মাছের মুখে আংটি পর্ব ১

মাছের মুখে আংটি পর্ব ১

ইংল্যান্ডের উত্তরে ইয়র্কশায়ার নামে এক জায়গা আছে। সেখানে বাস করত এক
জমিদার। চমৎকার এক প্রাসাদ ছিল তার। পথ দিয়ে যে যেত সে-ই অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকত সেটার দিকে। আর ভাবত – আহা, এত সুন্দর বাড়ি।
জমিদারের ছিল অনেক টাকা-পয়সা আর ছিল কিছু ভালো বন্ধু। জমিদার
সারাদিন জমিদারির কাজ করত আর ঘুরে বেড়াত প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে।
টাকা-পয়সার হিসাব করতে করতেই তার দিন কেটে যেত।

image
কিন্তু প্রতি রাতে লোকটি জেগে জেগে বই পড়ত। নানা ধরনের বিচিত্র সব বই।
বই পড়ে পড়ে লোকটি অনেক জাদু শিখেছিল। শিখেছিল কী করে ভবিষ্যৎ গণনা
ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকাট বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ত। চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা
সব বই । কী সব আঁকজোক করত! অঙ্ক কষত। আর হিসাব করে জানার চেষ্টা করত
পৃথিবীর কোথায় কী ঘটেছে!

বছরের প্রথম দিনেই ধরা দিলেন তিনি, জালে উঠল ২০ কেজি ওজনের বিশাল কাতলা - 25  kg Giant Catla fish Met in the river in Bangladesh - Aaj Tak Bangla
তার ছিল একটিমাত্র ছেলে। বয়স মাত্র পাঁচ। জমিদার তার ছেলেটিকে
ভালোবাসত প্রাণের চেয়ে অধিক। জমিদারের ইচ্ছে— সব সম্পদ সে রেখে যাবে
ছেলেটির জন্য যেন ভবিষ্যতে কোনো কষ্ট না পায় সে। কারণ ছেলেটি মাতৃহীন
লোকটি স্বপ্ন দেখত— ছেলেটি একদিন বড় হবে। সুন্দর কোনো ধনীর দুলালীর সঙ্গে
তার বিয়ে হবে। যেন ছেলেটির বউ হবে কোনো রাজকন্যে। বিশাল রাজপ্রাসাদ
থাকবে তার । শাসন করবে সে বিশাল কোনো রাজ্য।

তাই জমিদার গণনা করে বের করার চেষ্টা করে— কেমন মেয়ের সঙ্গে তার
ছেলের বিয়ে হবে।
একদিন গভীর রাতে—
লোকটা আঁকজোক করতে করতে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল । বড় দুঃখজনক
ঘটনা ঘটবে তার ছেলের জীবনে। যখন তার ছেলে বড় হবে তখন তার কপালে
জুটবে এক গরিব ঘরের মেয়ে। শহরের সবচেয়ে দরিদ্র এক লোক— যে থাকে
পাতার ছাউনিতে, শহরের শেষ মাথায়— তার মেয়ে কিনা হবে পুত্রবধূ! গভীর দুঃখে
জমিদারের বুক ভেঙে এল । নতুন করে আবার গণনা শুরু করল সে। যদি গণনায়
কোনো ভুল হয়ে থাকে। না, বারবার গণনা করেও একই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।
রাতে আর ঘুম এল না লোকটির। হৃদয় তার ভেঙে গেছে। সকালে নাশতাও
খেল না । খুব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল । বাইরে ঝড়ো বাতাস। তার কোনো
ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রাসাদের বিশাল উঠোন পেরিয়ে আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া
নিয়ে লোকটা সোজা ছুটল শহরের শেষ মাথায়। পাতার ছাউনি-দেয়া
বাড়িটাকে খুঁজে পেল অনায়াসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক হতদরিদ্র
বুড়ো মানুষ। জমিদারকে দেখেই বুড়োটা থরথর করে কাঁপতে লাগল । কোনো
ভুলত্রুটি হয়েছে কি তার?
জমিদার ঘোড়া থেকে নামতে নামতে বললেন,
– তুমি খুব দরিদ্র । তোমার খোঁজখবর নিতে এলাম।

হাতজোড় করে বুড়ো তখন বলল,
হুজুর, কী আর বলব? বড় কষ্ট আমার জীবনে। আমার ঘরে সাতটি
ছেলেমেয়ে আছে। কয়েকদিন আগে আমার আরেকটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করেছে।
আমি জানি না, কীভাবে ওদের খাওয়া জোগাব। কোত্থেকে ওদের পোশাক-আশাক
কিনে দেব? কীভাবে ওরা বেড়ে উঠবে? আমরা খুবই গরিব মানুষ। আর এ বয়সে
কাজকর্মই-বা কী করব?
জমিদার মনে মনে ভাবলেন, তার গণনা নির্ভুল । এই সেই মেয়ে যার সাথে
একদিন তার ছেলের বিয়ে হবে। এ কোনোদিন হতেই পারে না। যে দুঃখ-কষ্টের
মধ্য দিয়ে গরিব ঘরের মেয়েটি বড় হবে, সে কোনোদিন তার ছেলের বউ হতে পারে
না । জমিদার তখন এক দুষ্টুবুদ্ধি আঁটলেন । হঠাৎ করেই তিনি দয়ালু ও উপকারী হয়ে
উঠলেন । মিষ্টি হাসিমুখে বুড়োলোকটিকে তিনি বললেন,
বছরের প্রথম দিনেই ধরা দিলেন তিনি, জালে উঠল ২০ কেজি ওজনের বিশাল কাতলা - 25  kg Giant Catla fish Met in the river in Bangladesh - Aaj Tak Bangla
তোমার কষ্টের জন্য আমি দুঃখিত। আমি অবশ্যি তোমার একটু উপকার
করতে পারি। তোমার শিশু-মেয়েটিকে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমার কাছেই
মেয়েটি বেড়ে উঠবে, বড় হবে।

বুড়ো এবং তার বউ শিশু-মেয়েটিকে হারাতে রাজি নয়। কিন্তু তারা ভাবল, এই
কষ্টের চেয়ে মেয়েটি সুখে থাকবে— সেটাই-বা কম কী! এই সুযোগ ছেড়ে লাভ
নেই। মায়ের মন বলে কথা। মা অঝোর ধারায় কাঁদল। শিশু-মেয়েটিকে তারা
জমিদারের কাছে দিয়ে দিল । জমিদার ঘোড়ায় চেপে যত দ্রুত পারলেন ছুটলেন । মা
তখনও কাঁদছে । বুড়োটা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে পথের দিকে।

লোকটি যেতে যেতে একটা চওড়া উপত্যকা পেরিয়ে একটা সরু চিলচিলে নদীর
ধারে এসে দাঁড়াল । মৃদুমন্দ বাতাস বইছে নদীর তীরে । গাছের পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ
শোনা যাচ্ছে। লোকটির মনে অনেক জ্বালা। গণনা করে আশ্চর্য এক সত্যি তিনি
আবিষ্কার করেছেন। তখন থেকে লোকটি বিচলিত। তার মন ভালো নেই। ঘোড়া
থেকে নেমে লোকটি নদীর জলে ফেলে দিল সেই শিশু-মেয়েটিকে।
– আমার একমাত্র ছেলের ভাগ্য যেন মেয়েটি খেতে না পারে। আমার ছেলের
সাথে কিনা বিয়ে হবে পাতার কুটিরের মেয়ের সাথে! আমার ছেলের জন্য প্রয়োজন
ভালো বউ। বড় ঘরের বউ।
ভারমুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। একটা দুশ্চিন্তার বেড়াজাল থেকে মুক্তি
পাওয়া গেছে। বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন জমিদার। তারপর ঘোড়ায় চড়ে একছুটে
এখন যেন
রওনা দিলেন প্রাসাদের দিকে।

ওদিকে অসহায় শিশুটির ভাগ্য বুঝি সহায় । যখন তাকে ছুড়ে ফেলা হল তখনই তার
পরনের ছোট্ট পোশাকটি বাতাসে উড়ে ফুলেফেঁপে উঠল । ঝপ করে নদীর জলে পড়ে
বেশ আরামেই ভাসতে লাগল সে। এমনকি শিশুটি ভেজা না ঠাণ্ডা সেটাও বুঝতে পারল
না । আরামে চোখ বন্ধ করে সে ঘুমাতে ঘুমাতে নদীর ধীরস্রোতে ভেসে ভেসে চলল ।
অবশ্য খুব বেশিদূর যেতে হল না শিশুটিকে । একটু দূরেই নদীর পাড়ে এক গরিব
মানুষের ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। প্রতিদিন সে মাছ ধরতে আসে নদীর পাড়ে। আজ
সকাল থেকে বেচারা বসে আছে। কিন্তু একটা মাছও এসে ধরা দিচ্ছে না তার ছিপে।
একেই বলে মন্দ কপাল । বসে বসে লোকটি ভাবছে— না, এভাবে হবে না। আজ
কোনো মাছই পাওয়া যাবে না। বরং বাসায় চলে যাওয়াই ভালো। এমন সময় সে
দেখল— কী যেন একটা ভেসে আসছে পানিতে।

কী ব্যাপার? এ-রকম অদ্ভুত কোনো মাছ তো আগে কখনও দেখি নি। এটা
কি মাছ না অন্য কিছু?
কাছে আসতেই লোকটি বুঝল, একটা শিশু। ছিপ দিয়ে লোকটা শিশুটিকে টেনে
আনল কাছে। ভেজা কাপড় ফেলে দিয়ে নিজের চাদরে জড়িয়ে নিল। তারপর
তাড়াতাড়ি ফিরে এল নিজের বাড়িতে। শিশুটিকে বাঁচাতে হবে। হয়তো এতক্ষণে
মেয়েটির ঠাণ্ডা লেগে থাকতে পারে।
কিন্তু না, মেয়েটির কিছুই হয় নি। জেলে আর তার বউয়ের আদরযত্নে কদিনের
মধ্যেই শক্তসমর্থ হয়ে উঠল সে। সেই কুঁড়েঘরে বড় হতে লাগল মেয়েটি। যেন সে
জেলের নিজের মেয়ে। হাসি-আনন্দে সবাইকে মাতিয়ে লকলক করে বেড়ে
উঠতে
লাগল । দেখতে যেমন সে সুন্দর, কাজেও তেমন পটু ।
বাবা-মা তার নাম রাখল মার্গারেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *