সন্ধানীরা মনে করে শিশুরা তাদের উদার আদর্শ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে, তারা তাদের সেই আদর্শ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। একটি শিশুর মৌলিক চাহিদা হল মায়া-মমতা, আদর-যত্ন এবং প্রেম-ভালোবাসা। এটাই সন্ধানীদের মৌলিক আদর্শ।
শিশুরা ভুল শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার জন্য এসব আদর্শ ভুলে গিয়ে, স্বার্থপরতা-আত্নকেন্দ্রিকতা আর সাম্প্রদায়িকতার জটিলতায় একটা বিকৃত আদর্শের ধারক হয়ে উঠে তারা। তাদের অবচেতন মনে স্থান করে নেয় মৌলিক আদর্শগুলি। সেই কারণে মানুষ সব সময় স্বপ্ন দেখে আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আর আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার। আসলে এটা তাদের চেতন মনে অবচেতন মনের প্রতিফলন।
সন্ধানীরা মনে করে স্বপ্ন মানুষের জীবনের চালিকা শক্তি। তাই এই সুন্দর ধরনীতে মানুষকে সব সময় সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখাতে হবে। তারা মনে করে মানুষ যখন নিজ মানবিক গুণাবলী সৌন্দর্য উপভোগ করে, তখনই সে প্রকৃত সুখ উপভোগ করে এবং নিজকে সুখী ভাবে।
তারা মনে করে যেদিন ধরনীতে তাদের দর্শনের বিজয় হবে, সেদিন ধরনীতে স্বর্গীয় সুখ ধরা দিবে। তাদের মতো সৃষ্টিকর্তার কোন আকার নেই। তিনি নিরাকার, কাজেই কোন অবস্থাতেই তাকে দর্শন করা সম্ভব নয়, তবে নিরাকার মন দিয়ে তাকে অনুভব করা সম্ভব৷ আর মন দিয়ে সৃষ্টি কর্তাকে অনুভব করাই সৃষ্টি কর্তার সান্নিধ্য লাভ করা। সন্ধানীরা মনে করে ধর্মের নামে, রাষ্ট্রের নামে মানুষকে অত্যাচার করা, হত্যা করা পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ।
যা সৃষ্টিকর্তার কাছেও ঘৃন্যতম কাজ হিসাবে বিবেচিত। তারা মনে করে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচারণকারীরা এ কাজ করে নিজ স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে। এরা সৃষ্টি কর্তার প্রেমের মর্ম বুঝতে ব্যর্থ হয়ে তার মুখে কালিমা দিতে ব্যস্ত। সৃষ্টি কর্তা সর্বান্তকরণে এদের ঘৃণা করে।
তাই সন্ধানীদের শ্লোগান হল ‘আগে মানুষকে ভালবাস, তারপর ধর্মের কথা, রাষ্ট্রের কথা ভাব। ‘ তারা মনে করে যারা মানুষকে ভালোবাসতে জানে না, তারা স্রষ্টাকে ভালো বাসতে জানে না। তারা মনে করে প্রেমই জীবনের উৎস, প্রেমই আনন্দ-সুখের উৎস। প্রেমই জীবন এবং প্রেমই ধর্ম৷ প্রেম চিরন্তন এবং অবিনশ্বর। জগতের সকল কাজ মানবতার উপর ভিত্তি করে প্রেমের উপর ভিত্তি করে করা উচিত।
লোভ-ভয় বশবর্তী হয়ে কোন কাজ করা উচিত নয়, এমনকি কোন ইবাদাত করাও উচিত নয়। তারা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করতে চায়, প্রাচীর গড়তে নয়। তারা জাঁকজমক পূর্ণ ধর্মশালা বা উপাসনালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে কারণ সৃষ্টিকর্তা খুব সাধারণ জীবন পছন্দ করেন। কাজেই সব সাধারণ বস্তু তার প্রিয়। যুগে যুগে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করে।
একইসময় পার্শ্বেই গড়ে উঠেছে জাঁকজমকপূর্ণ উপাসনালয়। ইতিহাসের কোন কোন সময় দেখা যায় দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন গেছে আর সেই সময় শাসকশ্রেণী-ধনীশ্রেণী জাঁকজমকপূর্ণ উপাসনালয় নির্মান করেছে। যা তারা করেছে নিতান্তই নিজেদের বাহাদুরি এবং ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য।
যা প্রচলিত ধর্মানুসারে মূল মর্মবাণীর ঠিক বিপরীত কাজ ছিল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেমের অভাবেই তারা এ কাজ করেছে।
সৃষ্টিকর্তার কাছে তার সৃষ্টি মানুষ বড় আদরের কোন উপাসানালয় নয়। তাই সন্ধানীরা মনে করে যারা মানুষকে আহার থেকে বঞ্চিত করে জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় উপাসানালয় নির্মাণে ব্যস্ত থাকে, তারা সে কাজ করে সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেমের অভাবে। তারা সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত ধর্মের মুখে কালিমা লেপন করে আর অপমান করে সৃষ্টিকর্তাকে। তাই সন্ধানীরা মনে করে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি মানব সেবা হল সবচেয়ে বড় এবাদত এর চেয়ে বড় কোন এবাদত নেই।
আর সেই এবাদতও হতে হবে জাগতিক এবং পরজাগতিক লোভ ত্যাগ করে। অর্থাৎ জাগতিক এবং পরজাগতিক সকল লোভের উর্ধ্বে থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রেমের টানে করতে হবে মানবসেবা-আর্তসেবা এবং পীড়িতের সেবা। তবেই সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের পথ সহজ হবে। নর-নারীর প্রেম যেমন রূপের লালসায় হওয়া উচিত নয়। তেমনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের প্রেম তার অসীম ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সৃষ্টিকর্তার কাম্য নয়। সৃষ্টিকর্তার মহিমার জন্য, তাকে মানুষের ভালোবাসা উচিত। নর-নারীর প্রেম যেমন নির্লোভ হবে সেটাই সৃষ্টিকর্তার কাম্য।
সন্ধানীরা সর্বান্তকরণ বিশ্বাস করে পৃথিবীর সকল ধর্মের মর্মবাণী এক এবং অভিন্ন। মৌলিক বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই বা প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা কিছু মূলত প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিকতায়। সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান, তিনি পরম করুণাময় এসব মৌলিক প্রশ্নে সকল ধর্মের অবস্থানই এক। তাই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে অযথা হিংসা বিদ্বেষ, বিবাদ-বিসম্বাদ ও সংঘাতের কোন অর্থ হয় না।
ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের অপূর্ণ বা খন্ডিত জ্ঞানই এসব মানবতা বিরোধী তৎপরতা জন্য দায়ী। ধর্মের মূল মর্মবাণী থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসের শ্রেষ্টত্বর কল্পিত অহংকার থেকে জন্ম নেয় মানুষে মানুষে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতার। ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের অপূর্ণ জ্ঞান এবং সংকীর্ণ ও অনুদার মানসিকতা জন্য ধর্মে ধর্মে এমনকি একই ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন গোত্র-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হানাহানিতে এই পৃথিবীর মাটি আজ রক্তস্নাত, মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত, শান্তি বিঘ্নিত।
পৃথিবীর সকল ধর্মেই সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত। এই জ্ঞানে যদি মানুষ ধর্মসমূহের মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে এবং মনুষ্যত্বই মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার মনে করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যার যার মত ধর্মাচরণ করে, তাহলেই এই অশান্ত বিশ্ব সত্যিকার অর্থে হতে পারে শান্তিময়-প্রেমময় ও জ্যোতিময়।
মানুষের কল্যাণের প্রয়োজনে ধর্মের উৎপত্তি। তাই সন্ধানীরা কামনা করে পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক ধর্মের কল্যাণে। ধর্মের পরশে উদ্ভাসিত হোক মানবতা। সত্য-সুন্দরের আলোতে এবং শান্তি ও কল্যাণের সুবাতাসে অভিসিক্ত হোক তাপিত বসুন্ধরা।
মনোতাত্ত্বিকরা দেশকে কিছু সংখ্যক শাসক-শোষক শ্রেণীর কৃত্রিম সৃষ্টি বিষয়বস্তু বলে মনে করে। যেহেতু তারা বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্বিতীয়, তিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান কাজেই তার দ্বারা বহু রাষ্ট্র সৃষ্টির কোন অবকাশ নাই। কিছু সংখ্যক শাসক এবং শোষক নিজস্বার্থে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, বিবাদ-বিসম্বাদ ও সংঘাত-সংঘর্ষের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের উৎপত্তি করে। রাষ্ট্রের পরিধি এবং সংখ্যা সর্বদাই শাসক-শোষক শ্রেণীর স্বার্থের উপর নির্ভরশীল। সৃষ্টির প্রথম যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না।
যখনই ধন সম্পদের উপর মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল, তখনই রাষ্ট্রতত্ত্বের আর্বিভাব হল আর উৎপত্তি হল বিভিন্ন রাষ্ট্রের। শাসক এবং শোষকের স্বার্থে নিজ রাষ্ট্রের শ্রেষ্টত্বের কল্পিত অহংকার থেকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতার। আর শুরু হয় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ এবং হানাহানি। যার ফলে পৃথিবীর মাটি হয় রক্তস্নাত, মানুষ্যত্ব বিপর্যস্ত এবং শান্তি বিঘ্নিত হয়।
শাসন শোষকশ্রেণী অত্যন্ত সচতুর এবং সুক্ষ্ণভাবে মানুষের চেতন এবং অবচেতন মনে ঢুকিয়ে দেয় রাষ্ট্রতত্ত্বের বিষবাষ্প। ফলে জ্ঞান এবং অজ্ঞানসারে মানুষ হয়ে পড়ে রাষ্ট্রতত্ত্বের বিষবাষ্পের কাছে বন্দী। মানুষ্যত্বই মানুষের শ্রেষ্ঠ অহংকার এই চিরন্তন সত্য কথাটি ভুলে গিয়ে মানবতা মানবিকতার পরিবর্তে গড়ে তুলে মিথ্যা জাতীয়তাবাদ আর অশান্ত হয় বিশ্ব।
তাই সন্ধানীরা মনে করে বিভিন্ন রাষ্ট্র সৃষ্টির এই ঘৃন্য উদ্দশ্যাবলী যদি মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়, তাদেরকে সচেতন করা যায়, তাহলে বিশ্ব সত্যিকার অর্থে হতে পারে শান্তিময়, প্রেমময় এবং জোর্ত্যিময়। উগ্রজাতীয়তাবাদ শাসন-শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে পৃথিবীর সাধারণ মানুষের নয়।
মানুষের জন্ম হয় বিশেষ কতগুলো অঙ্গ নিয়ে যা চাক্ষুষ দৃষ্টিতে দৃশ্যমান। এসব অঙ্গ দিয়ে মানুষ তার প্রাত্যহিক কাজ করে থাকে। এসব দৃশ্যমান অঙ্গ ছাড়াও মানুষের দেহ অদৃশ্যমান একটি অঙ্গ দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রত ও পরিচালিত হয়। এই দৃশ্যমান বস্তুটির অস্তিত্ব মানবদেহের সর্বত্র বিদ্যমান। মানুষ এই বস্তুটিকে দেখতে পায় না, ধরতেও পারে না কিন্তু তার পরেও তার অস্তিত্ব সদা সর্বত্র বিদ্যমান। মানবদেহে কোনো স্থান দখল না করলেও মানুষ দেহের মস্তিষ্ক এবং চিত্তের সাথে গভীর সম্পর্ক। দেহের সর্বত্র থেকেও সে অদৃশ্যমান।
আর এই অদৃশ্যমান বস্তুটি দিয়ে মানুষ সর্বদা খোঁজ করে আরেকটি অদৃশ্যমান বস্তুকে যিনি মানুষের দেহের এই অদৃশ্যমান বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। এভাবে সৃষ্টি খুঁজছে তার স্রষ্টাকে, এখানে দুজনই অদৃশ্যমান। মানব দেহের এই অদ্ভুত অদৃশ্যমান বস্তুটি হলো মন। এখানে মন হলো সৃষ্টি। মন সর্বদা খুঁজে বেড়ায় তার মনের মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে।
এখানে মনের মানুষ হলো তার প্রভু। মন সর্বদাই তার মনের মানুষের সান্নিধ্য লাভে ব্যাকুল থাকে। তার এই সাক্ষাৎ লাভের একমাত্র মাধ্যমে হলো প্রেম।
সৃষ্টি তার স্রষ্টার সাক্ষাৎ লাভ করে তার প্রতি গভীর প্রেমের মাধ্যমে। সে সর্বদা মানবের মনোজগতে বিদ্যমান। তার সাথে মানবের গভীর মনের সম্পর্ক আর মনের প্রেমের মাধ্যমে তার পূর্ণ অভিব্যক্তি। মানবসেবার মধ্য দিয়ে তাঁর সেবা ও ইবাদত করা হয়। সে অদৃশ্যমান হলেও সর্বদা মানবের মধ্যে বিদ্যমান।
মন হলো ইন্দ্রয়দের রাজা। মন বাসনা ও লোমমুক্ত হলে চিত্তে প্রেমের অঙ্গুর জন্মে। মনের প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো ভাব। আর ভাব থেকে ভাষার জন্ম। সেই ভাবে ভালোবাসায় এবং প্রেমে মানুষের মন উন্মাদ। মন হৃদয়কে আশ্রয় করে তার মহিমা প্রদর্শন করে। হৃদয় যেখানে অন্তরের মণিমধু সেখানে বিদ্যমান। মনের কোন ধর্ম, বর্ণ এবং জাত ভেদাভেদ নেই।