পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
দেশের প্রকাশনা ও বইয়ের ব্যবসার সর্ববৃহৎ কেন্দ্র হল পুরান ঢাকার বাংলাবাজার। পুরান ঢাকার বাংলাবাজারকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক বাঁধাই কারখানা । তবে কাগজের উচ্চমূল্য , দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি , জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বইয়ের টেন্ডার সিন্ডিকেটসহ নানান ধরনের জটিলতায় ভালো নেই সেখানকার বাঁধাই শ্রমিকরা ।টাকা ও কাজের অভাবে বাধ্য হয়েই কয়েক যুগের পেশা বদলাচ্ছেন তারা ।
বাংলাবাজার এলাকার প্যারিদাস লেন , শিরিষ দাস লেন , পাতলা খান লেন , রূপচান লেন , জয়চন্দ্র ঘোষ লেন ঘুরে দেখা যায় , বাঁধাই কারখানা গুলোতে নেই কোন কাজের ব্যস্ততা। অথচ বছরের শেষ তিন মাস এসব কারখানায় কাজের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সবসময় । ব্যস্ত সময় কাটে বাঁধাই শ্রমিকদের মধ্যে ।
জানুয়ারিতে বই উৎসব ও নতুন শিক্ষাবর্ষ বই , ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা ঘিরে কাজের ব্যস্ততা কয়েক গুণ বেড়ে যায় সবার । বলতে গেলে বছরের শেষ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের দম ফেলার সময় থাকে না ।
পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায় , বাংলাবাজারে বিভিন্ন লেনে সাড়ে চারশ -র বেশি বাঁধাই কারখানা রয়েছে ।
এসব কারখানায় কাজ করেন বিভিন্ন বয়সী লক্ষাধিক মানুষ । বাঁধাই শ্রমিকদের শিফটপ্রতি হাজিরা ২৫০ টাকাকরে । সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শিফটে একজন বাঁধাই শ্রমিক কাজ করলে তাদের মেলে ৫০০ টাকা ।
কারখানামালিক ও বাঁধাই শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায় , কাগজের উচ্চমূল্যের কারণে প্রকাশনা গুলো বই প্রকাশ ও সংস্করণের কাজ কমিয়ে দিয়েছে এখন ।
পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
এছাড়া ও এনসিটিবি’র প্রায় শতভাগ কাজই এবার বাংলাবাজারের বাইরে মাতুয়াইল এলাকায় হচ্ছে বলে জানান । এতে বাংলাবাজারের শ্রমিকদের কাজের ব্যস্ততায় ভাটা পড়ে গেছে । এছাড়া করোনাকালীন সংকট ও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠতে পারেনি এই শিল্পটি ।
তাই বাধ্য হয়েই শ্রমিক ছাঁটাই করছেন মালিকরা , বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিনের পেশা বদল করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। আগে থেকে কাগজের দাম বেড়েছে, প্রকাশনা মালিকরা যদি কাজ না করলে আমরা কীভাবে কাজ করবো, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তিন মাস আমাদের দম ফেলার ও সময় থাকে না ।
সকাল ৮ টায় শুরু হয়ে রাত ১-২টা পর্যন্ত কাজ চলতো আমাদের । তাও পর্যাপ্ত শ্রমিক পেতাম না আমরা । এখন সকালের সময়ে কাজ হচ্ছে নাকোন । আগে যেখানে ৩০-৪০ জন শ্রমিক লাগতো, এখন ১০-১২ জন দিয়ে কাজ করাচ্ছি আমরা ।’
কারখানার বাঁধাই শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে , ঢাকার এই অংশের বাঁধাই শ্রমিকদের প্রায় শতভাগই টাঙ্গাইল এলাকার রয়েছে । অধিকাংশই শৈশব থেকেই এই পেশায় যুক্ত আছে ।
কেউ কেউ বয়স ১০ হওয়ার আগেই যুক্ত হয়েছেন এই পেশা জগতে । অনেকে সহকারী থেকে কাজ শুরু করে এখন সুপারভাইজার হয়েছেন তারা । করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠতে না ওঠতেই এখন কাজ সংকটে বিপাকে পড়ছেন তারা সবাই । অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন ইতিমধ্যে ।
তাদের কেউ কেউ সেখানে চায়ের দোকান দিয়েছেন বলে জানান , রিকশা-ভ্যানগাড়ি চালানোকে বেছে নিয়েছেন অনেকে রুটিরুজির জন্য । তবে অন্য কাজ জানা না থাকায় ও বয়স জনিত কারণে অনেকে চাইলে ও পরিবর্তন করতে পারছেন না পেশা , পরিবার নিয়ে তাদের জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে অনেক ।
পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
(বাঁধাই শ্রমিকদের ওস্তাদ) মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন । তিনি ১০ বছর বয়স থেকে বই বাঁধাইয়ের কাজ করে আসছেন । ৩৫ বছর ধরে এই কাজই করেন তিনি । এখন তার বয়স ৪৫।
তিনি বলেন , ‘কাজ না থাকায় অনেকেই পেশা বদলেছেন । এই কারখানায় আগে ১৫-২০ জন দৈনিক কাজ করতাম , ২ শিফটে কাজ করে ও কাজ ফুরাতো না। এখন ৭ -৮ জন কাজ করি মাত্র ।
১০ বছর বয়স থেকে এই লাইনে আমি , অন্য কাজ ও করতে পারি না, মাজা ব্যথার সমস্যা রয়েছে আমার , চাইলে ও অন্য কাজ কীভাবে করবো বলেন । প্রতি শিফট ২৫০ টাকা , দুই শিফটে ৫০০ পাই । আগে দুই শিফটে করে ও ওভারটাইম করেছি আমরা ।
৫০০ টাকায় এখন নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে কষ্ট হয়ে যায় আমাদের অনেক । একরকম ডাল-ভাতে জীবন চলছে আমাদের সকলের পরিবারের । সামনে যদি কাজ না পাই , তখন কী হবে—সেই চিন্তায় আছি আমরাও আমাদের পরিবার সবাই ।’
বাঁধাই শ্রমিক মুস্তাফিজ বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে ২৫০ টাকা পাই আমরা । মাঝে দিকে কাজ ছিল না , ১৫ দিন বাড়িতে বসা ছিলাম । আমি যখন এই লাইনে যখন আসি তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর ।
২৫ বছর ধরে এই কাজ করছি আমি , আর কোন ও কাজ জানা নাই আমার । আমাদের সাধের অনেকে গ্রামে চলে গেছে। সেখানে রিকশা -ভ্যান চালাচ্ছে । বসে থেকে তো সংসার চলানো যাবে না। তাছাড়া জিনিসপত্রের দাম ও অনেক বাড়ছে।’
বাঁধাই কারখানার মালিকরা আরো বলছেন, করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আগে এখনকার পরিস্থিতি তাদের নতুন করে সংকটে ফেলেছেন বলে জানান । প্রকাশনা মালিকরা দীর্ঘদিনে ও বকেয়া টাকা পরিশোধ করছেন বলে আরো বেশি সংকট করতে হচ্ছে । কাজ পেতে কম রেটে অর্ডার নিতে হচ্ছে আমাদের , এর প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের ওপর ও অনেক । পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না হলে বন্ধ হবে কয়েক শ কারখানা ।
পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
জিয়নপুর বুক বাইন্ডিং ওয়ার্কসের সত্বাধিকারী মো. ইউসুফ আলী বলেন , ‘ ইদানিং বই ছাপানো কমে গেছে , শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছি না আমরা । বছরের শেষ সময়টা আমাদের কাজের চাপ থেকে,কিন্তু এই সিজনে কয়েক লাখ টাকার কাজ হবে শুধু আমার কারখানায় তা আর হচ্ছে কোথায়?।
করোনার সময় আমাদের ১ বছরের বাড়ি ভাড়া বাকি ছিল আমাদের , ৫ মাসের টাকা শোধ করেছি মাত্র , এখন ও ৭ মাসের শোধ করতে হবে আমাদের । অনেক কারখানা মালিক করোনার পর কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন , অনেকে টাকা না দিয়ে পালিয়ে গেছে । এমন অবস্থা থাকলে আর ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে , সংখ্যাটা কয়েক শ’তে গিয়ে ঠেকবে সামনে ।
আগে আমরা রিম প্রতি ২০০-২৫০ টাকায় কাজ নিতাম , একই কাজ এখন ১৩০-১৫০ টাকায় নিতে হচ্ছে আমাদের । প্রকাশনা থেকেও কাজ নেই , তাই বাধ্য হয়েই কম রেটে কাজ নিচ্ছি আমরা । তাও ঠিক সময়ে টাকা পাই না আমাদের ।’
সংশ্লিষ্টরা জানান , এনসিটিবি’র বইয়ের কাজ বছর দশেক আগে শতভাগ কাজ বাংলা বাজারকেন্দ্রিক হলে ও বর্তামানে তা মাতুয়াইলকেন্দ্রিক হয়ে ওঠছে । এনসিটিবি থেকে কাজ পায় প্রেস মালিকরা , ছাপার কাজ শেষে বাঁধাইয়ের কাজ নেয় বাঁধাই কারখানা গুলো। বাংলা বাজারে মূলত শিট মেশিনে কাজ হয়ে থাকে , মাতুয়াইলে কাজ হয় গজ মেশিনে ।
শিট মেশিনে কাজ হতে সময় , ভালোমানের কাগজ ও বেশি জনবল প্রয়োজন হয় , ফলে বাঁধাইয়ের কাজে খরচও বেশি । গজ মেশিনে নিম্নমানের কাগজে কম সময়ে ও কম লোকবলে ধারা কাজ করানো সম্ভব হয় । এনসিটিবি’র বইয়ের টেন্ডার মাতুয়াইলের প্রেস গুলো পেয়ে আসছে অনেকদিন যাবত ।
পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
ফলে বাঁধাইয়ের কাজখুব কম পাচ্ছে বাংলাবাজারের কারখানাগুলো । এ পরিস্থিতিতে এখানে কাজ কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । এখানকার প্রকাশনা গুলোর আগের সেই ব্যস্ততা নেই এখন আর , বাঁধাই কারখানা গুলোর ও একই অবস্থা চলছে ।
রুহুল বুক বাইন্ডিংয়ের সত্বাধিকারী মো. আমিনুর মিয়া আমাদের বলেন, ‘বইমেলা ছাড়া ও এনসিটিবি’র অনেক কাজ পেতাম আমরা । বছরের শেষ ৩ মাস আমাদের কাজের মূল সময় ছিল । এখন এনসিটিবি’র বই সব মাতুয়াইলে হচ্ছে , আমাদের কোন কাজ নেই বললে চলে । আমাদের শিট মেশিনে অনেক খরচ বেশি , তার ওপর কাগজের দামও বেশি ।’
তবে বাংলাবাজারে এনসিটিবি’র কাজ না আসার কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুলছেন কারখানা সকল মালিকরা। সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপে কাজ সব মাতুয়াইলে চলে গেছে বলে দাবি করেন তারা ।
লালু নামের একজন বাঁধাই কারাখানার মালিক আমাদের বলেন , ‘বাংলাবাজারের প্রেস গুলো এবার কোন ধরনের কাজ পায়নি । সবকাজ একদিকে চলে গেছে ।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা কম রেট দিয়ে টেন্ডার নিয়ে নিয়েছে বলে তাদের দাবি । প্রেস আর বাইন্ডিং — দুটোই তারা করছে এখন । বাংলাবাজারের প্রেসগুলো কাজ পেলে , আমাদের বাঁধাই কারখানা গুলোর অবস্থা এমন খারাপ হতো না কখনোই , কর্মী ছাঁটায়েরও দরকার হতো না।’
পেশা বদলাচ্ছেন বাংলাবাজারের অধিকাংশ বাঁধাই শ্রমিকরা
পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মনির হোসেন বলেন , ‘আমাদের সমিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নথিভুক্ত আছে । আমরা আগে এনসিটিবি’র ৭০ শতাংশ কাজই পেতাম , এবার কোন ও কাজই পাইনি আমরা । এভাবে এককেন্দ্রিকভাবে , গুটিকয়েক মানুষের হাতে কাজ চলে গেলে আমাদের এখানকার ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে ।
তার ওপর কাগজের দাম বেড়েছে আগে থেকে অনেক , প্রকাশনা গুলোর বই কমে যাচ্ছে দিন দিন । সরকার প্রয়োজনে কাগজের ট্যাক্স ফ্রি করে দিক আমাদের , বিদেশ থেকে কাগজ আনুক দেশে । সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই কাজের সাথে জড়িত রয়েছে । এই অবস্থা না বদলালে তাদের সবার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে সামনে ।
সমিতির সভাপতি মাহাবুব আলম মল্লিক আরো বলেন , ‘ কাগজের দামের কারণে প্রকাশনা গুলো নতুন কাজ করছে না এখন , এনসিটিবি’র বই কিছু ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাচ্ছে , যার প্রভাব আমাদের ওপর ও পড়ছে । আমরা আমাদের কর্মী ছাঁটাই করতে চাই না , বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। সামনে বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে আমাদের মিটিং রয়েছে । তখন এসব বিষয় গুলো তুলে ধরে সমাধান খোঁজা হবে অবশ্যই ।’