জ্যাক ও শিমগাছ পর্ব৩

জ্যাক ও শিমগাছ পর্ব৩

সুখে-শান্তিতে থাকলেই যে মানুষের জীবন সুন্দরভাবে কেটে যায় এমনটি নয়। ঘরে বসে থাকতে আর কয়দিন ভালো লাগে? শেষমেশ জ্যাক ভাবল— আর একবার যাবে সে রাক্ষসের বাড়িতে। এইবারই শেষ যাত্রা। যদিও এই অভিযানে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। কারণ রাক্ষস আর তার বউ দুজনেই খুব ক্ষিপ্ত জ্যাকের ওপর। হাতের সামনে পেলেই মুণ্ডুটা ছিঁড়ে কপাত করে গিলে খেয়ে ফেলবে।


কিন্তু দুঃসাহসী জ্যাক ওসব ভেবে ভয় পেল না।কোনো এক চমৎকার সকালবেলায় সে ঘুম ভাঙার পর বাগানে এল। সবুজ শিমের গাছটার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর লাফ মেরে গাছের উপর উঠল সে।লতাপাতা ধরে উঁচুতে উঠতে লাগল ।উঠতে উঠতে, উঠতে উঠতে একেবারে গাছের শেষ মাথায় গিয়ে উঠল সে।সামনে সেই অনন্ত শাদা রাস্তা। মাথার ওপর সূর্য জ্বলজ্বল করছে। জ্যাকের খুব ভারমুক্ত মনে হল নিজেকে। গুনগুন করে গান গাইছে সে। যেন কিছুই হবে না—
এ-রকম ভাব তার।উঁচু বাড়িটার সামনে গিয়ে একটু সতর্ক হল জ্যাক। দরজার সামনে রাক্ষসের বউ ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে । একটু অপেক্ষা করল জ্যাক । লম্বা মহিলাটা বাড়ির পেছন দিকে যেতেই সে একছুটে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। জ্যাক একলাফে চলে গেল রান্নাঘরে । চারিদিকে দেখতে লাগল— নিরাপদে কোথায় একটু লুকানো যায়। চুলো জ্বলছে। কিছু একটা ভাজা হচ্ছে। এখানে লুকানো যাবে না,খুবই গরম। রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট্ট ঘর আছে। সেখানে মালপত্র রাখা হয়।
জ্যাক এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল । যেই-না সে লুকিয়েছে ঠিক তখনই রাক্ষসের বউ ভেতরে প্রবেশ করল। আর একটু পরেই শব্দ শোনা গেল— দুম দুম
দুম । রাক্ষস এসে পড়েছে। বাড়িঘর থরথর করে কাঁপছে।
রাক্ষস এসেই চেঁচিয়ে উঠল— নাশতা চাই। নাশতা কই? তারপরই রাক্ষসটা নাক উঁচু করে গন্ধ নিতে লাগল । সন্দেহজনকভাবে সে চেঁচাতে শুরু করল—হাঁউ মাঁউ খাঁউ তারপরই যেন কাউকে শাসাচ্ছে এমনভাবে রাক্ষসটা বলতে লাগল—হাঁউ মাঁউ খাঁউ। ব্রিটিশ মানুষের গন্ধ পাঁউ।জীবিত বা মৃত হোক, তার নেই ছুটি।ব্রিটিশের মাংস দিয়ে খাব আজ রুটি।এই প্রথম তার বউ স্বামীকে কোনো বাধা দিল না। বরং সে বলল,হয়তো তোমার কথাই ঠিক। আমিও কেমন গন্ধ-গন্ধ পাচ্ছি।

সে রান্নাঘরে গেল। চুলোর ভেতরটা, আশপাশ পরীক্ষা করে দেখল। চুলোতে তখন তিনটে ভেড়াকে রান্না করা হচ্ছে। ভেড়া তিনটেকে নিয়ে নাশতার টেবিলে রাখল রাক্ষসের বউ। রাক্ষস তার নাশতা খাওয়া শুরু করল তখন। ওদিকে সেই লম্বা বউটা সারা ঘরে, টেবিল-চেয়ারের তলায়, এমনকি বড় আলমারির ভেতরে—
সবখানেই খুঁজল । যদি কাউকে পাওয়া যায়! রাক্ষস বলেই চলেছে,আমি কিন্তু ব্রিটিশ-বালকের গন্ধ পাচ্ছি।
হয়তো সেই নচ্ছারটি আবার এসেছে। এবার সেই মুরগি-চোর হারামজাদাকে যদি পাই তবে তার আর রক্ষা নাই। একটানে ওর ধড়-মুণ্ডু আলাদা করে তবে আমার শান্তি!
লম্বা বউটা আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করল। কিন্তু সে একবারের জন্যও ভাবল না যে, রান্নাঘরের ওপাশে ছোট্ট ঘরটায় কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। হতাশ হয়ে
সে বলল,
-কিন্তু কাউকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।
– ঠিক আছে । হয়তো অন্য কোনো গন্ধ।
রাক্ষসটা নাশতা খেয়ে বিশাল দুটো ঢেকুর তুলল। তারপর বউকে বলল, জলদি আমার খুদে বাজনাটা নিয়ে এস। বউ সোনার তৈরি সুন্দর ছোট্ট একটা পিয়ানো এনে
দিল রাক্ষসকে। তারপর মিষ্টি করে বলল,
– বাজো বাজো বাজনা বাজো।

জ্যাক ও শিমগাছ পর্ব৩

সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনা থেকে আপনমনেই মিষ্টি সুর ভেসে এল। অবাক কাণ্ড বটে! আপনা থেকেই অপূর্ব সুর বাজতে লাগল সেই পিয়ানোয় । সেই সুরে বিমোহিত হয়ে রাক্ষসটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের আবেশে ঢলে পড়ল । ছোট্ট ঘরে তখন জ্যাক রাক্ষসের নাক-ডাকানি শুনতে পেল। গরর, গরর— একটানা গর্জন ।জ্যাক আস্তে ধীরে বেরিয়ে এল । তখন রাক্ষসের বউ ঘরের বাইরে গেছে কোনো একটা কাজে । পিয়ানোটা তখনও বেজেই চলেছে । এক অপূর্ব স্বর্গীয় সুর । যেন রাশি রাশি আনন্দের ফুল ঝরে পড়ছে সেটা থেকে । বাজনাটা বগলদাবা করতেই তার সুর তোলা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। জোরে এবং পরিষ্কারভাবে সেই যন্ত্র থেকে একটাই চিৎকার তখন বের হতে লাগল— বাঁচাও, বাঁচাও ৷
যন্ত্রটা নিয়ে জ্যাক একলাফে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। রাক্ষসটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জেগে মুগুর হাতে নিয়ে জ্যাকের পেছন ধাওয়া শুরু করল । সেই ধপধপে শাদা রাস্তা দিয়ে জ্যাক ছুটছে। পেছনে মুগুর-হাতে রাক্ষস।চারপাশে কোনো দয়ালু মেঘ নেই যে জ্যাক কোথাও লুকিয়ে পড়বে। রাক্ষসটাও সতর্ক পা ফেলে ফেলে দৌড়াচ্ছে। আর সেই বাজনা-যন্ত্র থেকে অনবরত
চিৎকারধ্বনি বেরুচ্ছে— বাঁচাও, বাঁচাও ৷
তারপর সরসর তীব্রবেগে বাতাসের বেগে ছুটতে ছুটতে জ্যাক এসে পৌছাল শিমগাছের কাছে। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো জ্যাক লাফ দিয়ে আঁকড়ে ধরল গাছের লতাপাতা।
করে নিচে নামতে লাগল। কিন্তু অর্ধেক পর্যন্ত যখন নেমেছে অমনি নড়াচড়া শুরু করল গাছটা । যেন প্রচণ্ড ঝড়ে নড়ছে। জ্যাক একপলকের জন্য উপরে
তাকিয়ে ভয়ে হিম হয়ে গেল। রাক্ষসটা শিমগাছের উপরে জড়াজড়ি করে নিচে নামার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাক্ষসের ওজন অনেক। রাক্ষসটা লতানো গাছে চড়তেই গাছটা যেন ছিড়ে পড়বে এমন অবস্থা। কাজেই রাক্ষসটাকে আর নামতে হচ্ছে না।.আপনাআপনি সে নেমে আসছে নিচে।মাটির প্রায় কাছাকাছি এসে পড়তেই জ্যাক চিৎকার করে বলতে লাগল,
– মা, মা। কোথায় তুমি? আমার কুড়োলটা নিয়ে এস। ছোট্ট কুড়োলটা।গাছের বেশ উপর থেকেই ঝপ করে মাটিতে লাফিয়ে পড়ল জ্যাক। মা ততক্ষণে
কুড়োলটা হাতে তুলে দিল জ্যাকের। হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল বাগানে। বিশাল ছায়া। কারণ রাক্ষসটা ততক্ষণে আরো কাছে এসে পড়েছে।জ্যাক তখন শিমগাছের গোড়াটা কাটছে। প্রাণপণ শক্তিতে কাটছে। কয়েকটা
আচ্ছামতো কোপ দিতেই গাছের গোড়াটা কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল এক আর্তনাদ শোনা গেল । সেই বিশাল রাক্ষসটা আর্তচিৎকারে ধুপ করে নিচে পড়ল ।বাগানে ছিল একটা গর্ত। সেই গর্তে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে রাক্ষসের দফারফা। প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাক্ষসটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
ওঠার শক্তি নেই তার। একটুক্ষণ পর রাক্ষসের প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল ।ভাগ্যিস রাক্ষসটা পড়েছিল সেই গর্তে! সেখান থেকে বেচারা আর উঠতেই পারে নি। বাগানের মধ্যে সেই গর্ত মাটি দিয়ে ভরতে জ্যাকের লাগল তিন দিন।
যা হোক, জাদুর শিমগাছের এখানেই ইতি।গাছটা কেটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ হয়ে গেল । রাক্ষসটাও মারা গেল ।অবশ্যি আমরা আজও জানি না, রাক্ষসের বউ আর সেই উঁচু বাড়িটা কেমন অবস্থায় আছে। মেঘের দেশে সেই শাদা চওড়া অনন্ত রাস্তাটা এখনো আছে কি না।যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, বজ্রপাত হয় আর কিড়মিড় গর্জন শোনা যায় তখনজ্যাক তার মাকে বলে,

নিশ্চয়ই রাক্ষসের রাক্ষুসে বউটা স্বামীর শোকে আর্তনাদ করছে। তাইআকাশে বজ্রের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরে জ্যাক আর তার মা মহাসুখে দিন কাটাতে লাগল । যখন তাদের টাকা-পয়সার দরকার পড়ে তখন তারা ছোট্ট মুরগিটাকে বলে— ডিম, ডিম,ডিম। অমনি তারা সোনার ডিম পেয়ে যায়।যখন তাদের কাজকর্ম করতে ভালো লাগে না, মন ভারি হয়ে থাকে তখন তারাসেই বাদ্যযন্ত্রটিকে বলে,

– বাজো, বাজো, বাজনা বাজো।
অমনি মন-ভুলানো হৃদয়-জুড়ানো সুরের পরশে তাদের সব খারাপ-লাগা দূর হয়েযায়। গানের সুরে সুরে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সেই অবাক-করা বাজনা-যন্ত্রের
গান শোনার জন্য দূর বহুদূর থেকে মানুষজন আসে তাদের বাসায়। হাসি-আনন্দে তখন সবাই মেতে ওঠে। জ্যাক আর তার মা চেনা-অচেনা সবাইকেই আপন দলের
মানুষ মনে করে।এভাবেই লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল জ্যাক আর তার শিমগাছের গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *