দাজ্জাল কী দাজ্জাল কে
হে উম্মত! হুশিয়ার হও
কিয়ামতের বড় আলামতগুলো প্রকাশের ধারাবাহিকতা বিভিন্ন হাদিসে পাওয়া যায়। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে আছে, নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশ পাবে- পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় এবং জমিন ফুঁড়ে অদ্ভুত প্রাণী। এ দুটির মাঝে যেটি আগে প্রকাশ পাবে অন্যটি তার পরপরই দেখা যাবে।’ এ হাদিসে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদ প্রথমে প্রকাশের কথা উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম শরিফের আরেক হাদিসে ভিন্ন ক্রমধারা বলা হয়েছে।
নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘ছয়টি আলামত প্রকাশের আগে ভাল কাজে মন লাগাও। সেগুলো হল- ধোঁয়া, দাজ্জাল, দাব্বাতুল আরদ, পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয়, বিশেষ ফেতনা।’
হাদিসে ধোঁয়া ও দাজ্জালের ফেতনার কথা আগে রয়েছে। আরও অন্যান্য হাদিসে ধারাবাহিকতার ভিন্নতা পাওয়া যায়। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বলেন, সর্বপ্রথম আবির্ভাব হবে দাজ্জাল। এটা সবচেয়ে বড় নিদর্শন। এরপর ঈসা (আ.)-এর আগমন হবে। তারপর ইয়াজুজ মাজুজ আসবে। তারপর দাব্বাতুল আরদ এবং সর্বশেষে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হবে। কিয়ামতের খুব কাছাকাছি সময়ে নিদর্শনগুলো একের পর এক দ্রুত প্রকাশ পাবে।
জানেন কী দাজ্জাল কে
সে হবে আদম সন্তানদেরই একজন। মুমিনদের পরীক্ষার জন্য আল্লাহ পাক তাকে অলৌকিক কিছু শক্তি দেবেন। তার দৈহিক ও চরিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে নবীজী (সা.) বলেছেন, দাজ্জালের চেহারার এক পাশ ভ্রু ও চোখ থাকবে না। দাজ্জাল এসেছে আরবি ‘দাজাল’ শব্দ থেকে। যার অর্থ- সত্যকে ঢেকে ফেলা, ছদ্ম আবরণে লুকিয়ে রাখা, প্রতারিত করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি। দাজ্জাল শব্দের সাধারণ অর্থ হল- ‘শ্রেষ্ঠ মিথ্যুক’। সে মিথ্যা জাদুর মাধ্যমে ইসলামের সত্যতা ঢাকার চেষ্টা করবে।
কানা দাজ্জালের কারসাজি
মহা-দুর্ভিক্ষের সময় দাজ্জাল খাদ্য নিয়ে এসে বলবে, ‘আমি হচ্ছি সমগ্র জগতের প্রভু। হে মানুষ! তোমরা আমার প্রতি ঈমান আন আমি তোমাদের।
খাদ্য দেব, পানীয় দেব, সম্পদ দেব, যা চাও- সব দেব’। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘স্মরণ রেখ! দাজ্জালের কিন্তু একচোখ কানা হবে। তোমাদের প্রভু কানা নন’ (বুখারি)
দাজ্জাল সেজে প্রতারণা
নবীযুগে মদিনায় এক ইহুদি ছিল। নাম তার ইবনে সাইয়াদ। তার অলৌকিক কাজ-কর্মের খবর শুনে নবীজী (সা.) তাকে দাজ্জাল সন্দেহ করেছিলেন। একদিন উমর (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে নবীজী (সা.) ইবনে সাইয়াদের খবর নিতে গেলেন। নবীজী (সা.) তার পিঠে স্পর্শ করে বললেন, ইবনে সাইয়াদ! তুমি কি বিশ্বাস কর আমি আল্লাহর রাসূলদের একজন?
ইবনে সাইয়াদ নবীজীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আপনাকে মূর্খদের নবী মনে করি। এরপর সে পাল্টা নবীজীকে প্রশ্ন করল, আপনি কি মানেন যে, আমি আল্লাহর রাসূল?
নবীজী বললেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের ওপর ঈমান আনলাম। স্বপ্নে তুমি কী দেখ?
সে বলল, সত্য-মিথ্যা দুটোই দেখি ।
নবীজী বললেন, তোমার ব্যাপারতো খুবই গড়বড় মনে হচ্ছে। আচ্ছা! বলত, আমি এখন কী ভাবছি?
ইবনে সাইয়াদ বলল, আপনি এখন দুখ… দুখ… ভাবছেন ।
নবীজী বললেন, তুমি তো ঠিকই বলে ফেলছিলে। জেনে রেখ! নির্ধারিত সময়ের আগে তুমি কিছুই করতে পারবে না।’
আসলে তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মনে ‘সুরা দুখান’ ছিল। ইবনে সাইয়াদ জাদুকর হওয়ায় পুরোপুরি আঁচ করতে পারেননি। তাই সে শুধু দুখ দুখ বলেছে। এসব দেখে উমর (রা.) বললেন, আমাকে অনুমতি দিন, এক্ষুনি এ জাদুকরের মস্তক উড়িয়ে দিই।
নবীজী বললেন, থাম! এ যদি প্রকৃত দাজ্জাল হয়, তবে ঈসা বিন মারিয়ামের হাতেই সে নিহত হবে।’ (মুসলিম)
সালেম বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) কে
বলতে শুনেছি, ‘একদিন নবী কারিম (সা.) উবাই বিন কাবকে সঙ্গে নিয়ে
ইবনে সাইয়াদের খেজুর বাগানে গেলেন। নবীজী দেখলেন, ইবনে সাইয়াদ ফিসফিস করে কি যেন সব বলে যাচ্ছে। পেছন থেকে ইবনে সাইয়াদের মা বলল, পুত্র আমার! মুহাম্মদ এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ইবনে সাইয়াদ ফিসফিসানি বন্ধ করে দেয়। তখন নবীজী বললেন, তোমার মা না এলে আজই বোঝা যেত, তুমি দাজ্জাল না অন্য কেউ।’ (মুসলিম)
আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একবার আমরা হজ বা উমরা করতে মক্কায় রওনা করি। সঙ্গে ছিল ইবনে সাইয়াদ। পথে আমরা বিশ্রামের জন্য বসলাম। ইবনে সাইয়াদ আমার পাশেই বসেছে। যেহেতু সে সন্দেহজনক ছিল, তাই মনে মনে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর সে তার মালপত্র আমার মালপত্রের কাছে এনে রাখল। আমি বললাম প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তাই একসঙ্গে রাখার চেয়ে আলাদা রাখাই ভালো। তোমার মালগুলো ওই বৃক্ষের নিচে রেখে এসো।
ইবনে সাইয়াদ মালপত্র নিয়ে দূরের বৃক্ষের নিচে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বকরির দুধ পরিবেশন হল। সে আমার জন্য দুধ নিয়ে এলো। বলল, পান কর হে আবু সাঈদ! আমি বললাম, এমনিতেই অনেক গরম পড়েছে, এর মধ্যে দুধ পান করলে পেটের অবস্থা বারোটা বেজে যাবে। আসলে আমি তার থেকে দুধ পান করতে চাচ্ছিলাম না। সম্ভবত, সে আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে।
সে বলল, বন্ধু আবু সাঈদ! আমার মন চায় কোন গাছের সঙ্গে ফাঁস নিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলি। মানুষের এই আচরণ আমার আর সহ্য হয় না। হে আবু সাঈদ তোমরা তো নবীজীর হাদিস সম্পর্কে বেশি জান। তুমি নিজেও অনেক হাদিস বল। নবীজী কি বলেননি, দাজ্জালের কোন সন্তান হবে না। অথচ মদিনায় আমি সন্তান রেখে এসেছি। নবীজী কি বলেননি দাজ্জাল মক্কা মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। অথচ আমি মদিনা থেকেই মক্কায় যাচ্ছি।
আবু সাঈদ বলেন, ইবনে সাইয়াদের কথা শুনে আমার হৃদয় দরদে ভিজে ওঠল। এমন সময় সে বলল, দাজ্জালের জন্মস্থান এবং সে এখন কোথায় আছে তা আমি জানি। একথা শুনে আমি বললাম, তোমার ধ্বংস হোক। তোমার কপাল পুড়ুক। (মুসলিম)
ইবনে সাইয়াদ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের বিশুদ্ধ মত হল, সে প্রকৃত দাজ্জাল ছিল না। তবে মিথ্যুক ছিল। জাদুও জানত। গণকদের থেকে সে তথ্য নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। ধারণা করা হয়, শেষ জীবনে সে তওবা করে নিজেকে শুধরে নিয়েছে।
কোঁকড়া চুল, এক চোখ কানা
সত্যিকারের দাজ্জাল দেখতে খাটো হবে। দুই পায়ে সমস্যার কারণে হাঁটতে অসুবিধা হবে। চুল অস্বাভাবিক কোঁকড়া এবং আলুথালু ধরণের হবে। তার চোখ ফোলা হবে। বাম চোখ কানা হবে। গায়ের রং হবে ধবধবে সাদা। কপাল হবে চওড়া। তার দু’চোখের মাঝে লোখা থাকবে ‘কাফের’। নাফে (রা.) বলেন, নবীজী (সা.) বলেছেন, “শীঘ্রই আরবে যুদ্ধ বাধবে এবং আল্লাহ তোমাদের বিজয় দেবেন। এরপর পারস্যে ও রোমের সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধ হবে। সেখানেও তোমরা বিজয়ী হবে। সবশেষে দাজ্জালের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। এ যুদ্ধেও আল্লাহ তোমাদের জয়ী করবেন।
আল্লাহ আল্লাহ জিকিরে খিদে মিটবে
নবীজী (সা.) বলেন, ‘দাজ্জালের আগে তিনটি বড় বড় দুর্ভিক্ষ আসবে। প্রচন্ড ক্ষুধা ও দারিদ্রতা ছড়িয়ে পড়বে। প্রথম বছর আল্লাহ আসমানকে এক তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে এক তৃতীয়াংশ ফসল বন্ধ করতে আদেশ করবেন। দ্বিতীয় বছর আল্লাহ আসমানকে দুই তৃতীয়াংশ বৃষ্টি এবং জমিনকে দুই তৃতীয়াংশ ফসল ফলানো বন্ধ করতে আদেশ করবেন। তৃতীয় বছর আল্লাহ আসমানকে সম্পূর্ণ বৃষ্টি এবং জমিনকে সম্পূর্ণ ফসল ফলানো বন্ধ করতে আদেশ করবেন। ফলে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হবে না। একটি শস্যও ফলবে না।
এসব শুনে সাহাবিরা বললেন, তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? জবাবে নবীজী (সা.) বললেন, আল্লাহু আল্লাহু, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জিকিরে মানুষের খিদে ও পিপাসা মিটবে।’ (ইবনে মাজা)
শেকলে বাঁধা বিশাল দেহী মানুষ
তামিম দারি (রা.) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, কোন এক অচীন দ্বীপে দাজ্জালকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রায় ত্রিশজন সঙ্গীসহ তামীম দারি দাজ্জালকে দেখতে পায়। দাজ্জাল নিজেই স্বীকার করেছে, সে-ই দাজ্জাল। শেষ জমানায় তাকে বাঁধনমুক্ত করা হলে সে আত্মপ্রকাশ করবে।
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন মদিনার কোনো এক গলিতে ইবনে সাইয়াদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললে সে রেগে আগুন হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে বোন হাফসার ঘরে চলে আসি। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ইবনে সাইয়াদকে তুমি রাগিয়েছ কেন? তুমি কি জান না, দাজ্জাল রেগে যাওয়ার পরই বিশাল দেহ নিয়ে মানুষের সামনে আসবে। (মুসলিম)
দাজ্জালের ভ্রমণ-গতি
নবী কারিম (সা.) কে দাজ্জালের গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি (সা.) বলেন, ‘বাতাসে ভেসে যাওয়া মেঘের চেয়েও দ্রুত হবে দাজ্জালের ভ্রমণ গতি’। (মুসলিম)
সবখানে যাবে সে মদিনা ছাড়া
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘মক্কা-মদিনা ছাড়া পৃথিবীর এমন কোনো শহর নেই, যেখানে দাজ্জালের ধ্বংসযজ্ঞ চলবে না। (বুখারি ও মুসলিম) অন্য বর্ণনায় আছে, ‘মদিনার দরজায় সবসময় ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। দাজ্জাল এবং মহামারী মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মিহজান বিন আদরা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ভাষণ দেয়ার সময় নবী কারিম (সা.) বললেন, ‘দাজ্জাল এসে উহুদ পাহাড়ে উঠে মদিনার দিকে তাকিয়ে বলবে, তোমরা কি ওই সাদা ঘরটি দেখতে পাচ্ছ? এটি আহমদের মসজিদ। এরপর মদিনায় ঢুকতে চাইলে দেখবে প্রবেশ পথে ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে আছে। সে হতাশ হয়ে সাবখাতুল জুরুফে গিয়ে প্রচন্ড জোরে মাটিতে আঘাত করবে। মদিনায় তখন তিনটি ভূকম্পন হবে। সব পাপীষ্ঠ এবং মুনাফিক তখন মদিনা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের সঙ্গে চলে যাবে। (মুসনাদে আহমদ)
আরবিতে ‘সাবখা’ বলা হয় জলাভূমিকে। সাধারণতঃ মদিনার মাটিকে সাবখা বলে। কিন্তু মদিনার উত্তর সীমান্ত বিশেষভাবে সাবখা নামে পরিচিত। আর ‘জুরুফ’ মদিনা থেকে তিন মাইল উত্তরে একটি উপশহর। অনেকেই বলেছেন, শামের সড়ক থেকে কাসাসিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকাকেই জুরুফ বলা হয়। বর্তমানে জুরুফকে-বুহাই আল আযহার বলা হয়। কিন্তু হাদিসের ভাষ্য। অনুযায়ী জুরুফ বর্তমান মাররে কানাত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। মোটকথা উহুদ পাহাড়ের পেছনে কোন এক জলাভূমির কাছাকাছি এসে খুব জোরে আঘাত করবে দাজ্জাল ।