বেহেশতের বয়ান
বেহেশত পরম সুন্দর চির সুখময় স্থান। ইহা নানা প্রকার ফলে ফুলে
অতুলনীয় প্রাসাদসমূহের দ্বারা সুশোভিত। ইহাতে অসংখ্য সুমিষ্ট, সুশীতল
এবং সুগন্ধিযুক্ত শরবতের ঝরণা ও নদী প্রবাহিত আছে। ইহা এত সুন্দর যে,
মু’মিন বান্দাদের এবাদতের পুরস্কার স্বরূপ ইহাতে স্থান দিবেন। এখানে
মৃত্যু, রোগ-শোক, অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট বলতে কিছুই থাকবে না।
মানুষ কখনও তাহা কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহপাক তাঁর নেক্কার
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বেহেশতের মাটি হবে
মেশক জাফরানের । আল্লাহ পাক স্বর্ণের ও রৌপ্যের ইট দ্বারা ইহা প্রস্তুত
করেছেন। বেহেশতের সুখ ও সৌন্দর্যের বর্ণনা করা মানুষের সাধ্য নাই।
বেহেশতবাসী পুরুষগণ ৩২ বৎসরের যুবক আর মহিলাগণ ১৬ বৎসরের
যুবতী হইবে । দুনিয়ার নিয়ম মানুষের বয়স যত বেশি হয় ততই তারা দুর্বল।
হয়ে পড়ে । কিন্তু বেহেশতবাসীগণের বয়স যতই বেশি হবে, ততই তাদের
শক্তি আর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাইতেই থাকবে ।
বেহেশতের একজন বাঁদিকে দেখে জিবরাঈল (আঃ) বেহুশ হয়ে পড়ে
গিয়েছিলেন । সেই বাঁদি বলেছিলেন, আমরা যাদের দাসী তাহাদিগকে আল্লাহ
তায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতের জন্য সৃষ্টি
করেছেন । আল্লাহর মুহাব্বতে যারা নিজেকে বিসর্জন দিয়াছেন, তারাই এই
চির সুখময় বেহেশতের অধিকারী হবে। যারা সর্বদা আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত
আছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে, দান ছদকা
করে, হারাম হালাল বাছিয়া চলে, মা-বাপের সাথে ভালো ব্যবহার করে,
যাকাত আদায় করে, পর্দা রক্ষা করে চলে, সত্য কথা বলে, ওয়াদা খেলাপ
করে না, মোনাফেকি, ধোকাবাজী করে না, শেকায়েত গীবত করে না।
দ্বীনের জন্য জান মাল খরচ করে, যার যাহা হক তাহা আদায় করে, অহংকার |
করে না, কারো সাথে হিংসা করে না, কেউর মাল ঠকায়ে খায় না।।
রাত্রিকালে নির্জনে বসে আল্লাহর ভয়ে অথবা আল্লাহর মহব্বতে রোদন করে।।
নিজের পাপের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়ে ক্রন্দন করে ও ক্ষমা প্রার্থনা
করে, তারাই চির সুখময় বেহেশতের অধিকারী হবে।
পোশাকের ভিন্ন ভিন্ন রং হবে। বেহেশতবাসীদের দশ আঙ্গুলে দশটি আংটি
আল্লাহ পাক বেহেশতীদিগকে ৭০ প্রকার পোশাক পরাইবেন। প্রত্যেক পোশাকের ভিন্ন ভিন্ন রং হবে।বেহেশতবাসীদের দশ আঙ্গুলে দশটি আংটি থাকবে। উহার প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন লেখা অঙ্কিত থাকবে। প্রথম আংটিতে
লেখা থাকবে, তোমার উপর সালাম। দ্বিতীয়টিতে লেখা থাকবে, তোমরা
বেহেশতে সর্বদাই আল্লাহর দিদার বা সাক্ষাৎ লাভ করবে। তৃতীয়টিতে লেখা
থাকবে, যাহারা আল্লাহর এবাদত করেছে, তাহারা অনন্তকাল বেহেশতে বাস
করবে। চতুর্থটিতে লেখা থাকবে, আল্লাহ তোমাদের উপর সন্তুষ্ট
পঞ্চমটিতে লেখা থাকবে, তোমাদের উপর কোন শাস্তি বা দুঃখ নাই ।
ষষ্ঠটিতে লেখা থাকবে, হুরগণ সর্বদা তোমাদের খেদমতে নিয়োজিত
থাকবে। সপ্তমটিতে লেখা থাকবে, তোমাদের ইচ্ছামত হুরগণকে ব্যবহার
করতে পারবে। অষ্টমটিতে লেখা থাকবে, তোমরা সর্বদায় নবী,
ছিদ্দিকগণের সহিত বসবাস করতে থাক। নবমটিতে লেখা থাকবে,
তোমাদের যৌবন কখনো লোপ পাইবে না। দশমটিতে লেখা থাকবে
পরশীগণ তোমাদিগকে কষ্ট দিবে না।
|
ওলি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা তার নেক
বান্দাদের জন্য এমন সমস্ত নেয়ামত তৈরী করে রেখেছে, যাহা কোন চক্ষু
দেখে নাই, কোন কর্ণ তাহা শুনে নাই। কোন মানুষ তাহা কল্পনাও করে
নাই। বেহেশতের দালান- সমূহের একখানা সোনার ইটের সহিত মেশক
দ্বারা আর একখানা রূপার ইটের সহিত জোড়া দেওয়া হয়েছে। উহার
কঙ্করসমূহ মোতি ও ইয়াকুতের হইবে। যাহারা বেহেশতে যাইবে তাদের
আর কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। তাদের পায়খানা প্রস্রাবের প্রয়োজন হইবে
না। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ময়লা হবে না। কোন রোগ-শোক,
ভাবনা-চিন্তা থাকবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
বেহেশতের মধ্যে দু’টি বাগান হবে, যার আসবাবপত্র রূপার হবে। আরও
দুইটি বাগান হবে যার আসবাবপত্র স্বর্ণের হবে। বেহেশতের দালানগুলির
১০০টি করে তলা হবে, যার ১তলা হতে অপর তলার দূরত্ব আসমান ও
জমিনের দূরত্বের সমান।
বেহেশতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় বেহেশতের নাম হলো জান্নাতুল
ফেরদাউস। জান্নাতুল ফেরদাউস হতে চারটি ঝরণা প্রবাহিত হইয়াছে।
উহার একটি দুধের, একটি মধুর, একটি পবিত্র শরাবের, আর একটি
পরিষ্কার পানির । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা
যদি আল্লাহ পাকের নিকট বেহেশত চাও, তবে জান্নাতুল ফেরদাউস
বেহেশত চাহিও। জান্নাতুল ফেরদাউস বেহেশতের উপরে আল্লাহ্পাকের আরশ থাকিবে। বেহেশতের হুরগণ সকলেই ১৬ বৎসরের পূর্ণ যুবর্তী হবে।
আল্লাহ পাক হুরদিগকে এত সৌন্দর্য দান করেছেন যে, তাহা বর্ণনা করার
ভাষা মানুষের নাই। যদি কোন হুর রাত্রির দিকে নজর করত, তবে রাত্র দিন
হয়ে যেত। তাদের মুখের থুথু এত সুগন্ধিপূর্ণ হবে যে, তার এক ফোঁটা
দুনিয়াতে পড়লে সমস্ত দুনিয়া মেশকময় হয়ে যেত। আর এক ফোটা পানিতে
পড়লে সমস্ত পানি দুধের মত সাদা ও আতরের মত সুগন্ধিময় হয়ে যেত।
জিবরাঈল (আঃ) যখন আদন বেহেশত দেখতে গেলেন, তখন বিজলি
চমকাইবার মত আদন বেহেশত হেসে উঠলো। তিনি পিছনের দিকে
তাকায়ে দেখেন, লুনা নামি একটি বালিকা হুর তার দিকে তাকায়ে হেঁসে
উঠছিলেন, তাঁর দাঁতের আলোতে সমস্ত বেহেশত আলোকিত হয়েছিল । উহা
দেখে তিনি বলেন, (সুবহানাল্লাহ) প্রশংসা ঐ রাব্বুল আলামীনের জন্য যিনি
তোমাকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। তাদের চক্ষু বড় বড়, চক্ষের সাদা
অংশ খুব সাদা আর কালো অংশ খুব কালো। হুরগণ এত সুন্দরী হওয়া
সত্ত্বেও দুনিয়ার মহিলারা যারা বেহেশতী হবে, তারা ঐ নূরের তৈরী হুরের
চাইতেও সুন্দরী ও সম্মানিতা হবে। আর হুরগণ তাদের তাবে হয়ে চলবে।
কেননা, হুরগণকে আল্লাহপাক ইচ্ছা করে ঐরূপ সুন্দরী করে সৃষ্টি করেছেন
আর দুনিয়ার মহিলাগণকে ঐরূপ সুন্দরী করে সৃষ্টি না করলেও তারা দুনিয়াতে
বসে কষ্ট করে নেক আমল করেছেন। সেই নেকের ফলে তাদের ইজ্জত,
সম্মান ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাবে ।
১৭৬
সূরা গাশিয়ার ৮ ও ৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-
–
وجوه يومنذ ناعمة تسعيها راضية
(উজুহুহঁ ইয়াওমা ইজিন্নাইমাহ লিছা’য়্যিহা রাদিইয়াহ্)
সেই দিন তাদের মুখমণ্ডল অতি আনন্দময় সুন্দর ও তরুতাজা হবে।”
(সূরা গাশিয়াহ, আয়াতঃ ৮)
আখেরাতের শান্তির জন্য তারা দুনিয়াতে বসে যে সব মেহনত
পেরেশানী করেছেন, উহার পুরস্কার দেখে বলবে, এই নেয়ামতের তুলনায়
দুনিয়ার মেহনত কিছুই না, তবুও আল্লাহপাক দয়া করে আমাদেরকে ও
বেহেশত দান করেছেন। অথচ আমাদের মেহনত হিসাবে বেশেতের
একটা পাতাও পাইতে পারি না। মহিলা পুরুষ সবাই চিরদিন যুবক যুবতীই।
থাকবে। কেহহ বুড়া হবেনা। মহিলাদের হায়েজ নেফাস হবে না। তারা এত সুন্দরী হবে যে, ৭০ প্রকার রেশমী কাপড় পরানো হবে। তার মধ্যে
দিয়াও তাদের হাড্ডি দেখা যাবে। রং মহলের মধ্যে অতি সুন্দর স্বর্ণ রোপার
খাট, পালঙ্কে টেক লাগায়ে শুয়ে থাকবে। যাহা চাইবে তাই পাইবে। যখন
মনে চাবে যে অমুক গাছের ফল খাব, তখন সঙ্গে সঙ্গে ঐ গাছটি ফল সহ
এসে ডাল ঝুলায়ে দিবে। প্রাণ ভরে ফল খেয়ে ডাল ছেড়ে দিলে ঐ গাছ নিজ
মনিমুক্তার চুড়ি থাকবে। সর্বশরীরে স্বর্ণের অলংকার থাকবে। তারা একে
অপরের মুখোমুখি হয়ে হেলান দিয়ে বসে আলাপ করবে। হুরেরা মধুর সুরে
খোশ আওয়াজে গান করিবে। এমন মন মাতানো গান যাহা কোনদিন কেহ
শুনে নাই ।
ছোট ছোট ফুটফুটে বালক বা বালিকাগণ খুশবু, মজাদার ফল, সরবতের
পেয়ালা, পাখির ভুনা গোস্ত, স্বর্ণের কারুকার্য্য পানপাত্র হাতে নিয়ে ঘুরতে
থাকবে। চক্ষের পাওয়ার এত হবে যে, বেহেশতীরা হাজার বছরের রাস্তা
একই নজরে দেখতে পাবে। হাজার বৎসরের রাস্তা পরিমাণ জায়গার চেয়ে
ছোট বেহেশত কাহারো হবে না। এই বিশাল রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্য
প্রান্ত পর্যন্ত সমানভাবে তারা দেখতে পারবে। দুনিয়াতে যেমন বেঈমানেরা
ঈমানদারদেরকে দেখলে হাসি-ঠাট্টা করে, উহা দেখে তাদের প্রাণে দুঃখ
লাগে, তেমনি বেহেশতে বসে তারা পাপিদের আজাব দেখে হাসি-ঠাট্টা
করতে থাকবে । ইহা দেখে জাহান্নামিরা দুঃখে চিৎকার মেরে কলিজা ফাটায়ে
বলবে, হায়রে একই দুনিয়াতে বাস করে ক্ষণিকের সুখ করে এতবড়
আজাবে গ্রেপ্তার হলাম। আর আমাদের সঙ্গের সাথীগণ এত বড় সম্মান পেয়ে
আনন্দে বসবাস করতেছে। তাদের দুনিয়াতে কিছুই ছিল না। এখন তারা
বাদশাহ হয়ে গেল ।
বেহেশতীদের চেহারা যদি দুনিয়াতে দেখাইত, তবে সারা দুনিয়া
আলোকিত
হয়ে যেত। আর মাশরেক হতে মাগরেব পর্যন্ত সুঘ্রাণে ভরে
যেত। তাদের ওড়নার মূল্য দুনিয়ার মধ্যে যাহা কিছু আছে, তার চেয়েও
মূল্যবান হবে। বেহেশতে নহরে কাওছার, নহরে কাফুর, নহরে তাছনীম,
নহরে ছালছাবীল ও নহরে রাহীক রহিয়াছে। খেদমতের জন্য অসংখ্য
বাঁদী, দাসী ও গোলাম আছে। হাজার হাজার রকমের ফল ফুল আছে। এক
একটা ফলের ভিতরে ৭০ প্রকার স্বাদ রহিয়াছে। যাহা ইচ্ছা করিবে তাহাই।
পাবে।
আটটি বেহেশতের নাম ঃ ১। জান্নাতুল ফেরদাউস, ২। জান্নাতুন
নাঈম, ৩ । জান্নাতুল মাওয়া, ৪। জান্নাতু আদন, ৫। দারুচ্ছালাম, ৬। দারুল
কারার, ৭। দারুল মাকাম, ৮। দারুল খুলদ। যারা প্রথম বেহেশতে যাবে
তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল হবে। তারপর যারা যাবে তাদের
উজ্জ্বলতা একটু কম হবে। বেহেশতের সুখ ও সৌন্দর্যের বর্ণনা করার
ক্ষমতা মানুষের নাই । ইহা বেহেশতের অতি সামান্য পরিচয় মাত্র।