পিসিওএস (PCOS) কী এবং এ রোগে কোন ধরনের খাবার খাবেন (PCOS)?

পিসিওএস (PCOS) কী এবং এ রোগে কোন ধরনের খাবার খাবেন (PCOS)?

২৯ বছর বয়সী সামিরা বেশ কিছুদিন ধরে গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম থাকায় থাকায় বেশ সমস্যা হচ্ছে তার।

এই রোগকে সংক্ষেপে পিসিওএস (PCOS) বলে। চিকিৎসক তাকে জানিয়েছেন, নিয়মিত ব্যায়াম করে এবং সুষম খাদ্য তালিকা অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করে তাকে ওজন কমাতে হবে। নইলে এ সমস্যা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। এমনকি পরবর্তীতে তিনি গর্ভধারণ করলেও মিসক্যারেজের সম্ভাবনা রয়েই যাবে।

সামিরার মতো পিসিওএসের সমস্যায় ভুগছেন বাংলাদেশের অনেক নারী। এ রোগের পেছনে সাধারণত ওজন নিয়ন্ত্রণ না করা, সুষম খাবার না খাওয়া, জিনগতসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

তবে এটাও সত্যি যে, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন এনে পিসিওএস সমস্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। পিসিওএস (PCOS) কী এবং কীভাবে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনলে এ সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায় সেটাই জানাবো আজকের ফিচারে।

পিসিওএস (PCOS) কী

পিসিওএস (PCOS) কী?
অনেক সময় কোনো শব্দ পরিচিত হলেও সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের জানা থাকে না। তেমনই পিসিওএস (PCOS) কী সেটা নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন। ‘পলি’ শব্দের অর্থ অনেক এবং ‘পলিসিস্টিক’ শব্দের অর্থ অনেকগুলো সিস্ট।

এটি একটি হরমোনজনিত রোগ। পিসিওএস (PCOS) এর প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো জরায়ু থেকে ডিম নির্গত না হওয়া। মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে ডিম্বাশয়ের আশেপাশে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়।

ফলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বড় হয়ে যে ডিম বের হওয়ার কথা, তাতে বাঁধা সৃষ্টি হয় এবং এক সময় ডিম বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আর তখনই দেখা দেয় অনিয়মিত পিরিয়ড, বন্ধ্যাত্ব, ডায়াবেটিসের মতো নানা সমস্যা।

রোগটি সাধারণত প্রজননক্ষম নারীদের (১৮-৪৪ বছর) মধ্যে দেখা যায়।

পিসিওএস (PCOS) কী

যে লক্ষণগুলোর মাধ্যমে PCOS প্রকাশ পায়
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে আক্রান্ত নারীদের মাঝে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন-

১) অনিয়মিত মাসিক
পিসিওএস (PCOS) হলে অনিয়মিত মাসিক বা পিরিয়ডের সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। পিরিয়ডের স্বাভাবিক সময় সাধারণত ২১-৩৫ দিন। কিন্তু এই রোগটি হলে ২/৩ মাস পরপর পিরিয়ড হয়।

অর্থাৎ এ সমস্যায় একজন মহিলার বছরে নয়টিরও কম মাসিক হতে পারে। আবার অনেকদিন পর পিরিয়ড হলে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত রক্ত প্রবাহিত হতে দেখা যায়।

এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এমন নারীদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।

২) ডিম্বাশয়ের অস্বাভাবিকতা
কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় বড় হতে পারে এবং ডিমের চারপাশে ফলিকলস থাকতে পারে এমন হলে যার কারণে ডিম্বাশয় নিয়মিত কাজ করতে পারে না অনেক সময়।

পিসিওএস (PCOS) কী

৩) ত্বকে পিগমেন্টেশন
পিসিওএস হলে রোগীর শরীরে বিভিন্ন জায়গায় পিগমেন্টেশন দেখা দেয়। বিশেষ করে ঘাড়ের পেছনে, বগলে কালো দাগ থাকে। এই দাগের কারণে অনেকেই বেশ অস্বস্তিতে ভোগেন।

৪) ওজন বেড়ে যাওয়া
এ রোগে আক্রান্ত মেয়েদের ওজন ও বিএমআই (Body Mass Index calculator) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। বিএমআই ২৫-৩০ হলে ওভারওয়েট এবং ৩০ এর বেশি হলে তাদের ওবিস বলা হয়।

পিসিওএসে আক্রান্ত অন্তত ৫০ শতাংশ নারীই ওবিস। এদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ওষুধ না খেলে পিরিয়ড হয় না। অনেক সময় ওজন মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলেও এ সমস্যা হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

পিসিওএস (PCOS) কী

৫) ব্রণের সমস্যা বেড়ে যাওয়া
পিসিওএস থাকলে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বেশি নিঃসরণ হয়। যার কারণে ত্বকে বেশি তেল উৎপাদন হয়। এ থেকেই পুরো মুখে ছোট ছোট ব্রণ দেখা দেয়।

এই ধরনের ব্রণের মুখ কিছুটা চোখা হয়। মুখ ছাড়া পিঠ ও বুকেও হঠাৎ করে প্রচুর ব্রণ দেখা যেতে পারে এমন ধরনের সমস্যা।
৬) অবাঞ্চিত লোম ওঠা এবং চুল পড়া
পুরুষ হরমোন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেনের উচ্চ মাত্রার ফলে বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

অনেক সময় মুখের বাড়তি এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে যেমন- বুক, পেট, থাইয়ের ভিতরের অংশে অতিরিক্ত লোম (হিরসুটিজম) দেখা দেয়।

এছাড়া চুল পড়ার মতো সমস্যা বাড়তে থাকে এবং চুল পাতলা হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো টাক দেখা দিতে পারে।

পিসিওএস (PCOS) কী

৭) গর্ভধারণে অসুবিধা ও বন্ধ্যাত্ব
পিসিওএস থাকলে ডিম্বাণু নিঃসরণের চক্র অনিয়মিত হয় বলে গর্ভধারণে অসুবিধা হয়। যদি এ রোগসহ গর্ভধারণ সম্ভব হয়, তাহলে মিসক্যারেজের ঝুঁকি বাড়ে।

আবার বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণও পিসিওএস। এ রোগে আক্রান্ত ওবিস রোগীরা যদি নিজেদের ওজন ৫ শতাংশ কমাতে পারেন, তাহলে তাদের পিরিয়ড নিয়মিত হতে শুরু করবে।

আর ওজন ১০ শতাংশ কমাতে পারলে ডিম্বাশয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে এবং বন্ধ্যাত্বের সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে।

PCOS প্রতিরোধে খাদ্য তালিকা
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম থাকলে মেয়েদের শরীরে সাধারণত ইনসুলিনের পরিমাণ কম থাকে। আবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও ঠিকমতো কাজ করে না। যার কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়।

এ থেকে ডায়াবেটিস, হৃদরোগের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যাও দেখা যায়। তাই এ রোগের ক্ষেত্রে খাবার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি।

পিসিওএস প্রতিরোধের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি একটি সুষম খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধে খাদ্য তালিকায় যেসব খাবার রাখতে হবে সবসময়।

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
পিসিওএস প্রতিরোধে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খেতে হবে। তাই খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল

যেমন:ব্লুবেরি,স্ট্রবেরি,আপেল,পেঁপে,কমলা,মৌসুমি লেবু,তরমুজ,ডালিম,চেরি,লাল আঙুর,ব্ল্যাকবেরি ইত্যাদি। শাক-সবজির তালিকায় টমেটো, ব্রকলি, ফুলকপি, সবুজ শাক, কুমড়ো, ক্যাপসিকাম রাখুন।

এছাড়া শুকনো মটরশুঁটি, মসুর ডাল ও অন্যান্য ডালও রাখুন খাদ্য তালিকায়।

আমিষ
পিসিওএস রোগীদের জন্য উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য খুবই প্রয়োজন।

যেমন- মুরগির মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, দই, ডাল ইত্যাদি। প্রতিদিনের ডায়েট চার্টে প্রোটিন রাখতেই হবে।

অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যুক্ত চা ও মশলা
পিসিওএসে আক্রান্ত রোগীদের ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হতে পারে। এ সমস্যা কমাতে খাদ্য তালিকায় অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যুক্ত কিছু চা ও মশলা অবশ্যই রাখতে হবে।

যেমন: গ্রিন টি,ব্ল্যাক টি,আদা,কাঁচা হলুদ,গোল মরিচ,তেজপাতা,মৌরি,জিরা, ধনে, লবঙ্গ,দারুচিনি ইত্যাদি ধরনের খাবার।
স্বাস্থ্যকর চর্বি
ওমেগা- থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবারগুলো এ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

এ ধরনের খাবারের মধ্যে আছে স্যামন, টুনা, সার্ডিনস ও ম্যাকেরেল এর মতো বিভিন্ন ধরনের মাছ, চিয়া সিড, আখরোট, অ্যাভোকাডো, জলপাই তেল, বাদাম ইত্যাদি।

এসব খাদ্য পরিমিতভাবে গ্রহণের ফলে সহজেই ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে,সেই সাথে মুক্তি মিলবে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম রোগটি থেকেও অনেক সহজে হয়ে যায় ।

এ রোগে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS)-এ আক্রান্ত মহিলাদের ওজন নিয়ন্ত্রণের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। তাই ওজন বৃদ্ধি করতে পারে এমন খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। যে খাবারগুলো এ রোগে এড়িয়ে চলা প্রয়োজন-

চিনিযুক্ত পানীয় যেমন- কোক, পেপসি ইত্যাদি
বিভিন্ন ভাজা খাবার প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন:সসেজ,হ্যামবার্গার ও হট ডগ ইত্যাদি খাবার খাবেন না ।
পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট যেমন:সাদা ভাত,সাদা রুটি,পাস্তা,পেস্ট্রি ইত্যাদি খাবার।

বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন:কেক,মিছরি, মিষ্টি দই,অতিরিক্ত চিনিসহ আইসক্রিম ইত্যাদি খাবার খাবেন না।

বাংলাদেশের অনেক মেয়েই বর্তমানে পিসিওএস এ আক্রান্ত এসব জটিলতা থাকলেও এ রোগটি নিরাময় করা সম্ভব তাই চিন্তিত না হয়ে ঠিকমতো সুষম ও পরিমিত খাদ্য তালিকা অনুসরণ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করলে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায়।

One thought on “পিসিওএস (PCOS) কী এবং এ রোগে কোন ধরনের খাবার খাবেন (PCOS)?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *