জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব ; ১

জান্নাতি রমনি রহিমা পর্ব

রহিমা কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেন। দ্বিতীয়বার চাঁদ যেমন সুন্দর আকারে করে রূপে গুণে বিকশিত হয়ে ওঠেন। রহিমার সৌন্দর্যের ও গুণের আলোচনা এখন দেশের বুকে আস্তে আস্তে বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে তেমনি রহিমাও ক্রমশ যৌবনে পদার্প প্রতিটি ঘরে ঘরে শোনা যাচ্ছে। জনক-জননী এমন রূপবর্তী এবং পুণ্যবতী কন্যা লাভ করে আনন্দে তাদের হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে জনক-জননী এক দিকে যেমন রহিমার মত কন্যা লাভ করে আনন্দিত তেমনি বিবাহযোগ্যা কন্যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয়ে পড়েন।

রূপ-গুণ, চরিত্র-মাহাত্ম্যে মুগ্ধ হয়ে দেশ-বিদেশ থেকে বহু ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিগণ বিবাহের প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করেন। কোন কোন প্রস্তাব প্রেরক এমনও পণ করে, যে কোন মূল্যেই হোক রহিমাকে পত্নীরূপে লাভ করতেই হবে। এতে অর্থ-সম্পদ, যতই খরচ হোক না কেন; এতে পিছপা হবে না। রহিমার জনক-জননী এ সব কথা শুনে এটা কন্যার জন্য অশুভ মনে করে ভীষণ আতঙ্কিত হন।

Jannati-Romney-Rahima

তারা সদা-সর্বদা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। আয় মাবুদ। দয়াময় প্রভু! তুমিই অসহায়ের সহায়, নিরূপায়ের উপায়, বিপন্নের কাণ্ডারী আপনি আমাদের হৃদয়ের ধন আপনার এ দাসীটির প্রতি দয়া করে এর একটি সদগতি করে। দিন, যেন সে আপনার কোন প্রিয় বান্দার পদপ্রান্তে থেকে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বিপদে-আপদে আপনার নাম স্মরণ করতে পারে।

দয়াময় প্রভু! আপনার কাছে আপনার দুই অধম বান্দার মিনতী আমাদের এ কন্যাটিকে আপনি যে কোন অসৎ ব্যক্তির দুরাশার ছোবল থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। রহিমার জনক-জননীর করুণ মিনতী আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কবুল করেন এবং রহিমার জন্য তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ পূণ্যবান বান্দাকে স্বামীরূপে মনোনীত করেন।

এরপর আল্লাহ্ শীঘ্রই স্বপ্নযোগে রহিমার জনককে জানিয়ে দেন, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, অতি শীঘ্রই আমার নবী বাদশাহ হযরত আইউব (আঃ) সিরিয়া থেকে তোমাদের দেশে ভ্রমণ করতে এসে যে কোন সূত্রে তোমাদের সাথে পরিচয় ঘটবে। তখন তাঁর কাছে তোমাদের কন্যা সমর্পণ করবে।

Jannati-Romney-Rahima

আফ্রাহাম দম্পতি তাঁরা কাছে কন্যার বিবাহ সম্পর্কে এরূপ স্বপ্ন দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এবং সে শুভ মুহূর্তের আগমন আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত আইউব (আঃ) সঙ্গীগণসহ ভ্রমণ করতে করতে একদিন হঠাৎ সঙ্গীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

তৎকালে মানুষের যাতায়াতের রাস্তা ছিল একেবরেই অপ্রতুল এবং পথঘাট যা ছিল তাও বন-জঙ্গল ও দুর্গম এলাকার মধ্য দিয়ে এমনভাবে যে, একবার পথ হারিয়ে গেলে বিদেশী পথিকদের নির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করা ছিল একেবারেই অসম্ভব। হযরত আইউব (আঃ) সঙ্গীদের হারিয়ে তাদের আর খোঁজে পেলেন না।

সঙ্গীগণকে হারিয়ে পথ ভুলে অচেনা পথ ধরে চলতে থাকেন। অবশেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে থাকে। কেননা দেশের অচেনা পথে চলতে চলতে সহসা পথের পাশে বিরাট এক প্রাসাদ ভবন এবং তাঁর অনতি দূরে একটি পানির কূপ দেখে পেলেন। একে তো গ্রীষ্মকাল এর উপর সারাদিন পথ চলে হযরত আইউব (আঃ) ক্ষুধায় তৃষ্ণায় একেবারে কাতর হয়ে পড়েন।

পানির পিপাসায় তাঁর কণ্ঠ শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই পানির কূপ দেখতে পেয়ে পানি পান করার জন্য কূপটির কাছে অগ্রসর হলেন কিন্তু মা কূপ থেকে পানি তুলা নিয়ে রহিমার দাসীগণ বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছিল। পানি তোলার পাত্রটিও তারা সাথে করে নিয়ে যায়। রহিমাও দাসীদের সাথে কূপের কাছে ছিলেন। দাসীদের পিছনে পিছনে তিনিও বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। এ সময় হযরত আইউব (আঃ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে । হযরত আইউব (আঃ) বলেন, আমি পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়েছি।

আমাকে একপাত্র পানি পান করিয়ে পিপাসা দূর কর। পথিকের এরূপ কথা শুনে রহি বাড়িতে এসে পিতাকে বলেন, । জনৈক পিপাসার্ত পথিক পানি পান করতে চান, বের হে দেখুন। কন্যার কথায় আফ্রাহাম এসে দেখেন, এক সৌম্য দর্শন উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট যুবক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁর সুঠাম স্বাস্থ্য, উজ্জ্বল আকৃতি, প্রফুল্ল বদন, সর্বোপরি ললাটদেশের অত্যুজ্জ্বল আভা নিরীক্ষণ করে সহসা তাঁর একটি কথা স্মরণ হয়।

আপনি কোথা থেকে আফ্রাহাম যুবককে পানি পান দিয়ে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করেন, এসেছেন, কোন দেশের অধিবাসী এবং কোথায় যাবার ইচ্ছা করছেন ? হযরত আইউব (আঃ) তাঁর পরিচয় দান করে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এবং পথিমধ্যে সঙ্গী বিচ্ছেদ ইত্যাদি ঘটনা বর্ণনা করেন। পথিকের প্রতি প্রথম দৃষ্টিতে আফ্রাহামের পরিষ্কার ধারণা জন্মেছিল যে, ইনিই সে শামাধিপতি আল্লাহর নবী হযরত আইউব (আঃ)।

এবার তাঁর নিজের মুখে পরিচয় লাভ করে। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর স্বপ্ন সফল করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ সিরিয়া থেকে হযরত আইউব (আঃ)-কে এখানে পাঠিয়েছেন। পরম আনন্দে আফ্রাহাম একান্ত আগ্রহ সহকারে হযরত আইউব (আঃ)-কে আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দেখুন পরদেশী যুবক।  সন্ধ্যা সমাগত, সঙ্গী-সাথি ছাড়া অচেনা অজানা দেশে রাতে একা একা পথ চলা কোনক্রমেই নিরাপদ নয়। অতএব আপনি আমার আতিথ্য গ্রহণ করুন ।

মালিকের আগ্রহ ও আন্তরিকতা দেখে হযরত আইউব (আঃ) সানন্দে সম্মতি জানিয়ে আফ্রাহামের আতিথ্য গ্রহণ করেন। রাত্রে সম্মানিত অতিথিকে বহুবিধ সুস্বাদু ও সুখাদ্য দ্বারা তৃপ্তির সাথে আহার পর্ব শেষ হলে অতিথির বিশ্রাম ও শয়নের ব্যবস্থা করেন।

অতিথি শয্যায় আসন গ্রহণ করলে আফ্রাহাম তাঁর পাশে এসে ধীর শান্ত কণ্ঠে সুরুচিপূর্ণ ও নার্জিতভাবে নামান কথারপর, তিনি হযরত আইউব (আঃ)-এর কাছে স্বীয় কন্যা রহিমাকে সমর্পণের প্রস্তাব দেন । হযরত আইউব (আঃ) প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। মনে মনে তিনি ভাবতে থাকেন সবই আল্লাহর কুদরত। অচেনা অজানা বিদেশী রাজ্যে নিরাপদ আশ্রয় লাভ, এমন তৃপ্তির সাথে খানাপিনা, এরপর এমন অযাচিত ভাবে আল্লাহর এমন অমূল্য নিয়ামতের প্রস্তাব; এ সকল কিছুই আল্লাহর রহমতের অশেষ দান।

তাই মনে মনে তিনি আনন্দিত হলেও মুখে বলেন, দেখুন ! আমি এক বিদেশী মুসাফির এবং এক রাতের অতিথি। এখানে আমি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ছাড়া সম্পূর্ণ একা এবং একেবারেই আমি। এখন এখানে সহায়-সম্বলহীন এ অবস্থায় আপনার এ উত্তম প্রস্তাব আমি কেমন কমন করে গ্রহণ করতে পারি? আফ্রাহাম বলেন, আপনি আল্লাহর নবী, এবং বিশাল রাজ্য শামের অধিপত্তি এটাই তো এক মহাসম্পদ, এরপর আবার আরো কিসের প্রয়োজন?

দেখুন, আপনি অধিপতি আল্লাহর নবী হযরত আইউব (আঃ) এখানে আসবেন এবং আপন জানিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি তাঁদের স্বামী স্ত্রী উভয়ের স্বপ্নের কথা খুলে বলেন। এর বলেন, আপনি বলুন আল্লাহর ইঙ্গিত প্রদত্ত এ প্রস্তাবে আপনি সন্তুষ্ট কি না? বলেন, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এমন ইচ্ছা থাকলে এটা আমার সৌভাগ্যের কথা।
স্তাব আমি সানন্দে গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ মুহূর্তে শুভ কাজ সম্পন্ন না কর। আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে আমার রাজ্যে সম্পন্ন করাই ভাল মনে করছি।

unnamed

কেননা ই মুহূর্তে বিবাহে ব্যয় করার মত সামান্য অর্থও আমার কাছে নেই। আপনার কন্যার পরিবারের। সাথে সাথেই তাঁর ভরণ-পোষণের সকল দায়িত্ব আমাকেই বহন করতে হবে। কিন্তু তা পালন করার মত সঙ্গতি আমার এখন নেই। তাই একটু বিলম্বে হলেই ভাল হত। তার এখন আপনি যা ইচ্ছা করবেন তাই হবে। হযরত আইউব (আঃ)-এর কথা শুনে রহিমার জনক বলেন, আপনার মত পাত্রের হাতে কন্যা দান করার যে সৌভাগ্য আল্লাহ আমাকে নাম করেছেন, হয়ত আমার জন্য আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান।

আপনাদের পরিবারের সকল খচরপত্র আমিই বহন করব এবং পরিণয়ের পরে যে খরচপত্রের প্রয়োজন তা চালাবার
জন্য আমি আপনাকে একশত বকরী এবং একশত দুম্বা দান করব। এর আয়ে আপনারা উভয়েই স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবেন। রহিমার জনক আফ্রাহামের কথায় হযরত আইউব (আঃ) বিবাহ করতে আর কোনরূপ ইতস্তত না করে পূর্ণ সম্মতি দান করেন।

এরপর সে দিনই আফ্রাহামের ব্যবস্থাপনায় রহিমার সাথে তিনি বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। রহিমাকে বিবাহ করার সময় হযরত আইউব (আঃ) বিবাহিত ছিলেন এবং এর পূর্বেই তিনি তিনজন স্ত্রীর পাণি গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁরা তিনজনই বর্তমান ছিলেন। তাঁর তিন পত্নীর গর্ভের সাতটি পুত্র এবং তিনটি কন্যা সন্তান বর্তমান রয়েছেন। হযরত আইউব (আঃ) এ বিবাহের পর একাধারে পাঁচ বছর পত্নীসহ সেখানেই বাস করেন। এ পাঁচ বছর তিনি দূত মারফত নির্দেশ পাঠিয়ে শাম দেশের শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অন্যের উপর অর্পণ করেছিলেন। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তিনি যখন স্বীয় পত্নী রহিমাকে নিয়ে স্বদেশ যাত্রা করেন, তখন তাঁর শ্বশুর প্রদত্ত সম্পত্তি বর্ধিত হয়ে
তিন হাজার উচ্চ, সাত হাজার বকরী, চার হাজার অশ্ব, তিন হাজার দুগ্ধবতী গাভী, পাঁচ হাজার বলস এবং পাঁচ হাজার দুম্বায় পরিণত হয়েছিল।

এ সুবিশাল পশুপাল ও একদল রাখালসহ দিয়ে শাম দেশে এসে পৌঁছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর করে হযরত আইউব (আঃ) শামের শাসন ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। শামের জনগণ বহুদিন পর পুনরায় তাঁদের প্রিয়নবী
এবং ন্যায়পরায়ণ শাসককে ফিরে পেয়ে সুখ ও শান্তিতে তাদের জীবন ভরে ওঠ। ক্রমশ যতই দিন যেতে থাকে হযরত আইউব (আঃ)-এর ঐশ্বর্য এবং বিষয় সম্পত্তি ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। হযরত আইউব (আঃ) তাঁর ব্যক্তিগত ধনাগার থেকে প্রতিদিন গরীব দুঃখীগণকে দান করতেন এবং সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতেন কেউ যেন কোন প্রকার কষ্ট ভোগ না করে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *