দৈত্য ও মলির গল্প পর্ব ১
দৈত্য ও মলির গল্প
তারা ছিল তিনবোন ।
ভাইবোনদের মধ্যে ওরাই বড়। এক গরিব চাষির সন্তান তারা। চাষির
অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। চাষি আর চাষিবউ জানত না, কীভাবে ওদের খাবার
দেবে। কোথেকে ওদের কাপড়-চোপড় আসবে। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই
থাকত । প্রতিদিনই টাকা-পয়সার দরকার। ছেলেমেয়ে বেশি বলে চাহিদাও বাড়ছে
প্রতিদিন । কিন্তু চাষির তো আর জমি বাড়ছে না । অতি পরিশ্রম করেও চাষি উপার্জন
বাড়াতে পারছে না। চাষির বউও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে। রান্নাবাড়ার
ফাঁকে অন্যের জামা সেলাই করে। অন্যের বাসায় কাজ করে। কিন্তু অভাব তাদের
কমে না। বরং বেড়েই চলে ।
বাবা-মা তখন ভেবে ভেবে একটা উপায় বের করল। কোনো কিছু করে বাঁচতে
তো হবে। তিন মেয়েকে নিয়ে একদিন বনের গভীরে চলে গেল বাবা-মা। ওদের
ছেড়ে দিল বনের মধ্যে। গরিব বাবা-মার হৃদয় ছিল পাথরের মতো। মেয়েরা এবার
নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজে নেবে। নইলে অন্য শিশুদের বাঁচানো তাদের জন্য
মুশকিল । খাবার না-পেয়ে অভাবে সবাইকে মারা যেতে হবে।
বোন তিনজন বনের পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল খাবার আর আশ্রয়ের জন্য । পথ
চিনে বাড়ি ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। ঘুরতে ঘুরতে তারা তিনজন একসময়
বনের শেষ মাথায় এসে পৌঁছল । ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। তিনবোন
হঠাৎ করেই দেখতে পেল, দূরে একটা জানালা থেকে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে
তারা হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়ির দরজায়
খুলে দিল দরজা।
আমাদের কি একটু খাবার দেবেন আপনিং আমরা পার ক
পেটে আমাদের ভীষণ খিদে।
মহিলা বলল,
লক্ষ্মী মেয়েরা আমার, আমি তোমাদের খাবার দে
একজন মস্তবড় দৈত্য। সে যখন বাড়ি ফিরবে আর তোমাদের
কিন্তু তোমাদেরই ধরে খেয়ে ফেলবে। তোমরাই
পরিণত
রাতের খাবারে।
বড় মেয়েটা সব শুনে বলল,
তাতে আমরা ভীত নই, আমাদের খেয়ে ফেলুক তাতেই আমরা খুশি। কিন্তু
আমরা খুবই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত। না পেরে আমরা বাঁচব কীভাবে
এই না বলেই সে ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল।
দৈত্যের বউ তখন ভাবল, মন্দ কী! ওরা যখন নিজেরাই
দিতে চায় তখন অসুবিধা কোথায়! তার স্বামী রোজ রোজ পাশি আর
খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। তিনটে শিশুকে পেলে তোল জন
আটকে রাখা যাক তিনজনকে। তাই মহিলা বলল,
এস এস, ভেতরে এস মেয়েরা। আমি তোমাদের কিছু রুটি আর দুধ
তারপরে তোমরা আগুনের পাশে বসে খানিকক্ষণ গরম হয়ে নিও।
মহিলাকে ধন্যবাদ দিল তিনবোন। ঘরের ভেতরে ঢুকল তারা। ঘুণাক্ষরে
দৈত্যের বউয়ের মনের বাসনা বুঝতে পারল না। প্রচুর পাবার দি
তিনবোন খাওয়া-দাওয়ার পর একটু চাঙা হয়ে উঠল। শরীরের অন্ত নে
কমে গেছে। চোখে যেন ঘুম নেমে আসছে। কোথায় ঘুমাবে তারা? এমন
মড়মড় শব্দ কানে এল তাদের। দৈত্য ফিরে এসেছে। যেন ঝড়ের শব্দ শোনা যাবে।
দৈত্যের বউ তখন বলল,
– কোনো শব্দ করো না তোমরা। এস আমার সঙ্গে। এই বিশাল বাক্সের ভেতরে
লুকিয়ে থাক। দৈত্যের খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত এক্কেবারে চুপ থাকবে। যেন দৈত্য
তোমাদের খুঁজে না পায় ।
দৈত্য ঝড়ের বেগে হাঁউমাউ হাউমাউ করতে করতে ঘরে ঢুকল। তার
বিশাল হাতের থাবা মেলে ধরল চোখের সামনে। তারপর নাক উঁচু করে গন্ধ নিতে
লাগল বাতাসে।
হাঁউ মাঁউ খাঁউ হাঁউ মাঁউ পাঁউ
মানুষের গন্ধ পাঁউ।
দৈত্যের বউ কাণ্ড দেখে রেগে উঠল। কপট রাগ তার।
– সবসময়ই তুমি গন্ধ খুঁজে বেড়াও। ভালো ছেলের মতো চুপচাপ চেয়ারে বসে
পড়। আমি তোমার রাতের খাবার তৈরি করে রেখেছি। সুবোধ ছেলের মতো
খেয়েদেয়ে নাও। তারপর তোমার জন্যে চমক অপেক্ষা করছে।
রাতের শেষ প্রহরে দৈত্যটা ধীরে ধীরে ঘরে এল।
হাতে তার ত্রিমুখি একটা বর্শা। সে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেখল, দড়ির বালা
কার কার হাতে। তাদের বুকে আমূল বসিয়ে দিল বর্শার ফলা। তারপর সে বিকট
শব্দে হেসে উঠল হাউমাউ করে। কয়েকদিন জবর জমবে খাবার পালা। অনেকদিন
পর পাওয়া গেছে মানুষের বাচ্চা।
তারপর দৈত্যটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এই ভয়াবহ কাজ দেখে দুইবোনের ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠেই ওরা কান্না শুরু
করল আতঙ্কে।
মপি তখন বলল – চুপ, একদম চুপ। এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।
দৈত্য আর তার বউ জেগে ওঠার আগেই পালাতে হবে। নইলে প্রাণে বাঁচব না
আমরা কেউ।
শেষরাতের দিকেই তিনবোন দৈত্যের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জোরে ছুট
লাগাল তারা। দৈত্যের নাগালের বাইরে যাওয়া চাই।
সকাল হতে না হতে তারা এসে পৌঁছল এক রাজপ্রাসাদের সামনে। মলি
দুইবোনকে নিয়ে সাহসের সাথে রাজপ্রাসাদের সিংহদরজায় ধাক্কা দিতে লাগল ।
পাহারাদাররা দরজা খুলল। মপি বলল,
– শিগগির আমাদের রাজার সামনে নিয়ে যাও।
রাজা তাদের দেখেই বললেন, তোমরা কারা?
আমরা ভারি গরিব তিনবোন। এইমাত্র আমরা এক নিষ্ঠুর দৈত্যের খপ্পর থেকে
পালিয়ে এসেছি। মহামান্য রাজা, আপনার রাজ্যে এ-রকম ভয়ংকর শয়তান বাস
করবে এ হতে পারে না।
মলি সাহস করে রাজাকে এই কথা বলল। রাজা তখন বললেন,
সব তো শুনলাম। কিন্তু বলা যেমন সোজা, কোনো কাজ করা তত সোজা
নয়। তুমিই না-হয় বল, আমি কীভাবে দৈত্যকে বধ করব?
– দৈত্যের তলোয়ারটা কেড়ে নিতে পারলেই হল। তাহলেই সমস্যার সমাধান
হয়ে যাবে।
-শোনো ছোট্ট মেয়ে, তুমি কি তলোয়ারটা নিয়ে আসতে পারবে আমার জন্যে?
মহামান্য রাজা, নিশ্চয়ই আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি আমি দৈত্যের
তলোয়ার নিয়ে আসতে পারি তবে আমার জন্যে আপনি কী করবেন?
আমি কথা দিচ্ছি আমার বড়ছেলের সঙ্গে তোমার বড়বোনের বিয়ে দেব।
আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করব না মহামান্য রাজা।
তারপর তিনবোন রাজার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে পেটপুরে নাশতা খেল। সে কী
রাজকীয় খাবার-দাবার! মলিরা জীবনে এসব খাবার কল্পনাও করতে পারে না।
সেদিনই সন্ধ্যায় – মলি একা একা রওনা দিল দৈত্যের বাড়ির দিকে। রাতের
অন্ধকারে কাউকে কিছু না বলে লুকিয়ে লুকিয়ে মলি দৈত্যের শোয়ার ঘরে ঢুকে
গেল। দৈত্যের সেই বিখ্যাত তলোয়ারটা ঝুলছে বিছানার ওপরে। তলোয়ারটা
একটু নেড়েচেড়ে দেখল মলি। এমন সময় তার কানে এল সেই পায়ের শব্দ।
দৈত্যের আগমন ঘটেছে। হাউমাউ করে দৈত্য রাতের খাবার খেল । ঘুমে ঢুলুঢুলু
তার চোখ। খাওয়ার পরই দৈত্য বিছানায় এসে ধপ করে শুয়ে পড়ল । কিছুক্ষণের
মধ্যেই ভয়ংকরভাবে নাক ডাকতে লাগল সে। সেই শব্দে ঘরটা কেঁপে কেঁপে
উঠতে লাগল ।
মলি
মলি নিঃশব্দে বিছানার তলায় লুকিয়ে রইল। দৈত্য যখন ঘুমে অচেতন,
তখন ধীরে ধীরে তলোয়ারটা হাতে তুলে নিল । খুবই ভারী তলোয়ার । দরজা খুলে
কোনোমতে সে বাইরে এল। কিন্তু হঠাৎ করেই পাথুরে মেঝেতে তলোয়ারের ঘষা
লেগে ঝনর ঝনর শব্দ হল। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দৈত্যের। ঘুম থেকে
জেগেই বিকট চেঁচামেচি শুরু করে দিল দৈত্যটা। একলাফে সে বেরিয়ে এল ঘর
থেকে। ত্রিমুখি বর্শাটা হাতে নিতে ভুলে গেল সে। হ্যাঁ, সেই ছোট্ট মেয়েটি
তলোয়ার নিয়ে পালাচ্ছে। বড় বড় পা ফেলে দৈত্যটা ছোট্ট মেয়েটির পিছু ধাওয়া
করল ৷ মলি ছুটছে অতি দ্রুত। প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে মলি এসে হাজির হল
‘একচুল’ পুলের সামনে । পুলটার নাম ‘একচুল’, কারণ এর চেয়ে সরু আর হালকা
পুল পৃথিবীর কোথাও নেই। মলি অনায়াসে সেই পুল পেরিয়ে খালের অন্যপাড়ে
চলে গেল । কিন্তু দৈত্যটা পুলে উঠতে পারল না। অতবড় শরীর নিয়ে পুলে
উঠবে সে কীভাবে! মলি অন্যপাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল । দৈত্যটা তখন বিকট
তর্জন-গর্জন শুরু করেছে :
মলি, তোর মটকে দেব ঘাড়
তুই ফিরিয়ে দিয়ে যা আমার তলোয়ার।
আবার যদি সামনে তোকে পাই
তোর ঘাড় মটকে খাই ।
মলি তখন তলোয়ারটা হাতে তুলে নিয়ে দেখাল দৈত্যকে। আর হাসতে
হাসতে বলল,
আবার তোমার সাথে আমার দেখা হবে,
বলতে পারি না করে!
তারপর মলি বিজয়ের একটুকরো মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিল দৈত্যের উদ্দেশে।
আর দেরি নয়। এবার তাকে রাজপ্রাসাদে পৌছাতে হবে।
যখন মলি রাজার সামনে দাঁড়াল, রাজা তো মহাখুশি। চিরশত্রুর শক্তিমান
তলোয়ারটা এখন তাঁর আয়ত্তে। নিষ্ঠুর দৈত্যকে এবার একহাত দেখে নেয়া যাবে।
রাজা তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান নি। মলির বড়বোনের সাথে মহা ধুমধামে
বিয়ে হল বড় রাজপুত্রের । আয়োজন করা হল বিশাল অনুষ্ঠান। লোকজন প্রাণভরে
সেই বিয়েতে আনন্দ করল ।
রাজা তারপর একদিন মলিকে ডেকে বললেন,
– তুমি যদি দৈত্যের ঝুলিটা আনতে পার তবে আমায় পায় কে! ঝুলিটা থাকে
ওর বালিশের নিচে । ঝুলি এনে দিতে পারলে তোমার মেজোবোনের সঙ্গে আমার
মেজোছেলের বিয়ে দেব।
ঠিক আছে রাজা।
সাহস ভরে বলল মলি, আমি যতটুকু পারি ততটুকু আপনার জন্য করব। আমি
কাজকে কখনো ভয় পাই না।
আবার মলি একা একা একদিন দৈত্যের বাড়িতে গেল। অন্ধকার নেমে এলে মলি
লুকিয়ে দৈত্যের শোয়ার ঘরে ঢুকে গেল। মড়ার মতো চুপচাপ ঘাটের নিচে বসে
রইল সে। দৈত্য রাতের খাবার খেয়ে শরীরটাকে এলিয়ে দিল বিছানায়। তারপর
এমনভাবে নাক ডাকতে লাগল যেন আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে। মলির কোনো করা
হল না বালিশের নিচে হাতটা ঢুকিয়ে দিতে। আস্তে করে সে ঝুলিটা বের করে
আনল । দরজা দিয়ে যখন সে বের হতে যাবে তখনই ঝন করে বিশাল শব্দ হল।
মলির পায়ে ধাক্কা লেগে একটা লোহার পাত্র পড়ে গেছে মেঝেতে। পাত্র পড়ার শব্দে
জেগে উঠল দৈত্যটা।
আর কি দেরি করে দৈত্য? একলাফে বেরিয়ে এল বাইরে। প্রচণ্ড জোরে গজরাতে
লাগল। বিশাল পা ফেলে ফেলে ধাওয়া করতে লাগল মলিকে। মলিও কোনোমতে
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছুটতে ছুটতে হাজির হল একচুল পুলের পারে। অনায়াসে সে
পুল পেরিয়ে গেল। কিন্তু দৈত্যটা সেই পুল পেরুতে পারে না। মলি পুলের
একপাড়ে, দৈত্যটা অন্য পাড়ে। দৈত্যটা অন্ধ আক্রোশে চেঁচাতে লাগল,
মলি তোর গুঁড়িয়ে দেব মাথার খুলি
তুই ফিরিয়ে দিয়ে যা আমার ঝুলি।
আবার যদি সামনে তোকে পাই
তোর ঘাড় মটকে খাই।
দৈত্যটা মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তার জটবাঁধা চুল এপাশ-ওপাশ নড়ছে। কিন্তু মলি
দৈত্যের কথা শুনে হাসতে লাগল । ঝুলিটাকে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে দেখাতে লাগল দৈত্যকে।
আবার তোমার সাথে আমার দেখা হবে
বলতে পারি না করে!
এই-না বলেই মলি দৌড় লাগাল। এখুনি তাকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছতে হবে। মলি
রাজার হাতে তুলে দিল সেই ঝুলি। রাজার আনন্দ আর ধরে না। এখন সে অনেক
দামি দামি মণিমুক্তোর মালিক। ঝুলি ভরা ছিল দৈত্যের ধনসম্পদ।
মলির মেজোবোনের সঙ্গে বিয়ে হল রাজার মেজোছেলের। বিশাল আয়োজন।
সে কী জাঁকজমক! যারা বিয়েতে অতিথি হল তাদের আনন্দ যেন ধরে না। মলির
দুইবোনের ভাগ্যে নেমে এল অপার সুখ আর শান্তি ।
তারপর একদিন রাজা মলিকে বললেন,
আর একটা জিনিস আমি শুধু চাই। মলি, এই জিনিসটা তুমিই আমার জন্যে
এনে দিতে পার। এটা অবশ্য খুব সোজা কাজ নয়। যদি কাজটা করতে পার তবে
তোমার সঙ্গে বিয়ে দেব আমার ছোটছেলের।
কী সেই কাজ?
জানতে চাইল মলি ।……..