বৈরীপ্রিয়া ; ৫
বড়বোনকে ফোন দিলেন তিনি। মিনি আপা ছাড়া এই মুহূর্তে পরামর্শ করার মতো
আর কাউকে পাচ্ছেন না তিনি।
মিলি আপা ফোন ধরতেই হড়বড় করে সব খুলে বললেন তিনি। মিনি সব শুনে ঠাণ্ডা
মাথায় বললেন, ‘ওকে বিয়ে দিয়ে দে, নিখি! ভালো একটা ছেলে দেখে বিয়ে দে।
বিয়ে দিলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন অদ্ভুত তোকে জ্বালাবে না। তাছাড়া তোর মেয়েকে
দেখলে আমারই ভয় হয়। ওকে আমার কাছে রাখব কীভাবে? তারচেয়ে ওইটাই কর।
ওকে বিয়ে দিয়ে দে। বিয়ে হলে আপনিই লাইনে চলে আসবে।’
“কিন্তু এখনি বিয়ে কীভাবে সেই! মেয়ের বয়স কতো যে ওকে বিয়ে দেবো?? লি
বিভ্রান্ত বোধ করছেন।
‘ষোলো গ্লাস। কম কোথায়! তাছাড়া অমন আগুনের মতো রূপ মেয়ের। এই মেয়ে
ঘরে রাখলে এসব হ্যাপা পোহাতেই হবে। না জেনেই বলছি না লিলি। বাপ তো বারো
মাস বাইরে পড়ে থাকে। এই মেয়ে তোর হাড়-মাংস কালি করে ফেলবে। তাই বলছি
বিয়ে দিয়ে দে। বলেই তিনি গলা খাদে নামালেন। শোন, তোর মেয়ে বয়সেই যা
ষোলো, গায়েগতরে তো আর ষোলো না। বিশ একুশ বছরের মেয়েদের মতো উর্বশি
দেখায় ওকে। পুরুষগুলা কী সাথে ছোঁক ছোঁক করে। কাজেই যা বলি শোন। আরো
ঝামেলা হবার আগেই ভালো একটা ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে দেখে ওর হাতে ধরিয়ে দে
মেয়েটাকে। জামাই নিজেই তখন দেখেশুনে রাখবে তোর মেয়েকে। আর বিয়ে হলে
খানসার তেজও কমে আসবে। এমন কত দেখলাম। বিয়ের আগেই সব লক্ষ
বিয়ের পরে ঠিকই লাট্টু বনে যায়। তখন জামাই ছাড়া আর কিছু বুঝে না।
‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু মনমতো পাত্র চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না আপা।
‘সেটাই ভাবছিলাম সকাল থেকে। তোর মেয়ের কপালটা কত ভালো! মাত্র ক’দিন
আগেই আমার বান্ধবী শিলা এসেছে নিউ জার্সি থেকে। ও আমাকে বেশ কয়েকদিন
ধরেই বলছিল ওর ছেলের জন্য সুন্দর একটা পাত্রী খুঁজে দিতে। এখন খানসা প্রসঙ্গে
মনে পড়ল। তুই রাজি থাকলে শিলার সাথে কথা বলব।
‘ছেলে নিউ জার্সি থাকে?’ লিলির যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। বিস্ময় কাটিয়ে
উঠে বললেন, ‘কী বলো আপা! এ তো খুবই ভালো কথা। তুমি আগে ছেলেটা
সম্পর্কে সব জানাও তো, আপা। ওর বাবাকে বলতে হবে তো। মিল মতো হলে
দিয়ে দেবো!”
‘ছেলের ব্যাপারে তুই নিশ্চিন্ত থাক। ছেলে আমার হাতের। তোরা মা-মেয়ে ছেলে
পছন্দ কর, বিয়ে লাগিয়ে দেবো। এখন খানসা মানলেই হলো।
‘ওকে মানানোর টেকনিক আমি ভালোই জানি, আপা। তুমি আমাকে ছেলেটা
দেখাও।”
‘ঠিক আছে। কাল আমার বাড়ি আয়, দেখা করিয়ে দেবো। আমার তো মনে হয়।
তোর মেয়ের জন্য ইরফানের মতো একটা ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলেই দরকার। মি
মতো বলতে যদি স্ট্যাটাস বোঝাস তো সেটা এই ছেলের আছে। আমল বলতে ওই
বয়সটুকুই। যদিও আমি এটা গোনায় ধরি না কারণ জামাই যত ভারিক্কি হবে তার
মেজাজ তত ঠাণ্ডা। চ্যাংড়াগুলো তো কথার আগে ঝগড়া বাঁধায় আর ছুতানাতায়
ডিভোর্স দেয়। তোর মেয়ের চ্যাংড়া জামাই টিকবে না। হয় সে তোর মেয়েরে মারবে,
নয় তোর মেয়ে তারে মারবে।’
‘একেবারে মন্দ বলোনি। যা করে তা আমিই জানি। ওর জ্বালায় রাতে ঘুমাতে পারি
না। সাইক্রায়াটিস্টও তো দেখালাম। আচ্ছা, ছেলের বয়স কি খুব বেশি?
‘আরে নাহ, খানসার থেকে সামান্য বেশি।’
‘সামান্য মানে কত?’
‘কত আর আটাশ, তিরিশ হবে। ছেলেদের জন্য এটা আবার কোনো বয়স হলো
নাকি। সোনার আংটি বাঁকা হলেই বা কী! আর শোন, ওই সব সাইকিয়াট্রিস্ট ও
কাজ হবে না। এরা জিন ফিন মানে না। খামোকা মেয়েরে মানসিক রোগী বানিয়ে
ফেলবে। তোর মেয়ে জাতে মাতাল তালে ঠিক। ঘুমালেই ভয় পায় আর জেগে
থাকলে ওরেই সবাই ভয় পায়। ওর সোজা চিকিৎসা হলো বিয়ে। বিয়ে দিয়ে দে,
ঝামেলা শেষ। শুনেছি বিয়ে দিলে জিনের সমস্যা থাকলে কমে যায়। তবে, এসব
শিলাদের বলার দরকার নেই। ওকে যা বলার আমিই বলব।”
‘হুম, সবই তো বুঝলাম আপা কিন্তু বয়সটা যে খানসার প্রায় ডাবল। খানসার ষোলো
আর ছেলের ত্রিশ। মিলবে দুটিতে। লিলির কণ্ঠে দ্বিধা।
‘কেনো মিলবে না! ছেলেদের জন্য ত্রিশ কোনো বয়স নাকি! তাছাড়া বাকি সব
যেখানে মনমতো মিলে যাচ্ছে সেখানে এতটুকু কমপ্রোমাইজ তো করতেই হবে রে
লিলি। তুই কালকেই খানসাকে নিয়ে আমার বাড়িতে আয়। এসে ছেলে দেখে, কথা।
বলে তারপর সিদ্ধান্ত নে। তোদের ভালো লাগলে ভালো, না লাগলে নাই।
জোরাজুরির তো কিছু নাই। তুই আসবি কিনা নিশ্চিত কর, তাহলে আমি শিলাকে
আসতে বলি!’
কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন লিলি। তারপর দ্রুত বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা, তুমি ওনাদের
আসতে বলে দাও।’
হাজার বলে কয়েও মেয়েকে একটু সাজগোজ করাতে পারলেন না লিলি। শাড়ি।
পাত্রের সামনে নিয়ে যান। পাটা ছাড়া বাকি সবকিছু তার পছন্দ
হয়েছে। বড় ধরনের ডিন অমত করার কোনো কারণ দেখেন।
না। অনেকের কম। সেরকম হলে তো ভালোই।
খানসাকে একটা পরিণত মনের মানুষের কাছে তুলে দিতে পারলে তিনি নিজে
ভারমুক্ত হবেন। তখন হয়তো নিজেকে নিয়ে ভাবার একটা সুযোগ পাবেন। খানসাই
তার একমাত্র বাধা যার কারণে ওর বাবার অনেক কিছু জেনেও তাকে নীরব থাকতে
হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই তিনি তার এক প্রবাসী বান্ধবীর স্বামীর মুখেই শুনেছেন
আব্দুল্লাহর বান্ধবী নিয়ে ঘোরার কথা। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই আব্দুল্লাহ
রেগে যান। হয়তো এ কারণেই লিলিকে তার কাছে নেবার ব্যাপারে তার উৎসাহ
কম, কে জানে। সবসময় কাগজের বাহানা দেখায়। আল্লাহই জানেন, সত্য কোনোটা!
খানসাকে বরাবরের মতোই সাধারণ পোশাকে তৈরি হতে দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন
লিলি। মেয়েকে বললেন, ‘এটা কেনো পরেছিস? একটু ভালো পোশাক পড়তে
পারলি না??
‘কেনো? এটা খারাপ কী?’ বলে নিজেকে আরেকদফা দেখল খানসা। একটা হালকা
গোলাপী রঙের সুতির থ্রি-পিস পরেছে সে আজ। বড় খালামণির বাসায় সাজুগুজু
করে যাবার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না বলেই পরেছে। এর আগেও
যতবার বড় খালামণির বাসায় গেছে নরমাল পোশাকেই গেছে। কখনও তো আম্মু
পোশাক বাছাই করে দেননি তবে আজ ব্যতিক্রম কেনো করবে!
ফুল লেন্থের আয়নায় গা মুচড়ে নিজেকে দেখে নিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো। “ঠিকই তো
আছে! তুমি হঠাৎ ভালো পোশাক পরাতে চাচ্ছো কেনো??
খানসার মনের কথা টের পেয়েই লিলি বলে উঠলেন, ‘তোর বড় খালামণির ওখানে
কিছু গেস্ট আসার কথা আছে। ওদের সাথে এটা আমাদের প্রথম মিটিং। তোকে
এরকম সাধারণ পোশাকে দেখলে ওরা কী ভাববে বল তো? জানিস তো, ফার্স্ট
ইমপ্রেশন ইজ দা লাস্ট ইমপ্রেশন!’
‘আমি সেখানে ইমপ্রেশন জমাতে যাচ্ছি কে বলল?’ খানসা ওর সিল্কি চুলগুলোকে
আঁচড়ে পেঁচিয়ে নিয়ে পেছনে একটা পাঞ্চ ক্লিপ আটকে দিলো।
লিলি আর কথা বাড়ালেন না। ভালো করেই জানেন কথা বাড়লে তার শেষটা
ঝগড়ায় গিয়ে থামবে আর সবসময়ের মতো খানসা জামাকাপড় খুলে ফেলে বলবে,
যাব না, যাও! যে জেদি মেয়ে! তারচেয়ে থাক। যেভাবে আছে সেভাবেই চলুক।
লিলি মেয়েকে নিয়ে বড় বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোলেন।
লিলির বড় বোন মিলি একজন সাধারণ গৃহিনী হলেও বেশ চৌকস মহিলা। তিনি
শিলাকে আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন যে মেয়েটার বয়স কম আর একটু চঞ্চলমতি।
এটিও বলে দিয়েছিলেন যে তাকে পাত্র দেখার ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। কাজেই
ওকে অফিসিয়ালি কনে দেখার মতো করে দেখা চলবে না। সাধারণভাবে গল্পচ্ছলে
দেখতে হবে। মিলির ব্যাখ্যা শুনে বান্ধবী শিলা খুশি মনেই সম্মত হয়েছেন।