ভাঙছে গ্রামের পর গ্রাম, ঘরবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন মানুষজন
বাংলাদেশ জেলার বরিশাল নগরীর এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদীর অব্যাহত ভাঙন থেকে সদর উপজেলার চরকাউয়া এলাকার মানচিত্র রক্ষা করা যাচ্ছে না কোনমতেই ।
ইতোমধ্যে সাতআনি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এবং নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে প্রায় নয়আনি গ্রাম। পাশাপাশি চরকাউয়া এলাকা রক্ষায় দীর্ঘ বাঁধ দেওয়া হলে ও তাও এখন পড়েছে ভাঙনের হুমকিতে । এ অবস্থায় ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন এখানকার গ্রামবাসীরা ।
অভিযোগ আছে , নগরীর প্রান্তে রসুলপুর চর না কাটায় এবং প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বালু ফেলে চর বৃদ্ধির কারণে অপর প্রান্তে চরকাউয়া এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ।
সাতআনি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পর দিনাপুরপুলসহ বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেওয়া শাহিন হাওলাদারসহ একাধিক ব্যক্তি জানান , ওই গ্রামেরই তাদের বসতভিটা ছিল ।
কিন্তু কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর থেকে যে যেখানে পেরেছেন সেখানে জমি অথবা ঘর ভাড়া নিয়ে এখন ভাড়াটিয়া হয়ে থাকছেন। অথচ একসময় তাদের জমিতেই বহু দরিদ্র মানুষ বসবাস করতেন বলে জানান ।
এখন নদীভাঙনের ফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে তাদের। আগে নিজের জমিতে চাষ করে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালাতে কোন সমস্যা হতো না ।
কিন্তু নদীভাঙন তাদের সেই মধুর দিন গুলো কেড়ে নিয়ে এখন সংকটের মধ্যে ফেলেছে তাদের । না পারেন কাউকে কিছু বলতে , না পারেন সমস্যার সমাধান করতে তারা ।
এরপর ও তারা আশায় রয়েছেন , ওই সম্পত্তি আবার জেগে উঠবে, ফিরবে সেই সুদিন আবার । তবে তা তারা দেখে যেতে না পারলে ও তাদের সন্তানরা দেখবে বলে আশা করছেন তারা ।
ভাঙনকবলিত মানুষরা এজন্য নগরীর প্রান্তে রসুলপুর চরকে দায়ী করছেন । প্রতিনিয়ত বালু ফেলে রসুলপুর চর বাড়ানো হচ্ছে বলে এই ভাঙ্গন ।
আর ওই চরে জোয়ার – ভাটা বাধাগ্রস্ত হয়ে আঘাত হানছে চরকাউয়াসহ সাতআনি ও নয়আনি গ্রামে মধ্যে । এ কারণে এক যুগের বেশি সময় ধরে ভাঙন অব্যাহত থাকায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সাতআনি গ্রাম। নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে এখন নয়আনি গ্রাম ।
ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হাওলাদার বলেছেন , ‘চরকাউয়া সাতআনি এলাকায় আমার বাড়ি ছিল। নদীভাঙনে নয়আনি ১ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাস শুরু করেছি আমি পরিবার সহ । কিন্তু সেখানে ও ভাঙন শুরু হয়েগেছে । ভাঙন শুরু হলে জন প্রতিনিধি এসে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েতো যান।
কিন্তু যে সময়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন তার আগে নয়আনি গ্রামও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। কারণ সাতআনি গ্রাম ভাঙন কবলিত হওয়ার পর একইভাবে জন প্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছিলেন । কিন্তু ভাঙন প্রতিরোধ না করায় পুরো গ্রাম চলে গেছে এখন নদীগর্ভে ।’
সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ , সাতআনি ও নয়আনি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে , চরকাউয়া ঘাট এলাকায় বাঁধ রক্ষা করতে আবার পুনরায় ব্লক ফেলে চাপা দেওয়া হয়েছে। এখন ভাঙন শুরু হয়েছে নয়আনি এলাকায়।
তবে চরকাউয়া ঘাট এলাকায় বাঁধের কারণে ভাঙন কিছুটা কমেছে বলে জানিয়ে চরকাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি বলেন , ‘সাতআনি গ্রাম বিলীন হয়ে ভাঙন বেড়েছে নয়আনি গ্রামে পর্যন্ত । আগামী বর্ষা মৌসুম আসার আগে ব্যবস্থা না নিলে গ্রামটি মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে তার মন্তব্য ।’
চেয়ারম্যান আর ও বলেন, ‘একে তো এই অংশে নদী গভীর , তার ওপর আবার লঞ্চ, স্পিডবোট ও জাহাজ এই পথেই চলছে বেশি। অন্যদিকে রসুলপুরে চরের কারণে পানির স্রোত সরাসরি চর কাউয়ার নয়আনি ও সাতআনি অংশেই আঘাত করছে বলে জানান।
রসুলপুর চরের বড় একটি অংশ কেটে সোজা করে দেওয়া হলে ভাঙনরোধ করা যেতো পারে বলে তার ধারণা । এতে বড় নৌযান চলাচল করলে ও কোন সমস্যা হবে না।’
রসুলপুর চর সংলগ্ন এলাকায় নতুন করে কোনোভাবে চর জেগে উঠলেই সাথে সাথে প্রভাবশালীরা বাঁধ দিয়ে বালু ফেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভরাট করে ফেলেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি ।
তিনি বলেন , ‘এভাবে রসুলপুরকে বিশাল চরে রূপ দিয়েছেন প্রভাবশালীরা । আর যার প্রভাব পড়ছে কীর্তনখোলা নদীতে। আর এ কারণে অপর তীরের জনপদ প্রতিনিয়ত ভাঙছে ।
এই অবদি চরকাউয়া বাসস্ট্যান্ডসহ বিশাল সড়ক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে জানান । রসুলপুর চর কেটে দিলে এই পাড় এবং অপর প্রান্তের মানুষ ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে তার দাবি ।
এজন্য নদীর গতিপথ ফিরিয়ে দিতে রসুলপুর চরের বড় একটি অংশ ড্রেজিং করতে হবে বলে জানান । অন্যথায় বালু ফেলতে ফেলতে একসময় এই কীর্তনখোলা নদী খালে রূপ নেবে ।’
এ বিষয়ে নদী গবেষক রফিকুল আলম সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বরিশাল – ঢাকা নৌপথে চলাচলরত সামাদ লঞ্চ রসুলপুরের ওই অংশে ডুবে যায় ।
আর সেই থেকে চর পড়া শুরু হয়। আর চর জাগামাত্রই তা দখলের প্রতিযোগিতায় চলে প্রভাবশালীদের । এখন প্রয়োজন ওই চর গভীরভাবে কেটে দিয়ে নদীর গতিপথ ঠিক রাখা উচিত ।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট দফতর সেই চেষ্টা করছেন না । নদীর গতিপথে হাইড্রলিক্স ফোর্স পয়েন্ট থাকে হয় । এই ফোর্স এই মুহূর্তে চরকাউয়া অংশে আঘাত করছে বলে তার মন্তব্য ।
এটা ঠেকাতে হলে রসুলপুর এলাকায় নতুন করে জেগে ওঠা চরকে গভীরভাবে কেটে দিয়ে জলযান চলাচল উপযোগী করা গেলে হয়তোবা অনেকটাই ভাঙনরোধ করা সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল থেকে -৫ আসনের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল অব জাহিদ ফারুক শামীম আমাদেরকে বলেন , ‘চরকাউয়া ইউনিয়নের ঘাট এলাকা থেকে উভয় পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার করে ছয় কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ তৈরি করা হয়েছে পর্যন্ত ।
খুব শিগগিরই ওই এলাকার ভাঙনরোধে কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে । ভাঙনকবলিত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েগেছে ।
চরকাউয়া এলাকার সাতআনি এবং নয়আনিতে টেকসই মজবুত বাঁধ নির্মাণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । রসুলপুর অংশে চর কাটার বিষয়টি নিয়ে নদী সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে বলে তিনি জানান । সম্ভব হলে চর কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা ও করা হবে অবশ্যই ।’