বৈরীপ্রিয়া ;২

বৈরীপ্রিয়া ;২

দেখুন, প্রথমেই বলেছি মেয়েটা একটু বেপরোয়া ধরনের। কারো সাথেই ওর
নিবনা হয় না। বিশেষ করে ছেলেদের সাথেই ওর লাগে বেশি। ছেলেগুলাও ওকেই
ছ! মেয়েটা কোনো এক বিচিত্র কারণে ছেলেদের দেখতে পারেনা। ইরেশ ওর
থে লাগতে না গেলেই পারে। ক্লাসে কি বন্ধুর অভাব?’ মা’কে বলে ছেলের দিকে।
শোনো ইরেশ, আমি যেন তোমাকে ওর সাথে আর লাগতে না দেখি, মনে থাকবে??
ইরেশ কাতর চেহারাটা সামান্য বামে কাত করে মায়ের সাথে বেরিয়ে গেলে।

1
প্রিন্সিপ্যাল বেল বাজিয়ে বুয়াকে দিয়ে ফের খানসাকে ডাকালেন। মেয়েটাকে একটু
শাসিয়ে দিতে হবে। কেউ দুষ্টুমি করলেই তাকে এভাবে জখম করে ফেলাটা
কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে এটা সত্যি, মেয়েটা দেখতে সুন্দর বলে ছেলেগুলো
ওর পেছনেই বেশি লাগে। ক্লাস টিচারকে বলে ছেলেমেয়েদের বেগুলো আলাদা
করে দিতে হবে। অন্তত ক্লাসে যেন কেউ ফাজলামি করার সুযোগ না পায়।
খানসা ক্লাসে এসে বসতেই মারিয়া ওকে ধরল, ‘কী রে, কয়টা বেত খেলি?”
ওর কথা শুনে খানসা বাঁকা হাসল। আমাকে বেত মারবে? কেনো? হোয়াট ডিড
আই ডু? হৃমনে ক্যায়া কিয়া?
হিন্দি তো ভালোই জানিস!’ মারিয়া হাসল। খানসা দুই কাঁধ নাচিয়ে বলল।
‘আম্মু সারাদিন হিন্দি সিনেমা নিয়ে ডুবে থাকে। ওগুলোই কানে আসে। মুখস্থ হয়ে
‘হুম। আমি তো ভাবলাম। প্রিন্সিপ্যাল মিস যখন তোকে ডেকেছেন তো সিরিয়াস
কিছুই হবে। প্রিন্সিপ্যাল মিস অনেক রাগী কিনা!
‘ওনার রাগের ঘোড়াই কেয়ার করি আমি। আমাকে আজ অকারণে বেত মারলে আমি
দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতাম! আমাকে তো চেনে না।’ বলে খানসা শান্ত মুখে ব্যাগ গোছাল।
মারিয়া ভয় মেশানো বিস্ময়ে খানসাকে দেখল আর কোনো কথা বাড়াল না।
খানসাকে তার গত দুই মাসেই চেনা হয়ে গেছে। যে মেয়ে তার সিটে পা রাখার
জন্য কারো পা কলম দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে দিতে পারে তাকে বিশ্বাস কী!
খানসার একা থাকতে একটুও খারাপ লাগে না। আপন ভুবনে চমৎকার সময়
কাটায় সে। ছোটবেলা থেকে বড় বোন রাইসা কিংবা ভাই রকির সাথে ওর তেমন।
সখ্যতা কখনোই গড়ে ওঠেনি। রকি বরাবরই আম্মুর শাহজাদা। যার ফলে আম্মুর
আদর আর আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠতে গিয়ে বেপরোয়া হতে সময় লাগে নি।
খানসার জীবনের সবচেয়েয়ে কঠিন সবক-টাই তো রকির কাছ থেকে পাওয়া। আর
সেটা হলো মেয়েদের সবচেয়েয়ে বড় দুর্বলতা হলো তাদের শরীর। শরীরের প্রতি
সবার অদম্য আকর্ষণের কারণেই হয়তো নিজেকে মানুষ কম, শরীর সর্বস্ব একটা মেয়ে।

1

আজব প্রাণী বলে মনে হয়। যার শরীরের সবটাই নারীখাদক পুরুষের কাছে
লোভনীয়। নারীখাদক নামটা খানসার নিজের দেয়া। ওর কাছে ওর আব্বু ছাড়া
সবাই নারীখাদক। কেনোনা জীবনের এই সময়টাতে এসে খানসা বুঝতে পারছে,
একটা মেয়ে কোথাও নিরাপদ না। সে আপনজন হোক কী পর। সহোদর ভাই রকি
কিংবা সহপাঠী ইরেশ। কাজিনদের কেউ বা আঙ্কেলদের কেউ। সবার চোখে একই
ছায়া, একই লালসা, উদগ্র কামনা। এটা দেখেই বড় হচ্ছে খানসা। ব্যতিক্রম শুধু
একজনই। ওটা ওর আব্বু।
এই একজনকে খানসা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওর যত আদর আব্দার
সবই আব্বুর কাছে। আব্বু ওর কাছে বন্ধুর মতো। নিজের সব কথা সে আব্বুকে
শেয়ার করতে পারে অকপটে। আব্বুও ওকে বন্ধুর মতোই পরামর্শ দেয়। অথচ
দুঃখের বিষয় হলো সেই আব্বুও ওর কাছ থেকে এখন অনেক দূরে থাকে।
টরেন্টোতে। আম্মুসহ ওকে নেবার চেষ্টায় আছেন অনেক দিন ধরেই। এদিকে
খানসার বড় বোন রাইসাও স্কলারশিপ পাবার পরপরই নেদারল্যান্ড চলে গেছে। আর
গত বছর গেছে রকি ভাইয়া। জাপানের মেয়েদের জ্বালাতে। বাংলাদেশে পড়ে আছে
খানসা আর ওর আম্মু। তবে আব্বু দেশের বাইরে থাকলেও সময় পেলেই ফোন
করে। আমার সাথে কথা না হোক, খানসার সাথে কথা হবেই। খানসার সাথে কথা
না বলে আব্বু থাকতেই পারে না।
খানসা ঠিক করেছে, আজ যখন আব্বু ফোন দেবে তখন ইরেশকে সাইজ করার
কথাটা বলবে আব্বুকে। আব্বুই ওকে শিখিয়েছে, টিট ফর ট্যাট।
একবার স্কুলে নার্সারি ক্লাসে এক ছেলে ওর সাথে প্রথম দুষ্টুমি করেছিল। সেদিন
খানসা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিল। আব্বু ওকে আদর করে জানতে চাইলে ও
বলে দিয়েছিল যে ছেলেটা সবার সামনে ওর ফ্রক তুলে হাফপ্যান্ট দেখিয়ে হাসাহাসি
করেছে আর তাতে পুরো ক্লাস হেসেছে।

3
সেদিন আব্বু বলেছিল, ‘ও এরকম করল আর তুমি বোকার মতো কাঁদলে? এক
ঘুষিতে ওর নাক ফাটিয়ে দিলে না কেনো? তুমি কি জানো নালিশ করা বোকামী?
স্ট্যান্ডবাই অ্যাকশন নেবে।’ সেই থেকে আজ অবধি খানসা স্ট্যাণ্ডবাই অ্যাকশন
পালন করে যাচ্ছে। ধরো পেরেক মারো হাতুড়ি।
সেটাই ছিল শুরু। এরপর আর কোনোদিন খানসাকে কাঁদতে হয়নি। যে-ই
অনাকাঙ্খিতভাবে ওর ঘনিষ্ট হতে চেয়েছে তাকেই সাইজ করেছে খানসা। একবার
আব্বুর বন্ধু হায়দার চাচ্চু দুষ্টুমির ছলে ওর সাথে খুব খারাপ ধরনের আচরণ করতে
চেয়েছিল তখন খানসা সোজা হায়দার চাচ্চুর বউ মেয়েদের সামনে গিয়ে সে কথা
রীতিমতো অভিনয় করে দেখিয়ে বলে দিলে সবার মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে যায়। আম্মু
ওর মুখ চেপে ধরেছিল কিন্তু খানসা দমেনি। সে তার কথা শেষ করেছিল। এরপর
থেকে হায়দার চাচ্চুদের সাথে ওদের ফ্যামিলি রিলেশনে ব্রেকাপ হয়ে যায়।

জিনিস বুঝে গেছে যে কারমার ভাই
সবাই আসলে একই। ওর মতো, সব রসুনের
প্রকাশই একেক রকম। কেউ সুযোগের অভাবে সৎ ে
কায়সার ভাই হলেন সাহসের অভাবে সব। ঘানমার অন্তত তাই মনে হয় কারণ
খানসাকে একা পেলেও কখনো বাজে আচরণ করেননি।
স্কুল ছুটির পর আজও বেরোবার মুখেই দেখা হয়ে গেল কায়সার ভাইয়ের সঙ্গে।
খানসা তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও পারল না। কেনোনা তিনি নিজেই
হয়ে জানালেন যে তিনি নাকি এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন এবং তখনই তার
ছুটির সময় আর বাড়ি পৌঁছে দেবার কথাটা মনে পড়ে গেল। খানসার সামনেই তিনি।
আম্মুকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন যে তিনিই অবানসাকে নিয়ে ফিরছেন।
খানসা নিশ্চিত আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে যাবেন কারণ আজ আর তার
স্কুলে আসতে হবে না। ফলে মন না চাইলেও খানসাকে কায়সারের সাথে বাইকে
চেশেই বাড়ি ফিরতে হলো। কায়সার ভাইয়ের এহেন আদিখ্যেতার জন্য না থ
আম্মুর উদাসীনতাকেই দায়ী করে। তিনি খানসার ব্যাপারে আরেকটু সচেতন হয়ে
এই ছেলেগুলো খানসাকে একটা বিরক্ত করার সাহস শেষ না।
সেই থেকে শিল্পায় খানসার নিজের জন্য সমাধান হিসেবে নির্লিপ্ততা
করে না বরং দূরে ঠেলে দেয়। নিজের চারপাশে রূঢ় আচরণের দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে
কারো পক্ষে ওর কাছে আসাটাই অসম্ভব, ছোঁয়া তো দূরে থাক।
খানসার আম্মু বাড়িতেই ছিলেন। তিনি কায়সারকে দেখে খুশি হয়ে বললেন
আমার শপিংয়ে দেরি হয়ে যে। তুমি কি কিছুক্ষণ বসবে??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *