****মহা সংক্রামক ব্যাধির সৃষ্টি****
জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব
বার বার এত বিপদ, এত ক্ষতি, এত ধ্বংস এত শোক কিন্তু তারপরেও তাঁদের হৃদয় মাঝে অনাবিল আনন্দের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। প্রশান্ত হৃদয়ে তাঁরা আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন রয়েছেন। নিবিষ্টচিত্তে প্রিয় মা’বুদের ইবাদত বন্দেগী করছেন। পাপাত্মা ইবলীস সবই লক্ষ্য করছিল কিন্তু কোন কিছুতেই আইউব এবং রহিমাকে পথভ্রষ্ট করতে না পেরে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল।
একদিন রাতে হযরত আইউব (আঃ) তাঁর ভগ্নকক্ষের এক প্রান্তে বসে তাসবীহ পড়ছিলেন। রহিমা স্বামীর ও নিজের জন্য কিছু খাবার জোগাড়ে অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন। হায়রে অদৃষ্ট! যে রাজপুরী রাতেরবেলায় অসংখ্য ঝাড়, লণ্ঠন ও আকাশের তারকার ন্যায় অসংখ্য প্রদীপ মালার আলোতে দিবসের তারকার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তা এখন অন্ধকারে পরিণত হয়েছে।
আজ হযরত আইউব (আঃ)-এর কক্ষে একটি মৃত্তিকার চেরাগ মিটমিট করে জ্বলছে। তারই অস্পষ্ট আলোকে হযরত আইউব (আঃ) দেখেন, সাদা দিস্তারধারী ও ধবধবে শ্বেত বসনধারী একটি লোক এসে তাঁর কাছে বসল। আগন্তুক লোকটি হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছে তাঁর রাজ্যের এক প্রজা বলে নিজের পরিচয় দান করল। এরপর সে হযরত আইউব (আঃ)-এর সাথে একথা সেকথা আরম্ভ করে দিল।
হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছে এখন আর কোন লোক আসে না তাই অনেকদিন পর একটি লোক এল
বলে তিনি তার সাথে সুদীর্ঘ সময় ধরে কথাবার্তা বলেন। আসলে এ ব্যক্তিটি ছিল স্বয়ং ইবলীস। পাপীষ্ঠ ইবলীস কথায় কথায় ক্রমেই হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছে এগিয়ে বসেছিল। এরপর তার খুব নিকটবর্তী হয়ে এক সুযোগে হযরত আইউব (আঃ)-এর নাসিকার মধ্যে শ্বাসের সাথে বিষাক্ত কুন্ঠরোগের সংক্রামক জীবাণু ফুঁকে দিল।
এভাবে সে কু-উদ্দেশ্য • সাধন করে আলাপ শেষ করে হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়ল। কিন্তু হযরত আইউব (আঃ) কিছুই টের পেলেন না, কিছুই বুঝতে পারলেন না। রাতে হযরত আইউব (আঃ) এবং রহিমা কেউই নিদ্রা যান নি। আল্লাহর ইবাদত করতে করতে গভীর রাতে যখন অবসন্ন হয়ে পড়েন তখন উভয়ে শয্যার উপরে কিছুক্ষণের জন্য।বিশ্রাম করেন ।
আজও তেমনি ইবাদত করতে করতে তারা যখন কিছুটা অবসন্ন হয়ে পড়েন।তখন তাঁরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু বিছানায় শায়িত হলেন। তবে মনে মনে তখনও তারাতাসবীহ তিলাওয়াতে নিমগ্ন থাকেন। ঠিক এ সময় হঠাৎ হযরত আইউব (আঃ) তাঁর পদতলে একটি ফোস্কার মত দেখতে পেলেন। সেখানে ভীষণ বেদনা হতে থাকে। বেদনা ক্রমশই বাড়তে থাকে । ব্যথায় তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন।
তবে তিনি আল্লাহর ইবাদত বন্ধ করলেন না। একদিকে ভীষণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন অন্যদিকে প্রতিদিনের মত আল্লাহ ইবাদত করে চললেন। ভোরবেলা দেখা গেল ফোস্কাটি ভেঙে শ্বেত রস বের হচ্ছে।ব্যথা-বেদনা পূর্বাপেক্ষা আরো বেড়ে যায়। ক্রমশ সমস্ত শরীরে ব্যথা শুরু হয়। বিষাক্ত কুষ্ঠ রোগের বিষে সমস্ত শরীর জর্জরিত হয়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় হযরত আইউব (আঃ) ছটফট করতে থাকেন।
স্বামীর এরূপ অবস্থা দেখে পতিপ্রাণা স্ত্রীর হৃদয় হাহাকার করে উঠে। স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য তিনি আল্লাহ্র দরবারে দুই হাত তুলে বার বার মুনাজাত করতে থাকেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না! তাঁর ব্যাধি এবং অসহ্য যন্ত্রণা ক্রমশই বাড়তে থাকে। সারা দেহ ফুলে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এমন বিপদের দিনে একমাত্র রহিমা ছাড়া নবীর পাশে কেউই নেই । একা রহিমা জান প্রাণ উজাড় করে স্বামীর সেবা করছেন।
একদিকে রোগীকে সেবা শুশ্রূষা, অন্যদিকে তাঁর আহার যোগাড় এবং অন্যান্য গৃহস্থালী সকল কাজ কর্মই তাকেই করতে হয়। এমনি করে চিকিৎসাহীনভাবে দিন অতিবাহিত হতে থাকে, কিন্তু রোগীর কোন শুভ লক্ষণ দেখা যায় না বরং একের পর এক অশুভ লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে।
এক সময় কত চিকিৎসক আইউব নবীর রাজদরবারে দিনরাত থাকত! বাদশাহর জন্য একজন চিকিৎসক ডাকলে শত শত চিকিৎসক এসে উপস্থিত হত। যারা বাদশাহ আইউব নবীর রোগ চিকিৎসা করতে পেরে একদিন নিজেদেরকে ধন্য মনে করত। কিন্তু আজ আর তাদেরকে দেখা যাচ্ছে না।
এখন আর কেউ এ পথে আসে না। হায়রে, নির্মম পরিহাস। স্বামীর কষ্ট দেখে দুঃখে যন্ত্রণায় রহিমার বুক ভেঙে যেতে চায়, কিন্তু তিনি কি করবেন! তাই স্বামীর চিকিৎসার ভার আল্লাহ্ কুদরতী হাতে সোপর্দ করে তিনি মনে প্রাণে দিবা নিশি স্বামীর সেবা করতে থাকেন। স্বামীর রোগ যন্ত্রণা যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে রহিমার সেবা পরিচর্যাও ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল ।
তিনি নিজের আরাম নিদ্রা সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে রাত জেগে স্বামীর পাশে বসে স্বামীকে সেবা করেন, দিনের পর দিন এরূপ সীমাহীন কঠোর খাটনি, রাতের পর রাত অনিদ্রা, তার উপর অর্ধাহার, অনাহারে রহিমার শরীর একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু দেহ দুর্বল হলেও দেহের শক্তি না থাকলেও অফুরন্ত মনের শক্তির বলে দিবানিশি সারাক্ষণ রুগ্ন স্বামীর সেবা শুশ্রূষায় রত থাকেন।
আর হযরত আইউব (আঃ) এমন মারাত্মক অসহ্যকর রোগ যাতনায় ছটফট করতে থাকলেও আল্লাহ্র ইবাদতে বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি করলেন না। এরূপ অসহ্যকর রোগ যন্ত্রণার ভিতরেও আল্লাহ্র ইবাদতে আরও বেশি মনোযোগ হলেন। নবী তাঁর দেহের এ মহাসংক্রামক ব্যাধির বিনিময়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে বলেন, ইয়ামা’বুদ, হে দয়াময় প্রভু! আপনি যে আমাকে এ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত করেছেন, এটা আমার উপরে আপনার এক অমূল্য নিয়ামত ব্যতিত আর কিছু নয়।
যে দিন হতে আমি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছি, সেদিন থেকে আপনার প্রতি নির্ভরতা এবং শ্রদ্ধার সীমা আরো বেড়ে গিয়েছে।” যতই দিন যেতে থাকে হযরত আইউব (আঃ)-এর রোগ ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্রমে ক্রমে তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাংসপিণ্ডে পচন ধরে। সমস্ত শরীরের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পুজ এবং দূষিত রক্ত অবিরল ধারায় ঝরে পড়তে থাকে। তা থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
সে দুর্গন্ধে কোন মানুষতো এ পথে আসা দূরের কথা আকাশের পাখিরাও দূরে চলে যায়। কিন্তু স্বামীর দেহের এ দুর্গন্ধ রহিমার কাছে কোন দুর্গন্ধ বলে মনে হয় না।তিনি এটা অনুপম পবিত্র খোশবু বলে মনে করেন। তিনি দুই হাতে স্বামীর গলিত দেহের রক্ত ও পুজ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে থাকেন।
আর আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের কাছে স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য মুনাজাত করেন।বরং তিনি এটা অনুপম পবিত্র খোশবু বলে মনে করেন। তিনি দুই হাতে স্বামীর গলিত দেহের রক্ত ও পুজ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে থাকেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য মোনাজাত করেন।