বেগুন বিবি
দিমাশকে একটি প্রাচীন মসজিদ ছিল। নাম মসজিদে তাওবা। বর্তমান মসজিদের স্থানে আগে একসময় ছিল একটা ‘রঙ্গালয়’। সব ধরনের পাপাচার এখানে সংগঠিত হতো। হিজরী সপ্তম শতকে একজন শাসক জায়গাসমেত রঙ্গালয়টা কিনে নিলেন।
পুরনো অবকাঠামো ধ্বসিয়ে নতুন করে একটা সুন্দর ভবন নির্মান করলেন। কাজ শেষ হলে সুরম্য ভবনটাকে মসজিদ হিশেবে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দিলেন। তখন থেকেই মসজিদে তাওবা নামেলোকমুখে পরিচিত পেয়ে গেছে। মসজিদে তাওবায় একজন শায়খ থাকতেন।
সলীম সুয়ূতী। ইলমে-আমলে তুলনারহিত। আশেপাশের দশ-বিশ গ্রামের মানুষ শায়খের মুরীদ। সবার আস্থার পাত্র। ভরসাস্থল। দ্বীনি ও দুনিয়াবি সব বিষয়ে তারা শায়খের শরণাপন্ন হয়। তার পরামর্শ মতোই চলে। শায়খ মসজিদের পাশে একটা মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেখান থেকে ইলমপিপাসু ছাত্ররা তাদের তৃষ্ণা মেটাতো। মাদরাসায় ভিনদেশী একজন গরীব ছাত্র ছিল। অতুলনীয় মেধার অধিকারী। তাকওয়া-পরহেযগারীতে তারধারেকাছেও কেউ ছিল না। সবসময় মাদরাসায় মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সাধনা-মুজাহাদার মশগুল থাকতো। শত কষ্টেও কারো কাছে হাত পাততো না।
নিজের অভাব অনটনের কথা কাউকে বলতো না। এমনকি শায়খের কাছেও নিজের দারিদ্র্যের কথা ভাঙতো না। বড়ই টনটনে তার আত্মমর্যাদাবোধ। মাদরাসা ছুটি হলো।
ছাত্ররা যে যার বাড়ি চলে গেল। শায়খও নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ছাত্রটির যাওয়ার মতো কোনও জায়গা না থাকায়, মাদরাসাতেই রয়ে গেল। তার কাছে খাবার কেনার মতো একটা কানাকড়ি-পাই পয়সাও অবশিষ্ট ছিল না। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির অবস্থা।
এভাবে একদিন গেল, দেখতে দেখতে দ্বিতীয় দিনও চলে গেল। ধুঁকে ধুঁকে তৃতীয় দিনে গিয়ে পড়লো। আর তো হাত চলে না। ছাত্রটি দেখলো সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কারো কাছে কিছু চাইবে তাতেও মন সায় দিচ্ছিল না।
লজ্জা, সংকোচ বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। শেষে ঠিক করলো লোকচক্ষুর অন্তরালে চুরি করবে। পরে আবার গোপনে শোধ করে দিবে। তার এখন যা (ইযতিরারী) অবস্থা তাতে প্রাণরক্ষা-পরিমাণ মৃত জন্তুর মাংস খাওয়া বা চুরি করা তো বৈধ। ভেবেচিন্তে ঠিক করলো চুরি করবে। শায়খ তানতাভী লিখেছেন, ঘটনাটা পুরোপুরি সত্য।
আমি ঘটনার সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে ভালো করে চিনি। ভালোমন্দ, ঠিক-বেঠিক, জায়েয-না জায়েযের বিচারে না গিয়েই শুধু যা ঘটেছে সেটাই বলে যাচ্ছি।। মসজিদটি ছিল শহরের প্রাচীন অংশে। পুরান শহরে যেমনটা হয় আরকি, একটা ঘরের সাথে আরেকটা ঘর পুরোপুরি লাগোয়া।
এক বাড়ির ছাদে উঠলে পুরো মহল্লায় ছাদে ছাদেই একটা চক্কর দিয়ে আসা যায়। ছাত্রটা রাতের বেলায় মসজিদের ছাদে উঠে গেল। লাফ দিয়ে পাশের বাড়ির ছাদে গেল। গরমকাল ছিল, উঠোনে কয়েক নারী পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি অবনত করে পরের বাড়ির ছাদে চলে গেল।
নিচ থেকে খাবারের সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগলো। ঘ্রাণটা ছাত্রটিকে চুম্বকের মতো টেনে নিচে নামিয়ে আনল। সে একটা ঘোরের মধ্যে ঘ্রাণের উৎসের দিকে হেঁটে চলল। হাঁড়ির ঢাকনা উঠিয়ে দেখল চমৎকার করে বেগুন রান্না করে রাখা আছে। এখন শুধু মুখে তুলে খাওয়ার দেরী। একটুকরা বেগুন উঠিয়ে নিল।
আচ্ছন্নের মতো কামড় বসিয়ে দিল। প্রচণ্ড গরম হওয়ার কারণে সামান্য একটু মুখে দিতে পেরেছিল। সেটুকুই চিবিয়ে গলাধঃকরণ করতে গিয়েই হুঁশ ফিরে এলো। –করছি কী আমি? চুরি করে হারাম খাচ্ছি? আমি না তালিবে ইলম? সম্বিত ফিরে পেয়ে হাতে নেয়া আধকামড়ানো বেগুনটা ডেগে রেখে দিল। বেরিয়ে এলো।
এরপর ভাবলো খাবার খেতে যেহেতু মনে সায় দিচ্ছে না, কিছু একটা চুরি করে নিয়ে যাই, পরে ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু এই চিন্তাও মাথায় ঠাঁই পেল না। মসজিদে ফিরে এল। কষ্টেসৃষ্টে বাকি রাতটুকু কাবার করলো। ফজরের পর চোখে সর্ষেফুলের ফুটকি নিয়ে শায়খের দরসে বসলো।
দরস শেষ হওয়ার পর আর নড়াচড়া করার শক্তি নেই। অবসন্ন শরীর চেতনা অবচেতনার মাঝামাঝি একটা অবস্থায় পৌছে গেছে। চলচ্ছক্তিরহিত। অন্য ছাত্ররা যে যার মতো চলে গেছে। শায়খ এখনো বসে আছেন। একজন
আপাদশির ঢাকা মহিলা এল।
তখনকার দিমাশকে সব মহিলাই পুরো শরীর ঢেকে ঘরের বাইরে বের হতো। ফরাসীদের মেমদের দেখাদেখি, এখনকার মতো অর্ধনগ্ন হয়ে বের হওয়া মেয়েদের মতো কাউকে তখন কল্পনাও করা যেত না। মহিলা সোজা শায়খের কাছে গিয়ে বললো, আমি দূর দামেশকে নতুন এসেছিলাম। স্বামীর সাথে। এখানেই থাকবো বলে।
একটা বাড়িও কেনা হয়েছে। গত কিছুদিন ধরে আমরা কেনা বাড়িতেই থাকছিলাম। -দিমাশকে কেন থাকতে এলে? .-স্বামীর চিকিৎসার জন্যে। স্বামী কোথায় এখন? -সেটা বলতেই এখানে এসেছি। সবাই আপনর কথা বললো। গত কয়েক মাস আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। ইদ্দত শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ঘরে বসে ছিলাম। আমার সাথে আমার অতি বৃদ্ধ নিঃসন্তান চাচাও থাকেন।
আজ তাকে সাথে করেই এখানে এসেছি। -তো মা, আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি? আমার কাছে কেন এসেছ? আমি তো এখন একা একা থাকি। আমার বয়েসও বেশি হয়নি। স্বামীর সাথে সংসারও বছরখানেকের বেশি নয়। স্বামীহারা একজন যুবতী মেয়ের প্রতি অনেকেরই চোখ টাটায়। তায় আমার স্বামী বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে গেছেন।
বাড়িতে পাড়াতুতো নানা ধরনের উটকো ভাই-বেরাদর, জ্ঞাতি-গোষ্টি, নাসাবান-সিহরান দেখা দিয়েছে। তাদের মাছের মায়ের কান্নায় তোড়ে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে বাড়িতে অবস্থান। -কেমন পাত্র চাও তুমি? আমার কেমন স্বামী প্রয়োজন সেটা আপনি ভালো করেই বুঝবেন।
শুধু এটুকু বলবো, দ্বীনদার হলেই হবে। শায়খ তাকিয়ে দেখলেন মসজিদের কোণে একজন ছাত্র চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। জোরে হাঁক পাড়লেন।
কাছে এলে কোনও ভূমিকা-ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন, —তুমি বিয়ে করেছ? জি না। -এখন বিয়ে করতে রাজি আছ? আমার তো এখন রুটি কেনারও টাকা নেই, মোহরানা আদায় কিভাবে করবো? -তার ব্যবস্থা হয়ে যাবেখন। -আমি রাজি। -এবার মা তুমি বলো, একে তোমার স্বামী হিশেবে পছন্দ হয়? -জি। দু’জন স্বাক্ষী ডেকে সাথে সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হলো। নববধু বিয়ে করা স্বামী নিয়ে, বৃদ্ধ চাচাসহ ঘরে ফিরে এলো।
এত তাড়াতারি বিয়ে হয়ে যাবে ধারণা ছিল না। তেমন হলে বাড়তি রান্নাবান্নার করতে হত। এখন ঘরে যা আছে তা দিল। তরকারির ডেগের ঢাকনা উল্টিয়ে হায় হায় করতে লাগল। বিড়াল কখন বেগুনএ মূখ দিল।