বৈরীপ্রিয়াঃ১১

বৈরীপ্রিয়া ১১

শিওর! হোয়াই নট।’ বলে সে তার বাইকটাকে সোজা করে ধরে খানসার বসার
ব্যবস্থা করে দিয়ে জানতে চাইল খানসার বাইকে বসে অভ্যাস আছে কিনা। খানসার
মুখ থেকে চিরাচরিত স্বভাবে একটা রূঢ় উত্তর চলে এসেছিল। বহুকটে সেটাকে চেপে
ভদ্রভাবেই উত্তর দিলো, ‘জি, পারব!’
বাড়ি পৌঁছে বাইক থেকে নেমে ওর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে ইরফান বলল।
‘এবার নিশ্চয়ই যেতে পারবেন!’
খানসা নিরসক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এতটা পথ কষ্ট করে যখন এলেন। একটু বসে আম্মুর
সাথে নাহয় দেখা করেই যান। অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।’ ইরফান
খানসার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। খানসাকে উদাস চোখে
রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বাইক ছেড়ে নামল। আস্তে করে বলল, ‘যদি
আপনি বলেন তাহলে অবশ্যই দেখা করে যাব!’

1
খানসার সম্মতি পেয়ে আম্মুর ব্যস্ততা যেন আজকাল বহুগুণে বেড়ে গেছে। সেদিনই
ফোন করে আব্বুকে খানসার মতামতের খবর জানিয়ে দিয়েছে আম্মু। আব্বুও
জানিয়েছেন উনি সামনের মাসের ফার্স্ট উইকে আসতে পারবেন পনেরো দিনের
জন্য। ততদিনে আম্মু যেন সব গুছিয়ে রাখে। সেই থেকে আম্মুর ব্যস্ততার অন্ত নেই।
পারলে রোজই একবার শপিংয়ে ঢুঁ মারছেন। আম্মুকে মতামত জানিয়ে খানসা
নিজেও অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে। স্বস্তিটা মনস্তাত্ত্বিক। এখন আর স্যাডির কল তেমন
আসে না। প্রথম দিকে কয়েকবার এসেছিল। খানসার সাড়া না পেয়ে অথবা বিয়ের
খবরে চুপসে গেছে। এদিকে মাহমুদের আম্মু আর মাহমুদের আদিখ্যেতাও অনেকটাই
বন্ধ হয়েছে। তার মানে সে বিয়ে করছে বলে একজনের অধিকারভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
তা নইলে তার উপর সবার সমান অধিকার থাকত ওকে জ্বালাবার! খানসা ভেবে
পায় না। মানুষগুলো এমন কেনো। মেয়ে দেখলেই লোভ করতে হবে? কেনো সে
বিয়ে না করে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারবে না? কেনো তাকে একজন পুরুষের
ছত্রছায়াতেই থাকতে হবে? বিয়ে না করলে সমস্যা কোথায়? এত সমস্যার পরও
কেনো বিয়ে করতেই হবে। কেনো?
বেশি ভাবতে গেলে আজকাল মাথায় এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা হয় খানসার। গতরাত
থেকেই ভাবনাটা ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ওর বিয়েতে আম্মু যতটাই খুশি খানসা
ততটাই বিরক্ত। তবে ইরফানের ভদ্রতাটুকু স্বস্তি দিচ্ছে। সে স্যাডির মতো যখন তখন
ফোন করে জ্বালাচ্ছে না। আশা করা যায় সে আর দশজনের মতো বেহায়া হবে না।
সেকারণেই তো বিয়ে করা। ভাবতে গিয়ে হঠাৎ নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে পড়ল
খানসা। ধুর! সেই কখন থেকে কেবল বিয়ে নিয়েই ভাবছে! ব্যাপারটাকে ভুলে
থাকার জন্য বই হাতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল খানসা।
চোখটা লেগেছে কী লাগেনি। আধো ঘুম আর জাগরণের মাঝেই দেখল একটা
লোক ওর খাটের কিনারায় বসে আছে। খানসা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।

লোকটার দিকে। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেছে। লোকটা স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘আমি তোমাকে মানা করেছিলাম তোমার বিয়ে করার দরকার নেই। আমি আছি।
তোমার জন্যে কিন্তু তুমি!
খানসা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। কারণ সে জানে এরপরে কী হবে। সে
বিড়বিড় করে কিছু দোয়া আওড়াতে চেষ্টা করল যেগুলো অনেক আগে একবার ছোট
ফুপি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন বাজে স্বপ্ন দেখলেই আয়াতুল কুরসী পড়ৰিব৷
খানসা আয়াতুল কুরসী পারে না।
লোকটা হঠাৎ শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে উঠল, ‘বলো বলো
কী যেন বলছিলে!’

‘ছাড়ুন আমাকে! আ!’ চিৎকার দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল খানসা কিন্তু
পারল না। লোকটার খসখসে লোমশ ঠাণ্ডা শরীরটা ওর বুকের ওপর চেপে বসেছে।
নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে খানসার। ওর প্রবল চিৎকারটাই যেন গোঙানী হয়ে
বেরোল মুখ থেকে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সঁপে দিতে হচ্ছে নিজেকে। যতবারই লোকটাকে
দাঁতে কাটার চেষ্টা করছে ততবারই ফসকে যাচ্ছে সে। প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে
ঘামে ভিজে গেল ওর পুরো শরীর। আচমকা ধাক্কা খেয়ে সবকিছু যেন ভোজবাজির
মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। খানসা উঠে বসে চারিদিকে তাকাল।
পুরো ঘর খালি কোথাও কেউ নেই। কেবল আম্মু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছেন,
‘কিরে অমন গোঙাচ্ছিলি কেনো? দিনে দুপুরে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি??
খানসা গলায় কাঁধে হাত দিয়ে দেখল ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে তার জামাটা। ক্লান্ত
ভঙ্গিতে ওড়নাটা টেনে নিয়ে বিছানা ছাড়ল।
‘ভাত না খেয়ে ঘুমাচ্ছিলি কেনো? এসে ভাত খেয়ে যা, তারপরে ঘুমা। বিকেলে তোর
মিলি খালামণি আসবে। ভাত খেয়ে একটু ভদ্রস্থ হোস। ওনার সাথে ইরফানের আম্মুও
আসবেন। তোর আংটি আর চুড়ির মাপ নেবেন হয়তো।’ বলে আম্মু বেরিয়ে গেল।
বুকটা এখনো ধড়ফড় করছে খানসার। গতরাতেও ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখেছে সে।
এসব আজেবাজে স্বপ্নের কারণে আজকাল একা ঘুমাতেও বড় ভয় করে, দেখা যায়
শুধু এ কারণেই সারা রাত জেগে থাকতে হয়। চোখটা লেগে এলেই শুরু হয় স্বপ্নের
অত্যাচার। এমনকি দিনেও! মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর পাশে কেউ একজন ঘুমালে
মন্দ হতো না। তাহলে অন্তত স্বপ্নের অত্যাচার থেকে হয়তো রেহাই পেত। কিন্তু
পাশে যে থাকবে সে নিজে অত্যাচারী হলে? তখন তো স্বপ্ন আর জাগরণ একই
অনুভূতিতে এসে দাঁড়াবে। তার মানে না চাইতেও ওর বাকি জীবনটা কাটাতে হবে
একজন পুরুষের সাথে? যার প্রধান আকর্ষণ হবে ওর শরীর। কথাটা ভাবতেই বিরক্তি
এসে যাচ্ছে।

পরের দিনগুলো যেন খুব দ্রুত কেটে গেল খানসার। আব্বু চলে এলেন দেশে তবে
রাইসা আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে। ওর নাকি পরীক্ষা চলছে। রকির কথা তো
বলাই বাহুল্য! সে তার পরিবারের সাথে সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
আর আম্মুর দুঃখটা এখানেই।
মিলি খালামণির উদ্যোগেই খানসার বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা সুসম্পন্ন হলো। খানসার
আব্বু-আম্মুরও ইচ্ছা অনর্থক দেরি না করে দ্রুত বিয়েটা হয়ে যাক। ইরফানদের
পরিবারের ইচ্ছেও তাই। কেনোনা ইরফানের হাতে এখনো মাসখানেক সময়
থাকলেও ওর বাবা আর বড় ভাইয়ের যাবার সময় হয়ে এসেছে। ওইদিকে খানসার
আব্বুও নাকি পনেরো দিনের বেশি থাকতে পারবেন না। ফলে খুব অল্প সময়ের
মধ্যেই আয়োজনটা সম্পন্ন করতে হলো। তবে ইরফান আরো কিছুদিন এ দেশে
থেকে মা আর নববধূ খানসাকে নিয়ে নিউ জার্সির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ফলে
খানসার আব্বুও তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।
মাত্র বারো দিনের মাথায় খানসার বিয়ে হয়ে গেল। মেয়ে পক্ষের দিক থেকে
আব্দুল্লাহ হামিদ বিয়ের আয়োজনে কোনোরকম কমতি রাখলেন না। মোটামুটি সব
আত্মীয়দেরকেই ফোন করে ডাকালেন। অফিসার্স ক্লাবের আড়ম্বর আয়োজনে আত্মীয়
পরিজনের সানন্দ উপস্থিতিতে সুন্দরভাবেই সুসম্পন্ন হলো খানসার বিয়েটা।
খানসাকে ইরফানের হাতে তুলে দেবার সময় লিলি কাঁদলেও খানসা কাঁদল না। ওর
কান্না পেল না, কেবল মনে হলো ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। তাই কখন একটু ঘুমাতে
পারবে সেই চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার বদলে
সে কানে কানে বলল, ‘আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে আব্বু!’
আব্দুল্লাহ হামিদ মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন।
‘ওকে মাই লাভলী ডল। আমি ইরফানকে বলে দিচ্ছি যেন সে তোমার বিশ্রামের
দিকটা লক্ষ রাখে।

1
অনুষ্ঠান শেষে বউ নিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল ইরফানদের।
এদিকে টানা আড়াই ঘণ্টা স্টেজে বসে থাকতে গিয়ে খানসারও পা ধরে এসেছে।
ওরা যখন বাড়ি পৌঁছুল খানসা তখন ঘুমে ঢুলছে। গতরাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে
পারেনি।
ইরফান জিম অবশ্য গাড়িতেই ফিসফিসিয়ে বলেছে, ‘একটু কষ্ট করো। ফর্মালিটি
গুলো সেরেই ঘুমাতে পারবে তুমি!’
খানসা ঢুলু ঢুলু চোখে জিমের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। সত্যিই
কি সে আজ ঘুমাতে পারবে? তারচেয়েয়ে গাড়িতেই একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়?
নাহ্, লোকে কী বলবে! আর বললই বা! লোকের কথা ভাবতে গেলো খানসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *