বৈরীপ্রিয়াঃ১২
জেগে থাকতে হবে কিন্তু তা তো সম্ভব হচ্ছে না। দু’চোখ আপনা হতেই বন্ধ হয়েআসতে চাইছে। তাছাড়া জিমের বাড়িতে নতুন পরিবেশে আজ কতটুকু ঘুমানোর সুযোগ পাবে কে জানে। আজ তো খানসাকে একজন মানুষ সঙ্গীর মুখোমুখি হতে হবে। তবে অশরীরী সঙ্গীর চেয়ে ঢের ভালো এই মানুষ সঙ্গীটি। ওকে নড়াচড়া করতে দেখলেই চোখ বড় বড় করে তাকায় না। জিহ্বা দিয়ে জল ঝরে না। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেল খানসা নিজেও জানে না। চোখ খুলে কিছুক্ষণ পড়ে রইল খানসা। বোঝার চেষ্টা করছে পরিবেশটা। এত অন্ধকার কেনো চারপাশে। ও যখন গাড়িতে উঠেছিল তখনও আলোয় ঝলমল করছিল চারদিক। বেশ কোলাহলপূর্ণ ছিল পরিবেশটা। আব্বু কাঁদছিল, আম্মুও! আর তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল লোকটা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ইরফান জিম যার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে। সে কোথায়? চারিদিকে তাকিয়ে মনে মনে চমকে উঠল খানসা। এটা তো ওর নিজের ঘর নয়।
এখানে কীভাবে এলো সে। ওর তো ইরফানের সাথে ওদের বাসায় যাবার কথা ছিল। আজ থেকে আম্মুর বদলে ইরফান
ওর সাথে ঘুমুবে। নিপাট ভদ্রলোক। কারণ ইরফান জিম ওর সাথে এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু লোকটা কোথায়…! বিছানায় শুয়েই ঘরে চারপাশে চোখ বুলালো খানসা। বাসর ঘরের পরিবেশটা বড়ই চমৎকার। ঘরের সামনেই একটা ছোট্ট জলাধাে অসংখ্য পিদিম নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। প্রচুর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঢেকে দেয়
হয়েছে চৌবাচ্চাটা। বারান্দা থেকে ভেসে আসা মৃদুমন্দ শীতল হাওয়ায় ঝালর দেয় পর্দাগুলো পতাকার মতো উড়ছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘর জুড়ে। এই কার ঘর? সে কি তবে ইরফানদের বাড়ি পৌঁছে গেছে!
আস্তে করে উঠে বসল খানসা। ঘরটা বেশ বিশাল বলা চলে। খাটটা একেবাে মাঝখানে বসানো হয়েছে। উপর থেকে চাঁদোয়ার মতো নেমে এসেছে ফুলের ধারা ফুলে ফুলে একেবারে ছেয়ে আছে ঘরটা। ছাদের ঠিক মধ্যখান থেকে ফুলের ধার
চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। জমিনটা যেন ফুলেল কার্পেট। বিশাল বিছানার মাঝখানে সদ্য ফোটা পদ্মের মতো বসে আছে খানসা। হঠাৎ দরজা খোলার ‘খুট’ শব্দে বুকটা ধড়াস করে উঠল খানসার। অকারণেই লম্ব ঘোমটা টেনে নিজেকে আড়াল করে নিলো। যেন ঘোমটা টানলে ওকে দেখবে না কেউ।
নিজের আচরণ নিজের কাছেই বেখাপ্পা ঠেকছে খানসার কাছে। তবু কেনে এটা করল বলতে পারবে না। ঘোমটার ভেতর থেকেই মুখ তুলে দেখল আগত মানুষটাকে। মনের অজান্তেই একট বড়সড় ঢোক গিললো সে। চকিতে হাত বাড়িয়ে কাছেই সাজিয়ে রাখা পেতলে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে নিলো সে। চট করে ফেলে দিলো ভেতরের ফুলগুলো। খানসার অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা এখন ভয় আর আতঙ্কে কিছুটা নীলচে দেখাচ্ছে। ওই অশরীরী বদ লোকটা আবার এসেছে! যে প্রতি রাতে এসে ওর ওপর অত্যাচার চালায়। আজ আর সে একা নয়। আজ আরেকজন আছে ওর সাথে। কিন্তু সে কোথায় খানসা জানে না। শুধু জানে এই অশরীরীটাকে আজ থেকে নিজেকে ছুঁতে
দেবেনা সে। একদম না।
লোকটা এগিয়ে আসছে। ঘোমটার জন্য লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না খানসা। দেখার দরকারও নেই তবে এক অজানা ভয় আর অস্বস্তি কাজ করছে মনে। মাথাও কাজ করছে না। শুধু এটুকু জানে আরেকটু কাছে এলেই সজোরে এর মাথায় বসিয়ে দিতে হবে ভারী পেতলের ফুলদানিটা। ভাবনটা মনে আসতেই ফুলদানির খাঁজে হাতের চাপ বাড়ল। হঠাৎ ঘোমটায় টান পড়তেই চমকা উঠে তাকাল। ভয় মেশানো বিস্ময়ের সাথে দেখল তার গাঢ় মেরুন ওড়নার ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওই বদমাশটা যে প্রতিরাতে ওকে বিরক্ত করে। চোখটা খুঁজে দুদন্ড ঘুমাতে দেয় না ওকে। লোকটাও কি একই রকম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে? এখন আর কোনো কিছু ভাববার অবকাশ নেই। আরো কিছু ঘটে যাবার আগেই কাজ সারতে হবে। খানসার হাত সজোরে নেমে এলো ওই মানবরূপী পিশাচটার ওপর। লোকটা কোনো কিছু বলার আগেই পেতলের ফুলদানির আঘাতে লোকটার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ফুলদানি ফেলে দিয়ে দ্রুত বিছানার একপাশে সরে গেল খানসা। বিকট একটা ঠনঠন শব্দে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ভারী পেতলের ফুলদানিটা। ব্যথার তীব্রতায় কুঁচকে উঠল লোকটার মুখ। দু’হাতে কপাল ধরে হাতড়ে বেড সাইড লাইট জ্বালাতে গিয়ে তার হাতের ধাক্কায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল একটা কাচের গ্লাস। কাচ ভাঙার বিদঘুটে শব্দ ভেঙে খানখান করে দিলো নিশুতি রাতের নীরবতাকে। লোকটা এবার অসহায়ের মতো নিজের পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে মাথায় চাপা দিয়ে খানসার দিকে তাকাল। লোকটার কপালে রক্তের ছোপ দেখে মনে মনে আঁতকে উঠল খানসা। তারচেয়েয়ে বেশি অবাক হলো লোকটাকে দেখে। হায় আল্লাহ, এ তো ইরফান! ঢোক গিলে খানিকটা পিছিয়ে গেল খানসা। ইরফান বিস্ময়াহত কণ্ঠে বলল, ‘মারলে কেনো আমাকে? কী করেছি আমি?? আতঙ্ক সরে গিয়ে এবার খানসার চোখে ঝরে পড়ল একরাশ বিস্ময় আর তারপরেই অপরাধবোধ ফুটে উঠল খানসার চোখেমুখে। ভুল ভেঙে গেছে তার। এটা স্বপ্নের ওই লোকটা নয় এটা বাস্তবের মানুষ। তার সদ্য বিবাহিত স্বামী, ইরফান জিম! অনুতাপে জর্জরিত হয়ে উঠল খানসার ভেতরটা। ওর স্যরি হবার আগেই সরে গেছে
ইরফান। দ্রুত ড্রয়ার হাতড়ে কিছু একটা খুঁজছে সে। চেহারা কুঁচকে রেখেছে বেচারা। রাগ আর বিস্ময় ছাপিয়ে ব্যথাটাই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে ওর। কপালের কাছটা টনটন করছে। সাথে ভৌ ভো করছে মাথাটা।
সত্যি বলতে, খানসার এই রূপ দেখবে। সে কল্পনাই করেনি। মেয়েটা তাকে আরেকবার ভুল বুঝল। যদিও সে খানসাকে।
ধরতে যায়নি। সে গিয়েছিল ওর কাঁধ থেকে শুয়োপোকাটা সরাতে…ডফ! বাসর ঘর সাজানোর সময় গাঁদা ফুলটা দিতে বারণ করেছিল ওদের। তারপরেও দিয়েছে। পৌকাটা হয়তো গাঁদা ফুল থেকেই এসেছে। আর কিছু ভাবতে ভালো লাগছেনা।
ইরফানের। বাসর রাতের এমন অভিজ্ঞতার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। কপালের আঘাতটা চড়চড় করে বাড়ছে। ক’দিন ভোগাবে কে জানে! তাছাড়া কাল সকালে বাড়ির সবাই দেখে জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে ইরফান জানেনা।
এমন সময় দরজায় মৃদু করাঘাত শুনল, সাথে চাপা শব্দ। দিয়া ভাবির কণ্ঠ ওটা।
‘ইরফান ভাইয়া, ইজ দেয়ার এনিথিং রং?’ খানসাকে বিস্মিত করে দিয়ে ইরফান বলে উঠল, ‘নো, ইটস ওকে। উই আর গুড!’
সে এবার বিব্রত ভঙ্গিতে ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কী বলবে মাথায় আসছে না। এরকম একটা উদ্ভট আচরণের জন্য সে যে সত্যিই লজ্জিত এটা বলা দরকার। খানসার উপস্থিতি টের পেয়ে একবার মুখ তুলে তাকাল ইরফান। চোখ সরিয়ে ব্যথাকাতর স্বরে বলল, ‘তোমার ঘাড় থেকে শুঁয়ো পোকাটা ফেলো। ওটা সরাতেই
কাছে গিয়েছিলাম!’ বলেই উঠে গিয়ে রুমালটা ভিজিয়ে সেটা কপালে চেপে ধরল। এদিকে খানসা শুঁয়োপোকাটাকে দেখে ভয়ে বোবা বনে গেছে খানসা। এ ভয় স্বপ্নের চেয়েও বেশি ভীতিকর। আতঙ্কিত হয়ে কোনোমতে বলল, ‘এ… এই ফুলের
পোকাটাকে সরাবেন প্লিজ? এক হাতে কপালে রুমালে চেপে ইরফান পেতলের ফুলদানিটা মাটি থেকে তুলে
খানসার দিকে বাড়িয়ে ধরল, ‘এই নাও, এটা দিয়ে ওর মাথায় বাড়ি দাও। আমার মনে হয় এ কাজের জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট! ও তো আর জানে না কার কাঁধে বসেছে!’ লোকটার কণ্ঠে রাগ না অভিমান বোঝা গেল না তবে সে যে যথেষ্ট
সহনশীল তা বুঝতে খানসার বাকি রইল না। লোকটা এবার নিজের মতো কাপড় বদলাতে লেগে গেল। খানসা নিশ্চিত সে রেগে আছে ওর উপর। রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। অমন পেতলের বাড়ি খেলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে। খানসা আর কিছু না বলে গা থেকে শুঁয়োপোকা সহওড়নাটাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে। এবার স্বস্তির সাথে ধীরে ধীরে নিজের
গহনাগুলো খুলে একপাশে রাখতে লাগল।