বৈরীপ্রিয়া: ৭
খানসা কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। লোকটার ভাব জমানোর কারণ ওর
কাছে এখন স্পষ্ট। তার মানে আম্মু ওকে পাত্র দেখাতে নিয়ে এসেছে এখানে। আর
এ কারণেই খালামণির বাড়ি আসার আগে পোশাক নিয়ে ওসব বলা। খানসা এবার
ভালো করে ইরফানকে দেখল। নিজের জন্য স্বামী হিসেবে কতটা পারফেক্ট হবে
বোঝার চেষ্টা করল। যদিও স্বামী শব্দটার প্রতি কোনো আবেগ ওর মধ্যে কাজ করে
না। বুদ্ধি হবার পর থেকে আব্বুকে আম্মুর সাথে স্বামীসূলভ ব্যবহার বলতে মতের
অমিল নিয়ে তুমুল ঝগড়া করতে দেখেছে। সেসব ঝগড়ার একটা কমন ডায়ালগ
হলো, ‘তোমার কাছে আমি কী পেয়েছি?’ এসব ছাড়াও স্ত্রীকে বাদ দিয়ে পরনারী
আর পরপুরুষে আসক্তিও দেখেছে আত্মীয় আর বন্ধুমহলে। ওর বান্ধবী মহুয়ার
আম্মুই তো মহুয়াকে স্কুলে দিয়ে বসে থাকার নাম করে আরেকজনের সাথে ঘুরতে
চলে যায় আবার ছুটির সময় মহুয়াকে নিতে আসে। ভাব ধরে যেন সারাদিন স্কুল
ক্যাম্পাসে বসে ছিল। মহুয়া নিজেই একদিন বলেছিল ওর বাবা-মায়ের দাম্পত্য
কলহের কথা। সব মিলিয়ে বিয়ে ব্যাপারটাই খানসার কাছে একটা ফেইক সম্পর্ক
মনে হয়। এতই যখন অমিল তাহলে বিয়ে নামক এই প্রহসনের মানে কী! অন্যের
সাথে যদি সম্পর্ক রাখতেই হয় তাহলে তাকে বিয়ে না করলেই হয়, আরেকজনকে
ধোঁকা দেবার মানে কী?
খানসার ছোট মাথায় এই হিসাব মেলে না তাই প্রেম, বিয়ে বা স্বামী শব্দগুলোর প্রতি
ওর বরাবরই আস্থার অভাব।
তবে এই লোকটা স্বামী হিসেবে কেমন হবে কে জানে! আজ সে খানসাকে দেখে
অমায়িক হাসছে, কাল আবার আরেকজনের কাছে যে ছুটবে না তার বিশ্বাস কী!
কেমন লাগছে আমাদের দেশ আর দেশের মানুষ?’ বড় খালামণির কথায় খানসার
ভাবনায় ছেদ পড়ল। বুঝতে পারল প্রশ্নটা খালামণি ওই লোকটাকে করেছেন যার
নাম ইরফান জিম। নামটা সুন্দর তবে ব্যাটা নিজে ততটা সুন্দর না। খানসা লক্ষ্য
করল ইরফান জিমের হাসি আরো চওড়া হয়েছে খালামণির প্রশ্ন শুনে। সে খানসার
দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘চমৎকার, আন্টি। মাশাআল্লাহ খুবই সুন্দর।
“তাই নাকি? এ তো খুবই ভালো কথা। চলো এবার চা খেতে খেতে কথা বলি।
খানসা তুই জিমকে নিয়ে ড্রইংরুমে আয়।’ বলে খালামণি চলে গেলে খানসা বিরক্তি
চেপে বলল, বুঝলাম না, আমিও তো আজকের গেস্ট। অথচ আমাকে আপনার
হোস্ট বানিয়ে দেয়া হলো কেনো??
‘কোনো সমস্যা নেই। আপনার হোস্ট হতে আপত্তি থাকলে আমিই আপনার হোস্ট
হতে রাজি আছি। বরং আজ আপনিই আমার গেস্ট। আসুন, প্লিজ।’ বলে
ওয়েলকামিং ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে খানসাকে পথ দেখালো ইরফান জিম
খানসাও আর দ্বিরুক্তি না করে সবার সাথে ড্রইংরুমে এসে বসল। আড্ডা আরো
ঘণ্টাখানেকের মতো চলল। তবে আড্ডার বেশির ভাগ সময়ই খানসা ছিল নীরব
শ্রোতা। সে চুপচাপ বসে শিলা আন্টির মুখে আমেরিকার জীবনাচরণ শুনছিল।
অজান্তেই হঠাৎ চোখ চলে গেল ইরফানের উপর। যা ভেবেছিল তাই, ব্যাটা ওর
দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা ঠিক কায়সার ভাইয়ের মতো। যেন প্রেমের করুণা
ভিক্ষা চাইছে। আর প্রেমের অপর নাম যে কাম এটা খানসা তার ষোলো বছরের
জীবনে ভালো করেই জেনে গিয়েছে। খানসার ইচ্ছে হচ্ছিল জিভ বের করে বিশ্রী
করে ভেংচি কেটে ব্যাটাকে ভয় পাইয়ে দেয়।
বড় খালামণির বাড়ি থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল খানসাদের। বাড়ি ফিরে
ইরফানদের বিষয় নিয়ে ততটা কথা বলার সুযোগ পেলেন না লিলি। কারণ তার
আগেই খানসার আব্বু ফোন করায় লিলি তার সাথে কথা বলা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে
পড়লেন। খানসা ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা।
বাড়ির ল্যান্ডফোনটা অনবরত বাজছে। ধরার কি কেউ নাই? বিরক্তিতে কান চাপা
দিয়ে পাশ ফিরল খানসা। যদিও আজকাল ওকে খানসা বলে ডাকার কেউ নাই।
আব্বু দেশে থাকতে সে-ই আদর করে ডাকত, ‘আমার খানসা।’ অথচ আম্মুর চরম
অপছন্দের নাম এটা। তার ডাকনাম হলো রাইসা। খানসার বড় বোনের নাম রাইমা।
খানসার নাম রাইসা। আম্মু একে রাইমা বলেই ডাকেন। তবে সেটা আদর করে কী
ড্রইংরুমের ফোনটা অনবরত ৰাজছে। আম্মু সম্ভবত বাথরুমে। অগত্যা বালিশ ছুঁড়ে
ফেলে অগত্যা বানসাকেই ফোন ধরতে উঠতে হলো। নিতান্ত অবহেলা ভরে রিসিভার
কানে ঠেকালো, ‘হ্যালো’
‘ইটস খানসা, রাইট??
‘ওয়াও, হোয়াট আ সিদ্ধি ভয়েজ।
কত নম্বরে ফোন
করলে ঘড়ি দেখল। নয়টা পাঁচ। এটা
কোনো ফোন করার টাইম ঘুমায়। কে এই যন্ত্রণা?
‘হেই বেবি, তুমি তো খানসা। আব্দুল্লাহ মামার মেয়ে। ঠিক না? তোমার ছবি আমি
মামার কাছে দেখেছি। হোয়াট আ ফিগার। দুর্দান্ত। ছবিতেই তুমি মারদাঙ্গা বাস্তবে না
জানি কী! আ কিউট নাইটিঙ্গেল। বাট আই’ভ নেভার সিন ইউ এ্যারাউণ্ড। তবে চোখ
বন্ধ করে তোমার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস বলে দিতে পারব জানো ? উম্ম্…দাঁড়াও।
থার্টি ফোর!’
মুহূর্তেই ড্রইংরুমের অপরপাশের দেয়ালে ঝোলানো ফুল লেংথের আয়নায় নিজেকে
এক ঝলক দেখে নিলো খানসা। অদ্ভুত! ওর ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ও নিজেই
ঠিকমতো জানে না অথচ এই ব্যাটা জেনে বসে আছে! শালা, ফটকাবাজ দা গ্রেট।
মেয়ে পটানোর ফন্দি ভালোই জানে। কে এই বেহায়া? ইরফান জিমের ভয়েস তো
এমন নয়। গতকাল দুই ঘণ্টা ছিল একসাথে। কণ্ঠ মুখস্থ হয়ে গেছে। খানসা এবার
ফোন রাখার পাঁয়তারা করল।
‘স্যরি, আম্মু কাছেপিঠে নেই। ইউ’ভ টু কল…’
‘আরে আমি তো তোমাকে ফোন করেছি খানসা! তোমার আম্মুকে তো করি নাই!’
খানসার মুখের কথা দ্রুত লুফে নিয়ে বলল লোকটা।
খানসা এবার যারপরনাই বিরক্ত হলো, ‘আমাকে আপনার কী দরকার??
‘সে কী! মামা তোমাকে বলেনি আমাদের ব্যাপারে? আমি হলাম স্যাডি! ফুল নেইম
সালাউদ্দিন। এখন চিনতে পারছ তো??
এই ব্যাটার নাম স্যাডি? হাউ স্যাড! আর নাম পাইল না। সালাউদ্দিন থেকে স্যাডি!”
খানসা কপাল কুঁচকে দু’চোখ বন্ধ করে মনে মনে কথাগুলো বললেও মুখে বলল,
‘আমি রাখছি!’
‘হেই, ওয়ান সেকেন্ড। তোমার সেল নাম্বারটা আমাকে দাও। মামা তোমার কাছ
থেকে নিয়ে নিতে বলে দিয়েছে।’
‘আমারে তো কুত্তায় কামড়াইসে, তোরে আমি আমার সেল নাম্বার দিবো!’ এবারও
মনে মনেই বলল খানসা। কারণ লোকটা কে সে জানে না। তাছাড়া সে আব্বুর
রেফারেন্স দিয়েছে কাজেই অভদ্রতা করা যাবে না।
ভদ্রভাবেই বলল, “স্যরি, অচেনা কাউকে আমি আসলে সেল নাম্বার দেই না।’
‘কি বলছ! একটু আগেই তো চেনাজানা হলো। তাছাড়া প্রথমেই তো বললাম, আমি
স্যাডি, পুরা নাম সালাউদ্দিন। তোমার বাবার গ্রোসারি শপের পাশেই আমার শপ।
আমি এখানে জব করি। তোমার বাবা, আইমিন আব্দুল্লাহ মামা আমার কথাই তোমার
আম্মুকে বলেছেন। আমার ছবিও দেয়া আছে, দেখে নিও।’
‘আমি কোনো ছবি দেখিনি। আর আপনার ছবি দেখে আমি কী করব?