বৈরীপ্রিয়া: ৯
বিকজ উই আর গোয়িং টু ম্যারি সুইটহার্ট!’
বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল গতরাতের কথা। গতরাতে আম্মু আব্দুর মাছে
কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ওর সাথে কোনো কথা বলতে পারেনি। খানসা
ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আব্বু কি তবে এই ব্যাটার কথাই বলেছে আম্মুকে! খানসা
পারছে না, হঠাৎ করে আব্বু আম্মু দু জনেই ওর বিয়ের জন্য অমন খেপে উঠল।
কেনো! এটা সত্যি যে রাইমা আর রকির বিয়ে তারা নিজেরা আয়োজন করে দিয়ে
পারেননি কারণ তারা দু জনেই নিজেদের পছন্দমতো সঙ্গী বেছে নিয়ে বিয়ে
ফেলেছে। আব্বু-আম্মুর দু জনের কারোরই সেই জামাতা বা পুত্রবধূ দেখার সৌভাগ্য
হয় নাই। সেকারণেই কি খানসার ব্যাপারে তারা এতটা কনসার্ন!
ফোন রেখে ফের বিছানায় ফিরে গিয়ে বালিশে মুখ গুজতেই ডোরবেল বাজল।
আজ বুঝি পৃথিবীর সমস্ত রিঙ্গিং বেল ওর সাথে শত্রুতা করে ঠিক করেছে যে ওঠে
আজ ঘুমাতে দেবেনা। না শোনার ভান করে পড়ে রইল খানিকক্ষণ। মিনিট পাঁচের
বেজে সব শান্ত হয়ে গেল। এমনকি খানসা নিজেও। কখন যে ঘুমে চোখটা লেগে
এসেছে টেরই পায়নি। যখন পেল তখন বেলা চড়ে গেছে।
বেলা বারোটা। একরকম লাফ দিয়েই উঠল খানসা। সাড়ে বারোটায় আহমেদ
স্যারের কোচিং ক্লাস। তারপর দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের পরপরই ম্যাথের জন্য বাবু
স্যারের বাড়ি ছুটতে হবে। আজকাল আর আম্মুর লাগে না। খানসা একাই যাতায়াত
করতে পারে। তবে লোকেদের অতিরিক্ত কৌতূহল এড়াতে সে আজকাল হাটু পর্যন্ত
শর্ট কিছু বোরকা কিনে নিয়েছে। বিভিন্ন কালারের সাথে কালারফুল স্কার্ফ। এটা
অবশ্য মেজো ফুপির বুদ্ধি। তিনিই একদিন বলেছিলেন, ‘আজকাল অনেক
ফ্যাশনেবল বোরকা পাওয়া যায়। অন্তত কোচিং বা স্কুলে যাবার সময় তো ওগুলো
পড়ে বাইরে যেতে পারিস। অনেক কমফোর্ট ফিল করবি।’
কথাটা মনে ধরেছিল খানসার। পরদিনই আম্মুর সাথে গিয়ে এগুলো কিনে এনেছে।
যদিও বোরকাগুলো আম্মুর দু চোখের বিষ। তবু তিনি এলাউ করেছেন। তবে বলে
দিয়েছেন, ‘কোচিং আর স্কুল ছাড়া যেন এগুলো পড়তে না দেখি। আমার মানসম্মান
থাকবে না তাহলে। খানসার নিজেরও বোরকাপ্রীতি নেই কিন্তু বাইরে যাবার সময়
ওকে অনেকটা কভার করে বলে পরা। এগুলো পরার পরও ওর দিকে লোকজনের
ফিরে ফিরে তাকানো কমে না। নিজেকে আর কি দিয়ে ঢাকবে খানসার মাথায় ঢোকে
না! মাঝেমধ্যে মনে হয় আপাদমস্তক কালো বোরকায় নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারলে
মন্দ হতো না বাট ওটা তো আর সম্ভব না। এ্যাবসার্ড একটা ড্রেস।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে গাঢ় বেগুনি রঙা শর্ট বোরকার সাথে ডিপ ভায়োলেট
স্কার্ফ মাথায় জড়িয়ে নিলো খানসা। এতে অন্তত ওর রেশমি চুলগুলো রোদের হাত
থেকে বাঁচে। আর বোরকাটার কারণে ওর ফিগার অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়।
বেরোতে যাবার মুখে আম্মু এসে পাশের ফ্ল্যাটের চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাবার
সময় পাশের ফ্ল্যাটে চাবিটা দিয়ে যাস তো। বলিস, এটা ওদের কাছেই থাকবে।
বাড়ি ছাড়ার সময় আমাদেরকে ফেরত দিয়ে দেবে!
‘পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে নাকি?’ চাবিটা হাতে নিয়ে বলল খানসা।
‘হ্যাঁ, ওদের নিজেদেরই তো বাড়ি আছে বারিধারায়। আণ্ডার কনস্ট্রাকশন বলে এক
বছরের জন্য আমাদের এখানে ভাড়া নিয়েছে!’ আম্মু নিজের রূম থেকেই উত্তর
দিলেন। বেরোবার মুখে খানসা জানাল আব্বুর পরিচিত কোনো এক স্যাডি ওকে
ফোন করেছিল সকালে।
লিলি মুখ গোমড়া করে বললেন, ‘হুম, তোর আব্বু আমাকে গতরাতেই ফোনে
জানিয়েছে ওই ছেলেটার কথা। ছবিও পাঠিয়েছে। তোর মোবাইলেও তো পাঠিয়েছে
দেখিস নি??
‘কই না তো!’ খানসা মোবাইল বের করতে গিয়েও থেমে গেল। দেখতে যেমনই
হোক, কথা বলে পছন্দ হয়নি ওর। কাজেই সুরত দেখে লাভ নাই।
‘আমার তো মনে হয় এরচেয়েয়ে ইরফান ভালো!’ লিলি খানসার দিকে তাকালেন না।
‘বেশি ভালো লাগলে তুমিই বিয়ে করে ফেলো। আমার কাউকেই ভালো লাগেনি।
আর আমি বিয়ে করব না। অন্তত এখন না।” বলেই বেরিয়ে গেল খানসা। লিলি তার
প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো সুযোগই পেলেন না।
গত কয়েকদিন ধরেই আম্মুর সাথে ওর মনোমালিন্য চলছে। কারণ আর কিছুই না,
খানসা মিলি খালামণির প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছে। মিলি খালামণি এরই মধ্যে দু’বার
ফোন করে খানসার মতামত জানতে চেয়েছেন। আম্মু খানসার অমতের কথা বলে
দিয়েছেন খালামণিকে।
তারপরেও সেদিন রাতে শুতে যাবার সময় ওর মতামত আরেকবার জানতে
চেয়েছিলেন আম্মু। খানসা সরাসরি মানা করে দিয়েছিল। তার এক কথা, কোনো
দাড়িওয়ালা চাচা মামা টাইপের লোককে সে বিয়ে করতে পারবে না। এ হলো বুড়ার
ঝার। দু’দিন পরে ঠুস করে মরে যাবে তখন খানসাকে বিধবা হতে হবে। খানসা
সেটা চায় না বলেই ইরফানকে বিয়ে করবে না।
পরের দিনই লিলি অতি সুকৌশলে তার প্রথম চালটা চেলেছিলেন। সকালের নাস্তা
খাবার সময় হাসিমুখে বলেছেন, ইরফানকে যখন পছন্দ হয়নি তো বাদ দে। তুই
বরং তোর বাপ্পী যার খোঁজ পাঠিয়েছে সেই স্যাডিকে বিয়ে কর। কারণ বিয়ে তো
তোকে করতেই হবে।
খানসা কিছুটা রেগে গিয়ে বলেছে, ‘তোমরা দু’জন আজব সব পাবলিক যোগাড়
করে বলবা বিয়ে কর, তা তো হবে না। আমার পছন্দেরও একটা ব্যাপার আছে।
লিলিও এবার রেগে গিয়ে বলেছে, ‘তোর পছন্দের কেউ থাকলে তাকে সামনে আন
দেখি। মানা তো করিনি যে দেবো না কিন্তু তোর বান্দরামি আমি ভালোই জানি।
। তোর এ জীবনে কাউকে পছন্দ হয় নি আর হবেও না। কায়সারের মতো ছেলেকে
তুই পাত্তাই দিলি না। সেই রাগে তোর ফুপি আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করে।
দিয়েছে। এখন তিন-তিনটা প্রবাসী পাত্র হাতে। এদের একজনকে তোর পছন্দ
করতেই হবে। অন্য কোনো অজুহাত খাটবে না এখানে। হয় তুই স্যাডিকে বিয়ে।
করবি নয়তো পাশের ফ্ল্যাটের মাহমুদকে।
খানসা পানি খাচ্ছিল, হঠাৎ বিষম খেলো। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘মাহমুদ আবার কে?
‘আমাদের প্রতিবেশী ভাড়াটে লোকটার নাম মাহমুদ। সেদিন তুই চাবি দিয়ে আসার
পর বিকেলেই মাহমুদের আম্মু এসেছিলেন তোর সাথে দেখা করার জন্য। তুই
ঘুমিয়ে ছিলি বলে ডাকিনি। ওদেরও বিরাট অবস্থা। মাহমুদের আম্মু জানালেন তাদের
বারিধারার বাড়িটা হয়ে গেলে সেখানে চলে যাবেন তারা। তোকে নাকি তার অনেক
পছন্দ হয়েছে। তার ছেলেও তোকে দেখেছে। তারও তোকে পছন্দ। তুই চাইলে
তাকে নিয়েও ভাবতে পারিস।
খানসার হঠাৎ মনে পড়ল চাবি দিতে যাবার সময়কার কথা। সেদিন দরজা খুলেছিল
মামদোমুখো এক লোক। যার পোশাক-আশাকে ছোকড়া সাজার চেষ্টা ছিল চোখে
পড়ার মতো। খানসার এখনো মনে আছে ব্যাটার চোখগুলো চকচক করে উঠেছিল
ওকে দেখে। জিভ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অদৃশ্য জল। গা গুলিয়ে উঠল খানসার।
বমির ভাব করে বলল, ‘ইয়াক… ওই বুড়োভামকে তুমি তোমার মেয়ের জামাই
বানাবে? কী রুচি তোমার!’
‘রুচি তোরই থাক। আমি বাগড়া দিতে যাইনি। কিন্তু আমার সাফ কথা। একা
থাকতে পারবি না তুই। তোকে বিয়ে দিয়ে তবেই আমার শান্তি। আর পাত্র হিসেবে
আপাতত ইরফানের বিকল্প কাউকে দেখছি না। তবু তোর চয়েসের উপর ছাড়লাম।
তিনজনের একজনকে বেছে নিতে হবে তোর। একা বসে থাকতে পারবি না তুই
শেষকালে রাইসার মতো করবি। সে তো এদেশেই ওপেন রিলেশনশিপ করে
লাইফের বারোটা বাজিয়েছে। এখন লন্ডনে গেছে পড়াশোনা দেখাতে। কাজেই
তোর ব্যাপারে আমি একই ভুল করছি না। বিয়ের উদ্যোগ যখন নিয়েছি এটা
বাস্তবায়ন করেই আমি ছাড়ব। লেখাপড়াও আটকে থাকবে না। লেখাপড়াও চলবে।
কিন্তু তোর মনমতো পাত্র পাবার আশায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে থাকতে পারবে।
না আমি। আর যদি একান্তই বিয়ে নিয়ে ঝামেলা করিস তাহলে তুই তোর মতো।
থাক, আমি আমার মতো নিজের লাইফ দেখব। তোর বাপকেও আমার দরকার
নেই। তোরা সব হলি স্বার্থপর। সবাই নিজের জীবন নিয়ে ভাবছে কেবল আমিই।