‘বৈরীপ্রিয়া ৩
জি, হ্যাঁ…না মানে। বসতে তো সমস্যা নেই, মামি। এমনকি আপনি বেশি ব্যস্ত
থাকলে খানসাকে বিকালেও আমিই কোচিংয়ে দিয়ে আসতে পারি, যদি আপনি বলেন
আরকি!’
বিস্মিত উচ্ছাসে হেসে ফেললেন খানসার আম্মু লিলি!
‘ওয়াও, তাহলে তো খুবই ভালো হয়।’
‘তাহলে আরেকটা কাজ করি না কেনো, আমি খানসাকে কোচিংয়ে পৌঁছে দিয়ে
আবার ফেরার সময় একবারে ওকে সাথে করেই নিয়ে আসি। সেই সুযোগে আপনি
স্বচ্ছন্দে শপিং সেরে ফেললেন। আজ আমি একদম ফ্রি আরকি। নইলে এতটা সময়
পেতাম না।’
লিলি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে না পেলেও খানসার বিরক্তি প্রকাশের ভাষা তৈরি
ছিল।
তেতে উঠল সে, ‘আপনি এত বেহায়া কেনো! আপনার কোনো কাজ নাই আমাকে
আনা নেয়া ছাড়া। মাসের কয়দিন ফ্রি থাকেনো আপনি?’
‘খানসা একদম বেয়াদবি করবি না কায়সার ভাইয়ের সাথে।’ বিব্রত কায়সারকে
উদ্ধার করলেন লিলি।
তাতে খানসার বিরক্তি কমল না। সে খেয়েদেয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা বন্ধ করে নিজের
ঘরে শুয়ে রইল আর সাফ জানিয়ে দিলো যে সে আজ কোচিংয়ে যাবে না। লিলি
ততক্ষণে শপিংয়ে চলে গেছেন। তবে দায়িত্বটা নিষ্ঠার সাথেই পালন করল কায়সার।
ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিলো লিলি মামিকে। সাথে সাথেই খানসাকে কল ব্যাক
করলেন তিনি। ফোনে কঠিনভাবে শাসালেন। যেন কোনো অবস্থাতেই কোচিং মিস না
করে খানসা। নয়তো তিনি বাড়ি ফিরে আজ ওর খবর করে ফেলবেন।
মায়ের খবর করার পদ্ধতি ভালোই জানা আছে খানসার। আর এটাই ওর চরমতম
দুর্বলতা। সেটা হলো খানসা একা ঘুমাতে ভয় পায়। যে খানসাকে তাবৎ সহপাঠী
সমাজসহ নিকটাত্মীয়রা পর্যন্ত এড়িয়ে চলে সেই খানসা ভয় পায় এক অদেখা
সত্ত্বাকে। এক অশরীরি উপস্থিতি, যার সাথে ওর প্রথম পরিচয় খুব ছোটবেলায়
বাথরুমে। ভয়টা আরো স্থায়ী রূপ পেয়েছিল যেদিন আম্মু ওকে পানিশড করার জন্য
বাথরুমে একঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন। পরে খানসাকে অজ্ঞান অবস্থায় বের করা হয়
সেখান থেকে। প্রথম কিছুদিন আব্বুর বকা, আত্মীয়দের উপদেশ চলল তারপর যেই
কে সেই। রেগে গেলেই আম্মু ওর সাথে এই বাথরুম ট্রিটমেন্টটা করে থাকেনো।
তার মতে খানসাকে পানিশড করার সবচেয়ে দুর্দান্ত আইডিয়া হলো বাথরুমে আটকে
রাখা। কারণ আম্মু ভালো করেই জানেন খানসা কোনো এক বিচিত্র কারণে বাথরুমে
থাকতে প্রচণ্ড ভয় পায়। তার এই দজ্জাল মেয়ে দিনের বেলাতেও বাথরুমে গেলে ভয় পায়।
লাইট জ্বালিয়ে রাখে এবং ছিটকিনি খুলে রাখে। এটা জানার পর আম্মু
ভয় দেখানোর জন্য ওই পদ্ধতিটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও গড়ার
সাথে বাথরুমের ভয়টাও ফিকে হয়ে এসেছে। তবে ভয় পাবার সমস্যাটা পুরোপু
কমে যায়নি, সমস্যা তার ধরন বদলেছে মাত্র। এখন খানসা বাথরুমে পা
তার যাবতীয় ভয় এখন রাতে বিছানায় এবং ঘুমের ঘোরে। দিন থেকে
চোখটা লাগলেই হলো। আজব সব স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম ভেঙে
যার ফলে আম্মুকে নিয়মিত ঘুমাতে হয় ওর সাথে। তাছাড়া আদু, রকি আর রাবনা
দেশের বাইরে চলে যাবার পর থেকে খানসার সাথে আমার পার্মানেন্টাল ঘুমাগো
ব্যবস্থা হয়েছে। কারণ লিলি নিজেও একা ঘুমাতে পছন্দ করেন না। কিন্তু খানসার
জন্য এটা পরম স্বস্তির বিষয়। কারণ আম্মু সাথে ঘুমালে স্বপ্নের অত্যাচারটা কিছুটা
হলেও কম থাকে যদিও স্বপ্ন দেখাটা একেবারে বন্ধ হয় না।
তবে মাসের বিশেষ দিনগুলোতে ওই অশরীরী সমস্যাটা বেড়ে যায়। তখন সে
কোনো কিছু ওর বুকের ওপর বসে ওকে চেপে ধরে। নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়
তখন। আর ওই সময় গোঙাতে থাকে খানসা, যেটা টের পেলে গায়ে হাত রাসে
আম্মু বা কখনো মৃদু ধাক্কা দেয়। তাতেই ঘোর কেটে যায় খানসার । আম্মু ওর এই
দুর্বলতার খবর রাখেন বলেই খবর করবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন। তার মানে আম্মু
রাতে ওর সাথে শোবেন না, আর এটাই ওর শাস্তি।
অগত্যা খানসাকে নিজের পরাজয় মেনে নিয়েই কায়সারের সাথে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে
বেরুতে হলো। ততক্ষণ বেকুবের মতো টিভি খুলে এনিম্যাল প্ল্যানেট দেখছিল
বেহায়াটা। এতটাই তার দায়! তবে খানসা এতটাও ছোট নয় যে কায়সারের মনের
খবর জানবে না। এ বছরই সে ক্লাস টেনে উঠেছে। চোখের ইঙ্গিত তো বোঝেই।
মনের খবরও আজকাল যথাযথ ভাবেই চলে আসে খানসার কাছে। পুরুষের চোখের
ভাষাটা তো কৈশোরেই রপ্ত হয়ে গিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই টের পায়
কায়সারের চোখের ভাষা ইরেশ বা হায়দার চাচ্চুর চেয়ে আলাদা। কিন্তু খানসার
তাতে মন ভেজে না। কায়সারকে পছন্দ নয় তার। ছ্যাবলা পুরুষ খানসার দু’চোখের
বিষ। পুরুষ মানুষ কেমন হওয়া উচিত তা ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না খানসা।
কখনো তেমন কাউকে চোখে পড়েনি ওর। সেকারণেই পুরুষ মাত্রেই ওর কাছে
লোভী। এমনকি কায়সার ভাইও। যদিও সে বাকিদের মতো নোংরাভাবে না এসে
প্রেমপূর্ণ অভিব্যক্তি নিয়ে এসেছে। এটাও খানসার দৃষ্টিতে আরেক ভণ্ডামি। খানসা
বিশ্বাস করে পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই।
| লিপি আন্টিকে ফোন করার মাত্র মিনিট দশেকের মধ্যেই খানসাকে বেরিয়ে আসতে
দেখে চাপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কায়সার। যাক, মিশন ব্যর্থ হয়নি তার। খানসার
সাথে সময় কাটানোর কিছু সুযোগ আজ মিলবে। তবে খানসার পোশাক দেখে জ
কুঁচকালো সে। খানসা আজ স্কার্ট বা টুপিস না পরে ফতুয়া আর জিন্স পরেছে।
খানসার এসব পুরুষালি অবয়ব কায়সারের একদম পছন্দ নয়। তবে এটা যে স্তর
বিতৃষ্ণা জাগানোর জন্য খানসা ইচ্ছে করেই পড়েছে সে খবর অবশ্য ওর জানার
কথা নয়।
বাইকে ওঠার আগে কায়সার খানিক ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ‘ইয়ে, তোমার
মেয়েলি জামাকাপড় কিছু নেই?’
‘মানে?’ খানসা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
‘না, মানে প্রায়ই দেখি ছেলেদের কাপড় পরো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। শাড়ি বা
সেলোয়ার-কামিজ পড়লে কিন্তু তোমাকে দারুণ দেখায়। এসব পরলে তোমাকে জাস্ট
টমবয়দের মতো লাগে।’
একপলক নিজেকে দেখে কাঁধ ঝাঁকালো খানসা। বাইকের দু’পাশে দু’পা আর হাত
দু’টোকে উরুর উপর রেখে পুরুষালি ভঙ্গিতে বসে বলল, ‘স্যরি, আই’ভ নাথিং টু
ডু! টমবয় মনে হলে টমবয়! আই ডোন্ট লাইক দোজ গার্লি ক্লথস।’ বেজার মুখে
এতটুকু বলেই কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল খানসা। ‘আ’ম গেটিং লেইট কায়জার ভাই!
আপনি আমার দেরি করিয়ে দিচ্ছেন!’
‘ওহ্, স্যরি…স্যরি!’ বলে কায়সার দ্রুত বাইকে চাপল। ক্ষীণ আশা ছিল খানসা
হয়তো ওকে ধরে বসবে। সেই আশাতে স্পিডোমিটারের কাঁটাও তুলেছিল সত্তরের
উপর কিন্তু কোনো লাভ হয়নি তাতে। খানসা দু’হাত পেছনে দিয়ে বাইকের
ক্যারিয়ার স্ট্যান্ড ধরে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে বসেছিল। আর দশটা মেয়ের মতো, ‘আউ’
বা ‘মাগো’ বলে ওকে খামচে ধরেনি।
তারপরেও কায়সার ওর আশা ছাড়েনি। পরদিন রাতেই বড় চাচ্চুর একমাত্র মেয়ে
টিয়ার এনগেজমেন্ট পার্টিতে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কায়সার জানত খানসা আজ
না এসে পারবে না। যেহেতু এটা ফ্যামিলি প্রোগ্রাম, তাছাড়া যেহেতু এটা বিয়েসংক্রান্