জ্যাক ও শিমগাছ
অনেক দিন আগে, ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে বাস করত গরিব এক বিধবা। একমাত্র ছেলে ছাড়া সাতকুলে কেউ ছিল না তার। ছেলেটির নাম জ্যাক। সে ছিল খুবই চালাক । ভারি
শক্তসমর্থ শরীর, আচার-ব্যবহারে খুব ভালো। কাজ করার ব্যাপারে কোনো ক্লান্তি ছিলনা। কিন্তু ঘরের বাইরে যেতে মন চাইত না তার । বেঁচে থাকার জন্য কাজ করার কোনো আগ্রহ ছিল না তার । ঘরে বসেই মাকে সে টুকিটাকি সাহায্য করত । বাগানে শাকসবজির
চাষ করত । আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে কাঠ কেটে আনত । একটা শাদা ধবধবে গরু
ছিল তাদের। প্রতিদিন সকালে সে গরুর দুধ দোয়াত। আর মা রান্নাবান্না করত,ধোয়ামোছা করত, সংসারের সব কাজ করত। যদিও তারা গরিব ছিল তবু সুখ ছিল
তাদের সংসারে । পেটপুরে খেয়েদেয়ে বড় আরামেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল।
একবার ভয়াবহ খরা নামল তাদের এলাকায়। যেন আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে
মাঠ-ঘাট। কোথাও কোনো ঘাস নেই, শস্য নেই। সব শুকনো। মাঠে না চরতে পেরে, ঘাস না-খেতে পেয়ে জ্যাকদের গরুটাও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেল। আর সে দুধ
দেয় না। তাই জ্যাকের মা দুধ থেকে মাখন বানাতে পারে না। খাবার জন্য দুধ পায় না। বাগানে শাকসবজি শুকিয়ে গেল । কারণ আগুনের মতো গরম পড়েছে। জমানো
যা কিছু টাকা-পয়সা ছিল কদিনের মধ্যেই সব ফুরিয়ে গেল জ্যাকদের।
খরার কারণে ওদের পরিবারে নেমে এল অভাব । মা তখন একদিন বললেন,জ্যাক, গরুটাকে বিক্রি করে দেয়াই বোধহয় ভালো হবে এখন। ঘাস পাওয়া
যাচ্ছে না কোথাও। এইভাবে থাকলে আমাদের গরুটা না-খেতে পেয়েই মারা যাবে।বিক্রি করে কিছু টাকা-পয়সা পেলে তাই দিয়ে খাদ্য কিনে দিন চালাতে হবে আমাদের খুবই ভালো বুদ্ধি । জ্যাক সায় দিল মায়ের প্রস্তাবে।
আমি আজই বাজারে নিয়ে যাচ্ছি গরুটাকে। গরু বিক্রি করে যে টাকা পাব তাই দিয়ে কিছু মালপত্র কিনে দোকান চালু করব আমি। ছোট্ট একটা মনোহারি
দোকান। হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন, সুঁই-সুতো, মশলাপাতি, তেল-নুন— সবথাকবে আমার দোকানে। পড়শিরা যেন আমার দোকানেই সব জিনিসপাতি পেয়ে
যায়। দোকানটা ভালোমতো চললে চাই কি আমরা একদিন বড়লোকও হয়ে যেতেপারি । আজই গরুটাকে বিক্রির ব্যবস্থা করছি আমি আহা রে, এতদিনের গরু। কত-না দুধ দিয়েছে আমাদের। মায়াও লাগছে
খুব । কিন্তু—
মা কাকুতি করলেন । কিন্তু বিক্রি না করে উপায় কী
দেখ বাবা, ভালো দামে বিক্রি করতে হবে কিন্তু গরুটাকে। দশ-বারোপাউন্ডের নিচে কিছুতেই নয়।
জ্যাক সঙ্গে সঙ্গে বলল,
পনের পাউন্ডের এক পয়সা কমে আমি বিক্রি করব না। অবাক হয়ো না মা যদি আমি বিশ পাউন্ডে এটা বিক্রি করে ফেলি পরদিন সকালবেলা । অল্প কিছু নাশতা খেয়ে জ্যাক রওনা দিল বাজারের দিকে।আজ সে গরুটাকে বিক্রি করবে। গ্রামের কাঁচারাস্তা ধরে হাঁটা দিল জ্যাক। পথেরদুপাশে রোদে পুড়ে খালগুলো পর্যন্ত খড়খড়ে হয়ে গেছে। মাটি ফেটে চৌচির।গরুটা মাঝে-মধ্যেই অবাধ্য হয়ে উঠছে ঘাস-পানি খাওয়ার জন্য। ঘাস তো দূরের
কথা— আগাছাও নেই কোথাও।হাঁটতে হাঁটতে জ্যাক একসময় এসে পৌঁছল চওড়া রাস্তায়। এই রাস্তাটাই সোজাগিয়েছে বাজারের দিকে। পথের মধ্যেই দেখা হল এক থুরথুরে বুড়োর সঙ্গে। বুড়োটা
লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে।
জ্যাক সামনে আসতেই বুড়োটা ইশারায় জ্যাককে ডাকল। জ্যাক বুড়োটার দিকে তাকিয়ে দেখে, খুবই উজ্জ্বল দুই চোখ
বুড়োর। যেন জ্বলজ্বল করছে।
জ্যাক খুবই ভদ্র ছেলে। বুড়োকে সে আদাব দিল ।
শুভ হোক আপনার দিন।
বুড়ো তখন বলল,
কী বাবা, এ-রকম আগুনে-গরমের দিনে কোথায় যাচ্ছ তুমি?
– দাদু বাজারে যাচ্ছি, এই গরুটাকে বিক্রি করব।
বাজারে গিয়ে বিক্রি করার দরকার কী? এস, এস, কাছে এস। শোনোআমার কথা।
জ্যাক আরও কাছে এল। বুড়ো তার ঝোলা থেকে পাঁচটা শিমের বিচি বের
করে বলল,এই পাঁচটা শিমের বিচির বদলে তোমার গরুটা দিয়ে যাও আমাকে।
কী! আমার দুধেল গাই-গরুটার বদলে মাত্র পাঁচটা শিমের বিচি! জ্যাক আশ্চর্যহয়ে যেন চিৎকার করে উঠল |
এ কী ধরনের দরদাম আপনার? শিমের বিচির বদলে আস্ত একটা গরু! এরচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর আছে কি?
বুড়ো তখন বলল,
ভয় পাচ্ছ কেন খোকা। এইসব শিমের বিচি একেবারে সাধারণ বিচি নয়। শুধুমাটিতে পুঁতে দিলেই আসল মজাটা দেখবে, শিমগাছটা সাঁই সাঁই করে বেড়ে উঠে
আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, আকাশ ছাড়িয়ে চলে যাবে। এ-রকম আশ্চর্য এবং রহস্যময় শিমেরগাছ আর কোথাও দেখবে না। গাছ বেয়ে উপরে উঠে দেখতেও পার । মজার এক ভ্রমণ হবে সেটা। আশ্চর্য-শিমের গাছের বদলে একটিমাত্র গরু— ভেবে দেখ ব্যাপারটা!
জ্যাক খানিকক্ষণ কীসব ভাবল । তারপর বলল,
শিমের বিচিগুলো যে সত্যি সত্যি জাদু জানে এ-কথার ভিত্তি কী? তুমি যেসত্য বলছ তাই-বা আমি বিশ্বাস করি কীভাবে?
বুড়ো হাসতে হাসতে বলল,
আমি সবসময় সত্য বলি । গরুটাকে আমার কাছে রেখে শিমের বিচি তুমি নিয়ে যাও। যা বলেছি তা যদি না ঘটে তবে আগামীকাল ঠিক এই সময়ে তুমি এইখানেই
আসবে। তোমার গরু তখন ফেরত দিয়ে দেব। কোনো ঝামেলা হবে না তোমার। জ্যাক সরল মনে বুড়োর কথা বিশ্বাস করল। আর সে তর্ক বাড়াল না। গরুটাকে
সে দিয়ে দিল উজ্জ্বল চোখের বুড়োকে। শিমের বিচি নিয়ে পকেটে পুরে রাখল
জ্যাক। সে ভুলেই গেছে গরুটাকে পনের বা বিশটা সোনার মুদ্রায় বিক্রি করার কথা ।
মাকে সে সেইমতোই কথা দিয়ে এসেছে। জ্যাকের মাথায় তখন একটাই স্বপ্ন— এইশিমের গাছটা আকাশ ছুঁয়ে উঠে যাবে অনেক উপরে।
বুড়ো গরুটা নিয়ে সেই চওড়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল নিজের রাস্তায়।
আর জ্যাক পাঁচটা শিমের বিচি যত্ন করে পকেটে নিয়ে ফিরে এল বাড়িতে।
মা তো জ্যাককে দেখে অবাক! এত তাড়াতাড়ি ছেলেটা ফিরে এল কেন?
মা ছেলের পিঠে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
বাবা, নিশ্চয়ই খুব ভালো দামে গরুটা বিক্রি করেছ । কত? কত দামে বেচলে?
দশ? পনের? খুবই ভালো ছিল আমাদের গরুটা। কিন্তু—
–
কথার মাঝখানে মাকে থামিয়ে দিল জ্যাক।
কোনো টাকাই পাই নি গরুটা বেচে। গরু বেচে অবশ্যি পয়সা পাওয়ার কথা । কিন্তু পেয়েছি অন্যকিছু। তোমায় একটু ধৈর্য ধরতে হবে মা।কোনো টাকা পাস নি তুই! কী বলছিস এসব আবোল-তাবোল? গরুটাকে
মাগনায় ছেড়ে দিয়ে এলি! তোর মতো একটা গর্দভ, হাবা গঙ্গারাম, বোকা ছেলেবোধহয় কোথাও নেই।
মা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুললেন ।
একদম বিনে পয়সায় গরুটাকে ছেড়ে দিয়ে আসি নি।
জ্যাক হাসতে হাসতে বলল,
এই দেখ— গরুর বদলে এগুলো এনেছি আমি।
এই কথা বলেই জ্যাক পকেট থেকে পাঁচটি শিমের বিচি বের করে মায়ের সামনে তুলে ধরল।গরুর বদলে এই কয়েকটা শিম বিচি! হায়রে হায়!
– মা!
মাথা চাপড়াতে লাগল মা।
– তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! আমার একমাত্র সম্বল গরুটাকে নিয়ে গিয়ে তুইকী করলি রে! তুই তো একেবারে অকম্মার ঢেঁকি!
খুব সাধারণ শিম নয় এগুলো মা।
জ্যাক দৃঢ়স্বরে জানাল,
এগুলো হচ্ছে জাদুর বিচি!
জ্যাকের মা এমনিতে খুব শাদাসিধে মহিলা । সহজে তিনি রাগ করেন না । জাদুরবিচির কথা শুনে এবারে সত্যি সত্যি রেগে উঠলেন।
জাদু না জোচ্চুরি!
মা এবারে কেঁদে উঠলেন,
কেন এভাবে দিয়ে এলি গরুটা? বোকারাম কোথাকার! তুই যে গাধার মতো ঠকে এসেছিস এটাও বুঝছিস না! আমার সব শেষ করে দিলি! বেরিয়ে যা চোখের
সামনে থেকে। কোত্থেকে খাবার আসে সেদিকে হুঁশ নেই! যা এবার! নিজের পথনিজে দেখে নে! বুদ্ধ কোথাকার!
মা আরও কী কী যেন বলতে থাকেন । বিচিগুলো নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন জানালা দিয়ে । গরুর শোক তিনি একেবারেই ভুলতে পারছেন না। জ্যাক আর কী বলবে মাকে? দুঃখে তাদের কুঁড়েঘরের চিলেকোঠায় গিয়ে শুয়ে রইল । পেটে কোনো দানাপানিপড়ে নি। খিদে পেয়েছে। কিন্তু মাকে গিয়ে কীভাবে বলবে, খাবার দরকার! মা মহা-উত্তেজিত।
জ্যাক বিছানায় শুয়ে আপন মনে ভাবতে লাগল, আসলেও কী বোকার হদ্দ সে!
মায়ের উত্তেজিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বিধবা মায়ের জন্য হৃদয়-ভরা সহানুভূতি জেগে উঠল জ্যাকের মনে। মা তাকে অবশ্যই অকস্মার ধাড়ি ভাবতে
পারেন। সংসারের কোনো কাজে আসলে জ্যাক তো কোনো সাহায্যে আসে না।রাতে খাওয়া হয় নি। পেটে খিদের জ্বালা। আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে
মনের দুঃখে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল জ্যাক। অল্পক্ষণের মধ্যেই গভীরঘুম নেমে এল। তার চোখে।