মদ,জুয়া, ও সুদ ছিল পাপের উৎস।
মদ ছিল অত্যাচার, ব্যভিচার, ঝগড়া, কলহ তথা সবরকম পাপের উৎস। আরবে মদের প্রচলন চিল সবচেয়ে বেশী। ঘরে ঘরে মদের আড্ডা বসত।
গায়িকারা নাচ ও গান-বাজনা করতে থাকত। জুয়া খেলা আরম্ভ হলে ঘড়া ভরে ভরে রক্ত রঙিন শুরা পান করত। মাতাল অবস্থায় নির্লজ্জতা এবং নিষ্ঠুরতার বহু অধ্যায় রচিত হত। সঙ্গে উটের লটারি খেলাও চলত।
খেলায় জয়ী হলে সাথে সাথে উট যবেহ করে তার গোশত দ্বারা কাবাব তৈরী করে উপস্থিত লোকদের খেতে দেয়া হত।
অনেক সময় মালিক মাতাল হয়ে আস্তাবলে ঢুকে উটগুলো কেটে টুকরা টুকরা করে তাই দিয়ে কিমা, কাবাব, বিরিয়ানী তৈরী করে নিজে খেত এবং অন্যকে খাওয়াত।
মদ্যপান ছিল অতি গৌরবের বিষয়। কবিরা নিজের কবিতায় রং বেরঙের মদ পানের কথা উল্লেখ করে কাব্য রচনা করত। ঘরে ঘরে মদের আড্ডা চলত।
নানা প্রকার মদ তৈরী করা হত। প্রত্যেক প্রকারের নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
মজদুদ্দীন ফিরোযাবাদী সে সময়ের ব্যবহৃত মদের আরবী নামসমূহ সংগ্রহ করে একখানা পুস্তক রচনা করেন। তাতে তিনি দু’শো পঞ্চাশ রকমের মদের নাম উল্লেখ করেছেন।
ইসলামে মদ নিষিদ্ধ হবার আগে অনেকেই মদ পান করত। হযরত মু’আয ইবনে জবলও তাদের মধ্যে একজন। তাঁরা যখন শরাবের নেশায় বিভোর ছিল তখন শুনতে পেলেন যে,
রাসূলুল্লাহ (স) শরাব নিষিদ্ধ করেছেন। এ সংবাদ কানে পৌঁছা মাত্রই তাঁরা শরাবের পেয়ালা এবং সুরাহী ভেঙ্গে ফেললেন। শুধু আবু উবায়দার বাড়িতেই এ ঘটনা ঘটেনি; বরং সারা মদীনা নগরীর রাস্তা ঘাটে সে দিন শরাবের স্রোত বয়ে যায়। সহীহ্ বুখারীতে আছে
رت في سكك المدينة –
(ফাজারাত ফী সাকাকিল মাদীনাতি) অর্থ : অনন্তর পবিত্র মদীনার গলিসমূহে শরাবের স্রোত প্রবাহিত হতে লাগল।
‘ এ ঘটনা হতে মদপানকারীর আধিক্য এবং রাসূলের প্রতি জনগণের অপরিসীম আনুগত্য পরিস্ফুট হয়েছে।
নীচতা
ভাল মন্দ বিচার না করে সবরকম অখাদ্যই তারা খেত। কীট, পতঙ্গ এবং নানা প্রকার সরীসৃপ প্রাণী তাদের সাধারণ খাদ্য ছিল।
তারা গোসাপ, কাঁকলাশ, গিরগিটি, টিকটিকি ইত্যাদি ঘূর্ণিত প্রাণীসমূহ খানারূপে গ্রহণ করত। জমাট বাধা রক্ত হালুয়ার মত খেত।
পশুর চামড়া পুড়িয়ে খেত। গাঁধা, শুকর এবং মৃত প্রাণীর মাংস এবং জীবিত প্রাণীর দেহ থেকে গোশত কেটে নিয়ে খেত গৃহপালিত এবং বন্য পশু, পাখী লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অথবা ঘাড় ভেঙ্গে অথবা গলা ছিঁড়ে খেত।
হিংস্র প্রাণী দ্বারা বধ করা প্রাণীও খেত ষাঁড়, পাঠা, মোরগ ইত্যদি প্রাণীদেরকে কাল্পনিক দেবতার নামে ছেড়ে দিত এবং এ প্রাণীকে খাওয়া হারাম মনে করত ।
আল্লাহ তা’আলা এসব অপবিত্র প্রাণীসমূহ খেতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে বলেছেন
حرمت عليكم الميتة والدم ولحم الخنزير وما أهل لغير الله به والمتخنقة والوقودة والمتردية البطيحة وما أكل الشبع إلا ما كنتم وما ذبح على
(হুররিমাত ‘আলাইকুমুল মাইতাতু ওয়াদ্দামু ওয়া লাহমুল খিযীরি ওয়ামা উহিল্লা লি গাইরিল্লা-হি বিহী ওয়ার মুখা-নিকাতু ওয়াল মাওযাতু ওয়াল মুতা রাদ্দিয়াতুন নাতীহাতু ওয়ামা আকালাস সাব্উ ইল্লা-মা যাক্কাইতুম ওয়ামা-যবিহা আলানুছুবি।)
অর্থ ঃ তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস, আর যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত হয়, যা কণ্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়,
যা উচ্চস্থান থেকে পতনের ফলে মারা যায়, যা শিংয়ের আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে, কিন্তু যা তোমরা জবেহ্ করেছ তা নয়।
আর যে জন্তুকে কোন বেদীতে যবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্যনির্ধারক শর দ্বারা বণ্টন করা হয় এসব গুনাহ্ কাজ। (সূরা মায়িদা-৩)
শরাবপানের মত আরবের ঘরে ঘরে জুয়া খেলা নিয়ে আড্ডা জমে থাকত। ধন, সম্পদ বলতে উটই ছিল ‘আরবের প্রধান সম্বল। এজন্য উট দিয়েই তারা জুয়া খেলত।
জুয়া
উট দিয়ে জুয়া খেলার একটি নিয়ম ছিল যে, একটি উট যবেহ করে তার গোশত দশভাগে ভাগ করা হত।
তারপর তারা একটি থলির মধ্যে দশটি তীর রেখে কোন একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতে অর্পণ করত।
প্রত্যেকটি তীরের সুনির্দিষ্ট নাম ছিল। কোন তীরের উপর একভাগ, আবার কোনটির উপর দুই বা তিন ভাগ লেখা থাকত।
তিনটি তীর এমনও ছিল যে, এদের উপর কোন লেখা থাকত না। তারপর যার হাতে থলিটি দেয়া হত সে তীরগুলো উলট পালট করে প্রত্যেক জুয়াড়ীর নামে এক একটি তীর বের করত।
যার নামে যত ভাগ হত সে তত ভাগ গোশতের মালিক হত। আর যার নামে অংশহীন তীর বের হত সে খেলায় পরাজিত হয়ে শূন্য হাতে বাড়ী ফিরত।
জুয়ালদ্ধ গোশত তারা গরীব, দুঃখী এবং বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে ভাগ করে দেয়া গৌরবের বিষয় বলে মনে করত।
সুতরাং যারা জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ না করত তারা সমাজে ঘৃণিত ও তিরস্কৃত হত; এমনকি তাদেরকে তুচ্ছ কৃপণ (2) বলে আখ্যা দেয়া হত। এমন লোকদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করা অপমানজনক বলে মনে করা হত ।
এছাড়াও জুয়া খেলার আরও নানা রকম নিয়ম প্রচলিত ছিল। এসব খেলায় তারা এমন মেতে থাকত যে, জুয়ায় পরাজিত হয়ে সমস্ত ধন সম্পত্তি বিনিষ্ট করার পর স্বীয় স্ত্রী-কন্যার উপর বাজি ধরে জুয়া খেলত এবং পরাজিত হলে স্ত্রী-কন্যাকে প্রতিপক্ষের হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য হত। সুতরাং শরাব ও জুয়ার আড্ডায় এসব বিষয় নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের সূত্রপাত হত।
আবস্ ও যুবয়ানের ইতিহাস বিখ্যাত চল্লিশ বছর স্থায়ী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ও ঘোড়দৌড়ের জুয়াখেলাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল।
সুদ
আরবদেশে সুদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সব অর্থশালী ব্যক্তিই সুদের কারবার করত। রাসূলুল্লাহ (স)-এর চাচা হযরত *আব্বাস (রা) ব্যবসা করে অনেক সম্পদ করেছিল। তারও সুদের ব্যবসা ছিল।
বিদায় হজ্জের দিন যখন রাসূলুল্লাহ (স) সুদ হারাম বলে ঘোষণা দেন, সেদিন সবার আগে তিনিই সুদ বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তায়িফের প্রসিদ্ধ সরদার মাস উদ উকফী এবং তাঁর ভাই ‘আবদ ইয়ালীলের সুদের ব্যবসা ছিল।
তায়েফ বিজয়ের পরে যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করেন তখন মুগীরা বংশীয় লোকদেরকে সুন্দরে টাকার জন্য তাগদা করতে লাগল। তখনই অবতীর্ণ হয়
بايها الذين امنوا اتقوا الله وذروا ما بقى من الربوا إن كنتم مؤمنين –
(ইয়া-আইয়্যুহাল্লাযীনা আ-মানুত্তাকুল্লা-হা ওয়া যাক মা-বাকিয়া মিনার রিবা ইনকুনতুম মু’মিনীন।)
অর্থ : হে মুসলমানরা ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর তোমরা (সত্যই) যদি মুসলমান হয়ে থাক তবে সুদের অবশিষ্টাংশ বর্জন কর। (সূরা বাকারাহ-২৭৮)
সুদ গ্রহণের সাধারণ নিয়ম এমন ছিল যে, নির্দিষ্ট হারে সুদ উল্লেখ করে টাকা ফেরৎ দেয়ার মেয়াদ ঠিক করে দেয়া হত ।
সে সময়ের মধ্যে টাকা শোধ করতে না পরলে, সময় বাড়িয়ে দেয়া হত যে, যা চক্রবৃদ্ধি সুদ অপেক্ষাও বহুগুণে ক্ষতিকর ছিল। সময়ের মধ্যে টাকা আদায় করতে না পারলে, সময় বাড়িয়ে আসল টাকার মানও বাড়িয়ে নেয়া হত।
এভাবে খুব কম সময়ের মধ্যেই অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে মহাজন খাতকের সব সম্পত্তির অধিকারী হয়ে পড়ত। এ ব্যাপারে ইহুদীরাই অধিকতর মহাজনী ব্যবসা করত। সুতরাং সারাদেশের গরীব কাঙ্গাল এবং কৃষকরা ইহুদী এবং অন্যান্য পুঁজিপতিদের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তখন এ ধরনের সুদ সম্পর্কেই নাযিল হয় :
بايها الذين امنوا لاتأكلوا الربوا أضعافا مضاعفة ص واتقوا الله لعلكم (Ir. : 814, Ji) – 31
(ইয়া-আইয়্যুহাল্লাযীনা আ-মানু লা তাকুলুররি বা আদ ‘আফাম্মুদা আফাতা, ওয়াত্তাকুল্লা-হা লা ‘আল্লাকুম তুফলিহুনা) অর্থ ঃ হে মুসলমানরা ! দ্বিগুণ, চুতগুণ সুদ খেয়ো না; আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় তোমরা কৃতকার্য হবে ।
সম্পুর্ন পরার জন্য ধন্যবাদ।
এমন আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইট এ নজর রাখুন।
আসসালামু আলাইকুম।