তানদের হারিয়ে এতটুকু মাত্র দুঃখিত হল না। বরং বিগুণ উৎসাহে তারা আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হল।
বার বার ব্যর্থ হয়ে ইবলীস ভাবতে লাগল, যে মাটির তৈরি আদমকে আমি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। সে মাটির তৈরি মানুষের কাছে কি শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতে হবে? মাটির তৈরি আইউব ও রহিমার কাছে পরাজিত হলে আমার বড় মুখ থাকবে কোথায়? না, পরাজয় কাকে বলে ইবলীস তা জানে
না। মাটির তৈরি হযরত আইউব এবং রহিমাকে জব্দ করতে হবে।
আল্লাহর প্রিয় বান্দার নন্তর থেকে হযরত আইউব নবীর নাম কাটাতে হবে। ইবলীস আবার নতুন পরিকল্পনা করল। ইবলীস ভাবল, আইউব ও রহিমাকে তাঁদের সভাসদ, অমাত্য, রাজকর্মচারী, সৈন্য সামন্ত এবং দাস-দাসীগণ এখনও ঘিরে আছে বলেই।
তাঁদের শোকতাপ ও বিযোগ যাতনা তাদেরকে যেন শোকাহত করতে পারছে না দিনরাত লোকজনের মাঝে পরিবেষ্টিত থেকে কাজে কর্মে ব্যস্ত থেকে সকল ধ্বংস ও বেদনা রাশিকে তারা ভুলতে সক্ষম হয়েছে। যদি লোকজনকে তাদের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তবেই তারা নিঃসঙ্গ হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে। তখন সহজেই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা যাবে। আল্লাহ ইবলীসকে প্রচুর শক্তি দান করেছেন।
সে শক্তির বলে ইবলীসের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। অতএব ইবলীস এবার তার শিষ্য সহযোগীদেরকে আদেশ করল। তোমরা আইউবের লোকজনকে তার কাছ থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টায় লেগে যাও। ইবলিশ সহচর এবার আইউবের পাএ মিএ,সভাসদ,সৈন্য সামন্ত, মনের ভিতর প্ররোচনায় করতে থাকে। এখনও তোমরা কিসের জন্য এখানে সময় নষ্ট করছ ? বাদশাহের কাছে তো এখন কোনো সম্পদ নেই। তোমরা বুঝছনা তোমাদের বাদশাহ নিশ্চয়ই কোন পাপ করেছে।
তা না হলে বার বার এমন কঠিন বিপদে পড়ে সর্বস্বান্ত হবে। এমন পাপীর কাছ থেকে তোমরা শীঘ্রই দূরে সরে যায় তোমরাও পাপের প্রভাবে মধ্বংস হয়ে যাবে। পাপাত্মা ইবলীসের চক্রান্তে অতি শীঘ্রই পৌষ প্রতারিত হয়ে পড়ল। একদিন বাদশাহ আইউব নবীর যে সমস্ত পারিষদ ও তাঁর একান্ত বিশ্বাসী এবং বাধ্যগত ছিল, হযরত আইউবের দরবার ও তাঁর সান্নিধ্য ছাড়া যাদের এক মুহূর্তে চলত না, যে সকল রাজকর্মচারী ও সৈন্য সামন্তগণ হযরত আইউবের একটি নির্দেশ পালনের কথা উন্মুখ হয়ে থাকত এবং তাঁর আদেশ মেনে নিজে দেরকে সৌভাগ্যবান মনে করত। যে সমস্ত দাসী চাকরাণীগণ রহিমার সান্নিধ্য লাভ করে আছেন।
পালন করে জীবন সার্থক ভাবত, তারা সকলেই আজ বাদশাহ আইউব নবী এবং শতমসূঃসময়ে তাদেরকে ফেলে একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যে বাদশাহর সংবারে, বিমান পণ্ডিত বিরাজ করে রাজ দরবারে শোভা বর্ধন করত, তারা আজ আর কেউই দেই। লোকে লোকারণ্য রাজ দরবার আজ জন শূন্য, খাঁ খাঁ করছে। পুত্র-কন্যা সঙ্গীহারা বাদশাহ আইউব (আঃ) এবার সম্পূরণরূপে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। ইকাত বন্ধেী করা কারও পক্ষেই সম্ভব হত না।
কিন্তু হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমাকে আল্লাহ তায়ালা অতি অদ্ভুত শক্তি দান করেছেন। ইবলীস বার বার বিপদের উপর দিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত সর্বহারায় পরিণত করেছে। কিন্তু তবু তাঁরা সে পরম প্রভুপ্রিয় মানুষের দেয়া শক্তির বলে সব বিপদ পাস করে আল্লাহর ইবাদতে অটল ও অবিচল আকেন। যা তাদের আল্লাহ্ প্রেমের আদর্শ ধন্য তাঁদের আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের কিন্তু ইবলীস ব্যর্থ হয়ে আবারও নতুন পরিকল্পনা করতে লাগল। যেমন করেই হোক হযরত আইয়ুব ও রহিমাকে পরাজিত করতে হবে।