জ্যাক ও শিমগাছ পর্ব২

জ্যাক ও শিমগাছ পর্ব২

পরদিন সকালবেলা ।
ঘুম ভাঙতেই জ্যাক জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ম্লান সবুজ আলোর আভা ছড়িয়ে আছে চারদিকে । স্বপ্ন দেখছে না তো জ্যাক! এমন সময় তার কানে এল— পাশের বাড়ির চেনা মোরগের ডাক কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ। আর দূর থেকে পাহারাদারকুকুরের ঘেউ ঘেউ। না, তাহলে স্বপ্ন নয়! জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল জ্যাক।
অবাক হয়ে দেখল— পুরো উঠোন যেন ঢেকে গেছে সবুজ পাতায়। তরতাজা অজস্রসবুজ পাতা যেন বাতাসে লকলক করছে। পাতাগুলো দেখতে— হ্যাঁ, একেবারে
শিমের পাতার মতো। অবাক হয়ে গেল জ্যাক। তাহলে ব্যাপারটা একেবারে সত্যি!

জাদুর শিমের বিচি থেকে তবে আকাশ-ছোঁয়া শিমের গাছ ঠিক ঠিক গজিয়ে গেছে।
সে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল । এক দৌড়ে গেল জানালার ধারে। হ্যাঁ— সেইগাছ। মা বিচিগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল উঠোনে। রাতের বেলা সেখান থেকেই
তৈরি হয়েছে গাছ। একেই বলে জাদু! নিচে তাকিয়ে দেখল— বিশাল একটাশিমগাছের গুঁড়ি । চারপাশে লতানো শিমের ডালপালা, সবুজ পাতা। উপরে তাকাল
জ্যাক। হ্যাঁ— গাছটা উপরে উঠে গেছে। উপরে, অনেক উপরে। যেন আকাশছাড়িয়ে মেঘের দেশে হারিয়ে গেছে গাছের ডালপালা ।কোনো চিন্তাভাবনা না করেই জ্যাক লাফিয়ে উঠল শিমগাছে। পরীক্ষা করে।দেখতে চাইল শিমগাছের ডাল তার ওজন নিতে পারে কি না! অনায়াসেই শিমগাছের লতা ধরে উপরে ওঠা যায়। খুব মজা পেল জ্যাক। তক্ষুনি জ্যাক উপরে ওঠা
শুরু করল।গাছ বেয়ে উপরে ওঠায় জ্যাক খুবই পটু। তরতর করে সে উপরে উঠতে লাগল।

উঠতে উঠতে উঠতে উঠতে জ্যাক নিচে তাকিয়ে দেখে, কিছুই যেন দেখা যাচ্ছে না।মায়ের ছোট্ট কুঁড়েঘরটা এতটুকুন হয়ে গেছে। চিমনি দিয়ে বোধহয় ধোঁয়া উঠছেবাগানে কয়েকটা কাপড়-চোপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। সে-সবও যেন আবছা দেখাযাচ্ছে। তার একটু পরেই জ্যাক হারিয়ে গেল মেঘের দেশে। চারপাশে মেঘ আর মেঘ।মেঘের ওপারে সূর্যের আলো ঝকমক করছে। আরও উজ্জ্বল, আরও তীব্র সূর্যেরআলো চারপাশে। সেই আলোয় দেখা গেল, গাছের শেষ মাথায় একটা দীর্ঘ শাদা
রাস্তা । চিকচিক করছে । জ্যাক গাছের মাথা থেকে ঝুপ করে নেমে পড়ল সেই রাস্তায় ।

তারপর একা একা হাঁটা ধরল সেই অসীম ধু-ধু শাদা রাস্তায়। কোথাও কোনো মানুষ নেই, পশুপাখি নেই, গাছপালা নেই; এমনকি একটা ঘরবাড়ি পর্যন্ত নেই।
তবু জ্যাক হেঁটে চলল। জ্যাক যখন ভাবছে হয়তো কোনোকিছুই দেখা যাবে না,ঠিক তখনই সে সামনে তাকিয়ে দেখে— উঁচু একটা বাড়ি। একদম খাড়া উঁচু।
বাড়ির সামনে যেতেই জ্যাক দেখতে পেল— বিশাল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা একমহিলা। জ্যাক একলাফে মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খুব সাহসের সঙ্গে বলল,
আমায় একটু নাশতা দেবেন? আমি খুব ক্ষুধার্ত!
ও তুমি!
মহিলা বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলল,
এখানে তুমি সকালের নাশতা পাবেই না, বরং তোমাকেই সকালের নাশতা বানানো হতে পারে। আমার স্বামী একজন মানুষখেকো রাক্ষস। বিরাট আকৃতির
অসাধারণ এক রাক্ষস। দশটা বাঘের চেয়েও সেভয়ংকর। সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তোমার বয়সী তরুণদের। আগুনে ঝলসে পুড়িয়ে খাওয়ার ব্যাপারেতার বিপুল আনন্দ।
জ্যাক সব শুনে বিনীতভাবে বলল,
আমাদের ওখানে খুবই দুর্ভিক্ষ। কোনো খাবার পাওয়া যায় না। আমার বাড়িতেও কোনো খাবার নেই। আপনার নাশতা থেকে একটু ভাগ দিলে আমি বেঁচে যাই। এত খিদে পেয়েছে, মনে হচ্ছে নিজেকেই খেয়ে ফেলি ।
রাক্ষসের বউটা খুব নিষ্ঠুর ছিল না। স্বামীর মতো হিংস্রও নয়। ছেলেটির কথা শুনে বউটার মনে দয়া হল । মহিলা উঁচু হয়ে প্রশস্ত রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দেখল—
রাক্ষুসে স্বামী আসছে কি না! তারপর ছেলেটিকে ভেতরে আসতে দিল । এক ধাক্কায় পাকঘরে নিয়ে বসাল জ্যাককে। তারপর কিছু রুটি আর মাখন আর এক কাপ দুধ দিয়ে মহিলা বলল— জলদি খেয়ে নাও।

নাশতা খাওয়া শেষ হতে-না-হতেই জ্যাক শুনতে পেল ভয়ংকর শব্দ। যেন বাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুম দুম্, দুম দুম— বিকট শব্দে কে যেন পা ফেলে
ফেলে আসছে-দূর থেকে। হয়তো সেই রাক্ষসের আগমনধ্বনি ।মহিলা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে জ্যাককে বলল,
শিগগির ওই চুলোর পাশে গিয়ে লুকিয়ে পড়। ওইখানে লুকালে রাক্ষসটা তোমাকে দেখবে না । যদি তোমাকে ধরতে পারে তবে কিন্তু রক্ষা নেই । এক-দুইবার
ঢোঁক গিলেই তোমাকে সোজা পেটে চালান করে দেবে।
বিশাল চুলোর পাশে লাফ দিয়ে জ্যাক গিয়ে লুকিয়ে পড়ল । রান্নাঘরের দরজাটা টেনে দিল সেই মহিলা। রাক্ষসটা যেন উঁকিঝুঁকি মেরেও জ্যাককে দেখতে না পায় ।রাক্ষসটা হাঁটছে যেন দমাদম শব্দ হচ্ছে। কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে মাটিতে।রাক্ষসের কোমরে বাঁধা তিনটে মরা গরুর ছানা। রাক্ষসটা তার বিশাল খাবার-টেবিলে গরু তিনটাকে রাখল । চিৎকার করে বউকে ডেকে বলল,
– তাড়াতাড়ি রান্না করে নিয়ে আয়। আমার খুব খিদে পেয়েছে।বউ গরু-তিনটাকে বিশাল এক কড়াইয়ের মধ্যে ছেড়ে দিল। ভাজতে লাগো শুকতে লাগল । ঘরঘর করে শব্দ হতে লাগল তার শ্বাসপ্রশ্বাসের।আস্তে আস্তে! রাক্ষসটা চোখ বড় বড় চোখে তাকাল সেদিকে। নাক উঁচু করে গন্ধ
চুলোর কোণায় লুকিয়ে স্পষ্ট সে-শব্দ শুনতে পেল জ্যাক। বন্ধ লোহার দরজা
পেল রাক্ষসের বিকট কণ্ঠের চিৎকার—
ছাপিয়ে আসতে লাগল সে-শব্দ। নাক টানার শব্দ শেষ হতে-না-হতেই জ্যাক শুনতে,হাঁউ মাঁউ খাঁউ
ব্রিটিশ মানুষের গন্ধ পাঁউ জীবিত বা মৃত হোক, তার নেই ছুটি।ব্রিটিশের মাংস দিয়ে খাব আজ রুটি ।
রাক্ষসের নাক খুবই তীব্র ও সংবেদনশীল । সে একবার নাক টেনেই জ্যাকের গায়েরগন্ধ টের পেয়েছে। কিন্তু তার বউ বলল,
— তুমি সবসময়ই ছোঁক ছোঁক কর কেন বল তো? তুমি গতরাতের কথা বলছ কেন?মানুষের গন্ধ তো গতরাতে পেয়েছিলে। মানুষ ধরে খেয়েছিলে। আজ আবার মানুষ
কোথায়? সুস্থির হয়ে বস। জুতো খোল । আমি তোমার জন্য নাশতা নিয়ে আসছি।খুশিমনে জুতো খুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল রাক্ষসটা।কুড়মুড় করে তিনটে গরুর ছানাকে চেটেপুটে খেয়ে নিল সে। নাশতা খাবার পররাক্ষসটা দেয়ালে-ঝোলানো শক্ত একটা ব্যাগ নিয়ে রাখল টেবিলের উপর। সম্পূর্ণ ব্যাগটা ভরা সোনার টুকরোয়। রাক্ষস আরাম করে বসে ব্যাগটা উল্টে সোনার
মোহরগুলো গুনতে লাগল। গোনাগুনতি শেষ হলে সোনার মোহরগুলো ব্যাগে ভরে টেবিলের উপর রেখে দিল রাক্ষসটা। রাক্ষসের তখন ঘুমঘুম ভাব। চোখজুড়ে ঘুম নেমে আসছে তার । সারারাত বেচারা শিকার খুঁজে বেরিয়েছে। সকালের নাশতার জন্যতিনটে গরু খোঁজা কম নয়! নাশতা খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাক্ষসটা গরর গরর শব্দে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল । লুকিয়ে থেকেই জ্যাক শুনতে পেল নাক-ডাকার শব্দ ।নাক-ডাকা নয় যেন আকাশজুড়ে বজ্রপাত হচ্ছে। যেন পাহাড়ের উপরে আছড়ে পড়ছেবিদ্যুৎ চমক । তখন রাক্ষসের বউটা এসে দরজা খুলে দিল জ্যাকের।যত তাড়াতাড়ি পার পালিয়ে যাও।ফিসফিস করে বলল সে।এখন রাক্ষসটা ঘুমাচ্ছে। এরই ফাঁকে তোমাকে পালাতে হবে। নইলেমারাত্মক বিপদ হবে তোমার।

জ্যাকের তীক্ষ্ণ চোখ একঝলকে দেখে নিল, টেবিলের উপর ব্যাগটা সোনার টুকরোয় ভরা । মহিলাটা পেছন ফেরামাত্র জ্যাক চোখের নিমেষে ব্যাগটা তুলে নিল ।
তারপর দরজা পেরিয়ে একছুটে রওনা দিল বাড়ির দিকে। হাতে ধরা ব্যাগ । শাদা রাস্তাধরে ছুটতে ছুটতে সে এল শিমের গাছের মাথায়। প্রচণ্ড জোরে হাঁপাচ্ছে বেচারা। শুধু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল সে— না, পেছনে কেউ নেই। লতানো শিমের ডালপালা ধরে দ্রুতবেগে জ্যাক নামতে লাগল । খুব দ্রুত নামতে গিয়ে তার হাত থেকে থলেটা ঝট করে পড়ে গেল নিচে। তাতে ভয়ের কিছু নেই। কারণ থলেটা এসে ঝপ করে পড়ল তাদেরই বাগানে। একেবারে তার মায়ের পায়ের সামনে।

একদিন চমৎকার এক সকালবেলা জ্যাক লাফ দিয়ে শিমের ডাল ধরল । উপরে,উপরে, উপরে— ডাল বেয়ে বেয়ে সে এল একদম উপরে । একসময় সে পৌঁছে গেল
শাদা রাস্তার উপরে। দীর্ঘ সেই রাস্তা। দু-পাশ যেন মেঘে ঢাকা। মেঘের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে তার । হাঁটতে হাঁটতে একসময় রাক্ষসের বাড়ির সামনে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই লম্বা মহিলা। হাতে তার ঘর ঝাঁট দেয়ার ঝাড়।

জ্যাক।
– কেমন আছেন খালা? সাত-সকালে কী করছেন আপনি?কেমন আর থাকি? তোমাকে দেখার পর থেকে এখন ভালোই লাগছে।আজ আমাকে নাশতা খাওয়াবেন না?তোমাকে তো একবার নাশতা খাইয়েছিলাম। তারপর আমার নাকের সামনেথেকেই এক থলে সোনা হাওয়া করে দিলে।এ-রকম কথা আমাকে বলতে পারলেন খালা?জ্যাকের কথাবার্তায় তখন অনন্ত বিস্ময়।
কীভাবে সোনার থলে হারিয়ে ছিল বলুন তো?সে কথা আমার চেয়ে তোমারই ভালো করে জানার কথা।ঠিক আছে । ধরে নিচ্ছি আমিই চুরি করেছি। সে শাস্তি আমায় পরে দেবেন।তার আগে আমাকে নাশতা দিন। খেয়েদেয়ে নিই। তারপর সব আপনাকে খুলে বলব । থলে ভরা সোনা কীভাবে নিলাম, সেই সোনা দিয়ে কী করলাম, সব বলব।রাক্ষসের বউটা সোনা সম্পর্কে জানার জন্য খুবই আগ্রহী হয়ে উঠল । তক্ষুনি নাশতা খাওয়ানোর ব্যাপারে রাজি হল সে। রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল জ্যাককে।
রুটি-পনির আর এক মগ দুধ খেতে দিল তাকে ৷
খাওয়া যখন প্রায় শেষ তখনই কানে ভেসে এল সেই ভয়ংকর পদধ্বনি। পুরো বাড়িটা কাঁপতে লাগল থরথর করে। রাক্ষস আসছে। সকালের নাশতা খাবার জন্য
আগমন ঘটছে রাক্ষসের। রান্নাঘরে চুলোর একপাশে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল জ্যাক।লম্বা মহিলাটা তাকে বেঁধে রাখল যেন সে পালাতে না পারে। তারপর দরজা টেনেবন্ধ করে দিল জ্যাককে।রাক্ষস দমাদম শব্দে ধাক্কা দিয়ে ঘরেপ্রবেশ করল! তার দুই হাতে ঝুলছে দুটো বড় বড় ষাঁড়।

বউ, এদিকে আয়।
ষাঁড় দুটোকে টেবিলে ছুড়ে দিল রাক্ষসটা।
– শিগগির একটা রান্না কর । কিন্তু কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছি আমি?হাঁউ মাঁউ খাঁউব্রিটিশ মানুষের গন্ধ পাঁউ।জীবিত বা মৃত হোক, তার নেই ছুটি।ব্রিটিশের মাংস দিয়ে খাব আজ রুটি ।তোমার আর আক্কেল হল না। খালি আবোল তাবোল বকো তুমি। গতরাতের গন্ধ তুমি আজ সকালেও পাচ্ছ। কী যে হবে তোমাকে নিয়ে। নাও, আমি নাশতা
বানিয়ে আনছি।চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল রাক্ষসের বউ।
নাশতা খাওয়ার পরে রাক্ষস বলল

বউ, আমার মুরগিটা নিয়ে এস। আহা
আমার সোনার মুরগি।রাক্ষসের বউ একটা ধূসর রঙের চমৎকার মুরগি নিয়ে এল তার সামনে। রাক্ষস
মুরগিটাকে টেবিলে রাখল। তারপর ধীরস্বরে বলল—ডিম, ডিম, ডিম! সঙ্গে সঙ্গে মুরগিটা একটা সোনার ডিম পাড়ল। ডিমটা গড়িয়ে পড়ল টেবিলের উপর। রাক্ষস
খপ করে সোনার ডিমটা নিয়ে পকেটে পুরল। তারপর আবার বলল— ডিম,ডিম, ডিম। আবার মুরগিটা সোনার ডিম পাড়ল। এইভাবে কয়েকটা ডিম পকেটে
পুরতে-না-পুরতেই ঘুমের আবেশে ঢলে পড়ল রাক্ষসটা। রাত জেগে কাজ করতে হয়তাকে। সকালে তাই চোখ ভেঙে ঘুম আসে তার। চেয়ারের একধারে মাথাটা কাত
হয়ে গেল রাক্ষসের। তারপর প্রচণ্ড শব্দে নাক ডাকতে লাগল। যেন বজ্রপাতের চেয়েও বিশ-পঁচিশ গুণ জোরে শব্দ হচ্ছে সেই নাক-ডাকায় । যদিও সে লোহার দরজা
লাগানো ছোট্ট কুঠুরিতে বসে আছে, তবু এত শব্দ যে আঁতকে উঠল জ্যাক।রাক্ষস যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, সেই মহিলা তখন এসে মুক্ত করলজ্যাককে। সে জানতে চায় চুরি-করা এক থলে সোনার মোহর নিয়ে জ্যাক আসলেকী করেছে? জ্যাকের চোখ তখন টেবিলের উপর সোনার ডিম-পাড়া মুরগিটার
দিকে । জ্যাক বুঝল, এই মুরগিটাকে পেলে জীবনে আর কিছু লাগবে না। মুরগিটাক চুরি করতেই হবে।
জ্যাক তখন রাক্ষসের বউকে বলল,
চুলোর পাশে বসে থাকতে থাকতে আমার গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে।আমার কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছে। আপনাদের কুয়ো থেকে এক মগ পানি এনে
দিন আগে। শুকনো গলায় আমি কথা বলব কীভাবে?
লম্বা মহিলাটা তখন ঘরের বাইরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জ্যাক বগলদাবা করল মুরগিটাকে । শক্ত করে চেপে ধরে দরজা পেরিয়ে জোরে ছুট লাগাল সে । কিন্তু বিপদ
ডেকে আনল মুরগিটা নিজেই। হাতের মধ্যে আটকা পড়ে মুরগিটা জোরে জোরেডাকতে শুরু করল । কোঁ, কোঁ, কোঁ, কোঁ।মুরগির ডাক শুনেই ঘুম ভেঙে গেল রাক্ষসের । তড়িঘড়ি উঠেই হাতে একটা মুগুর নিয়ে দরজার বাইরে লাফ দিয়ে পড়ল রাক্ষসটা। বাড়ির পেছনে পানি তুলছে তারবউ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে দেখতে পেল, মুরগি কোলে নিয়ে জ্যাক ছুটছেপ্রাণান্ত । পেছনে পেছনে তার রাক্ষস-স্বামী |
জ্যাক এমনভাবে ছুটছে যে মনে হচ্ছে যেন ঝড়ো বাতাস তাকে তাড়িয়ে নিয়েযাচ্ছে। বাতাসের মতো শনশন বেগে ছুটছে সে। পেছনে পেছনে আসছে সেই রাক্ষস। রাক্ষসের বড় বড় পা— ছুটছে তার ভারী শরীর টেনে। একটু আগেই বেচারা নাশতা সেরেছে। পেট ভারী হয়ে আছে তার। জ্যাক আরও ত্বরিত গতিতেছুটছে। যত শক্তি আছে তার গায়ে, সবটুকু দিয়ে সে ছুটছে।শাদা রাস্তা দিয়ে বিরামহীন ছোটা! পাশ কাটিয়ে, কখনও ধোঁকা দিয়ে, কখনও লাফ মেরে এগিয়ে চলেছে জ্যাক। আর মুরগিটা প্রাণান্ত চেঁচাচ্ছে। ডানা ঝাপটাচ্ছে। যেন সে মরেই যাবে।

রাক্ষসটা মুগুর ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটছে। মুগুরটা সে ছুড়েই মারতে পারে কিন্তু রাক্ষসটা এত জোরে চেঁচাচ্ছে যে ঘূর্ণি দিয়ে বাতাস ঘুরছে। আর সেই বাতাসের যদি মুরগিটা মরে যায়! তার মুখে কেবল খিস্তি-খেউড়। ভয়াবহ সেই ভাষা।তোড়ে জ্যাক সামনের দিকে ছুটছে আরও দ্রুত। রাক্ষসটা ছুটতে ছুটতে জ্যাকের। প্রায় কাছে এসে হাজির হল। এখন মাত্র কয়েক গজ দূরত্ব । মুগুরটা এবার মাথার
উপরেই পড়বে। কিন্তু পাশ কাটিয়ে একটু সরে গেল জ্যাক। আর সঙ্গে সঙ্গে।কোত্থেকে একদলা মেঘ এসে ঢেকে ফেলল জ্যাককে। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়লবেচারা। কোনোমতে জানে বেঁচে গেল ।সেই ঘন মেঘের আড়ালে জ্যাক শুধু সামনের শাদা রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছে। আর
রাক্ষসটা সেই মেঘের ভেতরে পথ হারিয়ে কেবল জোরে জোরে মুগুর ঘোরাচ্ছে।জ্যাক পথের ধার দিয়ে কোনোমতে ছুটছে। একটা বিশাল গর্তে দুম করে পড়ে গেল জ্যাক। রাক্ষসটা পেছন পেছন গর্তে পড়ল। ততক্ষণে জ্যাক প্রাণ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রাস্তায় । ছুটতে ছুটতে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যাক শিমগাছের মাথার সন্ধান
পেল । আর কোনোদিকে না তাকিয়ে গাছের লতা ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্যাক। হাতেতার মুরগিটা তখনও ধরা আছে। জ্যাক ছুটতে ছুটতে ভাবছিল— আজ হয়তো প্রাণ
নিয়ে বাড়িতে সে ফিরতে পারবে না। গাছের লতা ধরে সরসর করে সে নেমে এল কিছুদূর। নামতে নামতে মেঘ পেরিয়ে, কুয়াশা পেরিয়ে একসময় সে নিচে তাকিয়ে
দেখল— মাকে দেখা যাচ্ছে। মা বাগানে কাজ করছেন।
এক নিশ্বাসে জ্যাক নিচে নিমে এল । হাঁপাচ্ছে বেচারা! হাতে সেই জাদুর মুরগি।

– মা, মা, দেখ তোমার জন্য কী এনেছি?
কী আর আনবি? একটা মুরগি ধরে এনেছিস।
শিগগির তুমি ঘরের ভেতর চল। তারপর দেখাব তোমাকে— কেমন জাদু
জানে এই মুরগি।
মা তখন ছেলের পেছন পেছন ঘরে ঢুকল । জ্যাক ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল যেন মুরগিটা পালিয়ে যেতে না পারে। তারপর জ্যাক মেঝের উপর আসন করে
বসল । মুরগিটাকে সামনে রেখে ধীরস্বরে বলতে লাগল— ডিম, ডিম, ডিম। সঙ্গে সঙ্গে একটা সোনার ডিম পাড়ল সেই মুরগি।মায়ের চোখ তখন কপালে উঠেছে। তার আশ্চর্য ছেলেটা কী সব আশ্চর্যকাণ্ডই- না ঘটিয়ে চলেছে! জ্যাক আর দেরি করল না। সোনার ডিম নিয়ে বাজারেচলে গেল । ঘর-সংসারে যা যা প্রয়োজন সব কিনল মন ভরে।তারপর থেকে প্রয়োজন হলেই মুরগির একটা ডিম পাড়িয়ে নিত ওরা। এভাবেই আবার তাদের জীবনে নেমে এল অপার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। কিছুদিনের মধ্যেই বেশধন-সম্পদের মালিক হয়ে উঠল জ্যাক আর তার মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *