মাছ এর মুখে আংটি পর্ব ২
দেখতে দেখতে ষোলটি বছর কেটে গেল । জমিদার-পুত্রের বয়স এখন একুশ বছর
একমাত্র ছেলে সে। এক তাগড়া জোয়ান সে এখন। ঘুরে বেড়াতে দারুণ পছন
করে। বাবার সঙ্গে প্রাসাদে বসে সর্বদা সময় কাটায় না। কখনও কখনও বেরিয়ে পড়ে দেশভ্রমণে। দুরন্তপনায় তার জুড়ি নেই। সমুদ্রের ধারে তার এক চাচা থাকে।
চাচার ওখানে বেড়াতে সে ভারি পছন্দ করে। সমুদ্র আর চারপাশে পাহাড়। কী
বাবার ভয়— যদি ছেলে ভুল কোনো মেয়েকে ভালোবেসে ফেলে তবে তার
মেয়ের সঙ্গে। জমিদার ইতিমধ্যে আরও অনেক অদ্ভুত এবং আশ্চর্য সব বই পড়েছে।
দুঃখের শেষ থাকবে না। জমিদার ছেলের বিয়ে দেবে আরেক বড় কোনো জমিদারের
ভাগ্য গণনার আরও পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আগের চেয়ে আরও অনেক তথ্য,
অনেক জাদু সে শিখেছে। কিন্তু তাই বলে ছেলে কোথায় ঘুরতে যায়, কেমন করে
দিন কাটায়— এসব তো আর জানার উপায় নেই। বাবার মনে ভয় তাই যায় না।
একদিন জমিদার তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কাজে যাচ্ছিল সেই ছোট্ট নদীর
পাড়ে। হঠাৎ করেই পথ হারিয়ে ফেলল তারা ক্ষণিকের জন্য। সেদিন ছিল খুবই
গরম। মাথার উপরে লাল সূর্য। কোথাও এতটুকু খাবার নেই । এলোমেলো ঘুরতে
ঘুরতে তারা হাজির হল গরিব জেলের ছোট্ট কুটিরের সামনে।
তারা দেখল— ঘরের সামনে একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে শাকসবজি কাটাকুটি
করছে। এই মেয়েটিই সেই মার্গারেট । বাবার জন্য খাবার তৈরি করছে।
তারা ঘোড়া থামাল । জমিদার মেয়েটিকে বলল,
আমরা খুবই ক্লান্ত। পানির পিপাসা পেয়েছে বড্ড। একটু পানি খাওয়ানো
যায়? মার্গারেটও বড় হয়েছে। এখন সে এক অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। চোখ তার
সমুদ্রের জলের মতো নীল । মাথা ভরা সোনালি চুল । সে বিনয়ের সঙ্গে উঠে দাঁড়াল ।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল বাবা-মা। মার্গারেট বসতে দিল জমিদারদের । তারপর পানি
পান করাল অতি ভদ্রভাবে। জমিদার আর তার সঙ্গীরা একটুক্ষণ বিশ্রাম করতে
বসল । নিজেদের মধ্যে তারা গল্পগুজব করছে। পানি পানের পরে ক্লান্তি কিছুটা
কেটেছে তাদের।
কী সুন্দর এই মেয়েটি!
–
জমিদারের এক বন্ধু বলল ।
–
–
কোন্ ছেলের কপালে আছে এত সুন্দর, এত ভালো একটি বউ কে জানে!
মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে জমিদারের সেই বন্ধু বলল,
– কারও কাছে তুমি কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? তোমার কি বিয়ে হয়েছে?
–
মার্গারেট লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নামিয়ে রইল ।
না। আমরা খুবই গরিব মানুষ। আমি বাবা-মাকে কাজেকর্মে সাহায্য করি।
বিয়ে করা নিয়ে আমাদের ভাবনার সময় কোথায়? আর আমার মতো এক গরিব
মেয়েকে কেই-বা বিয়ে করবে?
আহা, আমার যদি কোনো ছেলে থাকত আমি নিশ্চয়ই তোমাকে তার বউ
করতাম।
বলল একজন ।
– তোমার চেয়ে সুন্দর ও ভালো বউ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, বুঝলে মেয়ে!
জমিদারের আরেক বন্ধু জানাল ।একজন সঙ্গী আবার জমিদারের দিকেই তাকিয়ে বলল,
–
– তুমি তো খুব জ্ঞানী লোক। রহস্য আর অলৌকিক জাদুবিদ্যা পড়ে পড়ে তুমি
তো আবার ভাগ্য গণনা করা শিখেছ । বলতে পার, এই মিষ্টি মেয়েটির ভাগ্যে কেমন
স্বামী হবে?
হঠাৎ করেই জমিদার যেন ভয় পেয়ে গেল । রাগ করেই বলল সে,
– আমি কিন্তু রাস্তাঘাটের জ্যোতিষী নই। আমি হাত দেখে বেড়াই না। ভাগ্য
গণনা করি না, বুঝলে?
কিন্তু অন্য বন্ধুরা চেপে ধরল জমিদারকে। সবার সামনে তাকে আজ গণনা
করতেই হবে। বলতেই হবে মেয়েটির ভবিষ্যৎ। জমিদার কী আর করবে? দু-এক
কথা বলে কাটিয়ে দেবার জন্য মোচড়ামুচড়ি করল । কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সে
উপায় নেই । তখন জমিদার মার্গারেটের হাতের তালুটা টেনে নিল কাছে। তারপর
জেলে-বউকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কবে তার মেয়ের জন্ম হয়েছে। গণনা করতে
গেলে প্রথমে এটা জানতেই হবে।
জেলে-বউ লাজুক গলায় বলল,
আমি কি সত্যি কথা বলব?
নিশ্চয়ই।
– মার্গারেট আমার পেটে-ধরা মেয়ে নয়। আমরা তাকে ষোল বছর আগে এই
–
দিনেই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।
–
তখন জেলে বলল,
–
– হ্যাঁ। আমিই ওকে পেয়েছিলাম। মাছ ধরতে গিয়েছিলাম নদীতে। মার্গারেট
ভেসে ভেসে আমার কাছে এসে ধরা দেয় । ওকে নিয়ে আসি বাড়িতে। তারপর থেকে
ও আমাদেরই মেয়ে।
কোন্ নদী?
প্রশ্ন করে জমিদার । গলা তার ভাঙা-ভাঙা। কারণ এক অনিশ্চিত দুশ্চিন্তায়
তার মন খারাপ হয়ে আসছে। চেহারার রঙ বদলে যাচ্ছে জমিদারের। জেলে নদীর
নাম বলল ৷
যেদিন তুমি ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলে সেদিন ওর বয়স কত ছিল? জমিদার
উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল ।
—
–
–
– দু-একদিনের বেশি হবে না। একেবারে সদ্যোজাত শিশু-সন্তান। উত্তর দিল
জেলে-বউ ।
জমিদার আর কিছুই বলল না। কারণ সে বুঝে গেছে— এই সেই বালিকা যার
সঙ্গে তার একমাত্র সন্তানের ভাগ্য বাঁধা পড়ে আছে। ষোল বছর আগে এই
মেয়েটিকেই সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল নদীতে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেয়েটি
আজও বেঁচে আছে! সুস্থ সবলভাবে সে বড় হয়ে উঠেছে।
জেলে-বউ ভেতরে গেল। সঙ্গে করে নিয়ে এল দামি একটা চাদর।
এই চাদরে জড়ানো ছিল মেয়েটি। মেয়েটি কোত্থেকে এসেছে তবে— বলে
একটু থামল জেলে-বউ। তারপর বলল, তবে চাদর দেখে মনে হয় মেয়েটির বাড়ি ইয়র্কশায়ারে। কারণ এই চাদর
নাকি ইয়র্কশায়ারেই পাওয়া যায়। হয়তো তার জন্ম হয়েছিল ওখানেই।
চাদরটা দেখেই জমিদার চিনে ফেলল। এই চাদর তারই ব্যবহার-করা। জমিদার
তখন ভয়ে-আতঙ্কে একেবারে শীতল হয়ে গেছেন। তার এক সঙ্গীকে বললেন,
শিগগির কিছু কাগজ আর কালি নিয়ে আস। একটু দূরে গিয়ে জমিদার তখন পালকের
কলম দিয়ে একটা চিঠি লিখল । আচ্ছামতো আঠা মেরে চিঠিটা মার্গারেটের হাতে দিল।
এই নাও তোমার ভাগ্য । মেয়ে, তোমাকে আমি পছন্দ করেছি খুব ৷ এই চিঠি
নিয়ে তুমি যাবে আমার ভাইয়ের কাছে সমুদ্রের ধারে। এবং সে তোমাকে
রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এই নাও টাকা। তোমার পথের খরচ । আশীর্বাদ করি তোমার
যাত্রাপথ যেন সুন্দর হয় । যেন তুমি সুস্থভাবে ফিরে আসো তোমার বাবা-মার কাছে।
তোমার ভাগ্য তোমাকেই গড়ে তুলতে হবে।
মার্গারেট আর তার বাবা-মা খুবই অবাক হল জমিদারের কর্মকাণ্ডে । জমিদার কী
বোঝাতে চাইল, কেন তার ভাইয়ের কাছে যেতে বলল, বুঝল না তারা। তবু ধন্যবাদ
দিল সবাইকে। জমিদার আর তার সঙ্গীরা তারপর ঘোড়ায় চড়ে ফিরে চলল
নিজেদের বাড়ির পথে।
–
পরদিন মার্গারেট প্রস্তুত হল । সে যাবে জমিদারের ভাইয়ের বাড়িতে। চিঠিটা খুব
যত্ন করে স্কার্টের ভেতরে রাখল। অফুরন্ত ধু-ধু রাস্তা পেরিয়ে মার্গারেট চলল ।
অনেক দূরের পথ। পথ যেন ফুরায় না। মাঝপথে নামল সন্ধ্যা।
মার্গারেট ভাবল কোনো সরাইখানায় রাতটা কাটানো দরকার । আবার সকালে যাত্রা
শুরু করতে হবে। কোনো এক গ্রামের ধারে সুন্দর, আরামদায়ক এক সরাইখানার
সন্ধান পেল মার্গারেট। কম পয়সায় ভালো খাবার খেয়ে নিল পেটপুরে । রাতে এখানেই
থাকবে সে।
সেই সরাইখানায় সে-রাত্রে দুইজন ডাকাত অবস্থান নিয়েছে। তারা ধনী
পথযাত্রীদের সন্ধান করে। যারা এই পথ দিয়ে যায় তাদের ধনসম্পদ কেড়ে নেয়
তারা। আজ ভালো শিকার পাওয়া যায় নি। তবে রাতের বেলা মার্গারেট ঘুমিয়ে
পড়লে তারা সুযোগ নিতে চাইল । মার্গারেটের ঘরে প্রথমে ঢুকল তারা । তারপর কিছু
চুরি করা যায় কি না খুঁজতে লাগল । খুঁজে চিঠিটা পেল। মার্গারেটের কাছ থেকে
নেয়ার মতো কিছু নেই।
ডাকাত দুজন চিঠিটা নিয়ে ফিরে এল নিজেদের ঘরে। মোমের আলোয় চিঠিটা
খুলে পড়তে লাগল তারা। সেই চিঠিতে লেখা আছে—
প্রিয় ভাই,
পত্রবাহককে চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দি করে মেরে ফেলবে। তা নইলে
এই মেয়ে আমাদের পরিবারের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
তোমার বড়ভাই ‘জন’ ।
চিঠিটা পড়ে ডাকাতদের মনেও দয়া হল। কী সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে! এ-রকম
পবিত্র একটি মেয়েকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র! এ অন্যায় মেনে নেয়া যায় না!
তারা চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। আরেকটি চিঠি লিখল । প্রথম চিঠিটার মতোই
আঠা মেরে ভাঁজ করে চিঠিটা রেখে দিল মার্গারেটের পকেটে।
সকালবেলা মার্গারেট ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে নিল। রাতে কী ঘটেছে সে-
সবের কিছুই জানে না সে। দুপুরের দিকে সে শহরে পৌঁছল। সমুদ্রের ধারে,
পাহাড়ের কিনারে মনোরম এক শহর। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমিদারের ভাইয়ের বাড়ি
সে খুঁজে পেল ।
সেদিন আবার জমিদারের একুশ বছর বয়সী ছেলেটা সেই বাড়িতেই ঘুরতে
গিয়েছে । বারান্দায় বসে বসে সে দেখছিল— উঠোন পেরিয়ে অপূর্ব এক সুন্দরী মেয়ে
বাড়ির দিকে আসছে। ছেলেটি উঠে গেল তার সামনে। জিজ্ঞেস করল— কে সে,
কী বিত্তান্ত তার । সে-ই মেয়েটিকে নিয়ে যাবে তার চাচার কাছে।
মার্গারেট ছেলেটির হাতেই তার চিঠিটা দিল । ছেলেটি ছিঁড়ে ফেলল চিঠির মোড়ক।
তারপর পড়তে লাগল—
প্রিয় ভাই,
–
৪৬
পত্রবাহক মেয়েটিকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সে খুবই মিষ্টি মেয়ে এবং তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে হবে।
তোমার প্রিয় ভাই ‘জন’ ।
চিঠিটা পেয়ে জমিদারের ভাই কিছুটা অবাক হল। কিন্তু সে জানে তার ভাইয়ের
অনেক পাগলামি আছে। বড়ভাইয়ের অনেক কার্যকলাপেই ভয় পেয়ে যায়
ছোটভাই । কারণ তার ক্ষমতাও আছে অনেক। সে জাদুও জানে । তাই ভাইয়ের কথা
অনুযায়ী ছোটভাই বিয়ের ব্যবস্থা করতে শুরু করল । জমিদারের ছেলে মার্গারেটকে
দেখে প্রথমেই মুগ্ধ। বিয়ের দিন-তারিখ এখনও ঠিক করা হয় নি। মার্গারেট আর
জমিদারের ছেলের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তারা সারাদিন সমুদ্রের ধারে,
পাহাড়ের কিনারে ঘুরে বেড়ায়। আর সারাদিন গল্প করে, আনন্দ করে । তাদের কথা
যেন ফুরায় না, হাসি যেন থামে না।
কদিন বাদে জমিদারের হাতে একটা চিঠি গেল ৷ ছোটভাই লিখে পাঠিয়েছে—
তোমার কথামতো বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। তোমার ছেলের সঙ্গে পত্রবাহক
সুন্দরী মেয়েটার বিয়ে । সকল আয়োজন সম্পন্ন। তোমার আশীর্বাদ কামনা করি।
চিঠি পড়ে জমিদারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল । নিশ্চয়ই মারাত্মক কোনো ভুল
হয়ে গেছে কোথাও। জমিদার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার বহর প্রস্তুত করল । এখনই তাকে
ছোটভাইয়ের কাছে যেতে হবে।
ছুটতে ছুটতে যখন সে এসে পৌছাল—
দেখতে পেল বিয়ের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। বাবুর্চিরা খানাপিনা প্রস্তুত
করছে। বিশাল হলরুমে গানবাজনার আসর বসেছে। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসে
উপস্থিত হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠানে।
জমিদার ঘোড়া থেকে নেমেই চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভেতর ঢুকল।কোথায় সেই মেয়ে যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আমার ছেলের?
মার্গারেট তখন বিয়ের শাদা পোশাকে পরীর মতো অপরূপ সুন্দর! বাবার সামনে
এসে দাঁড়াল । বাবা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন । কিন্তু প্রকাশ করলেন না মনের
ভাব। নিজেকে শান্ত করলেন অনেক কষ্টে ।
কিছু কথা আছে।
ছোটভাইকে বললেন, বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে মার্গারেটের সঙ্গে তার
ভাগ্যের সঙ্গে আরেকবার লড়াই করতে চায় জমিদার। না, এই মেয়ের সঙ্গে তার
ছেলের বিয়ে হতে পারে না। জমিদার মার্গারেটকে সাথে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে, উঠোন
পেরিয়ে চলে গেল পাহাড়ের উঁচুতে। নিচে নীল সমুদ্র। ভয়ংকর গর্জনের মতো ঢেউ
আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। হায় অভাগা মার্গারেট! সে এসবের কিছুই বুঝতে
পারছে না। জমিদার তাকে পাহাড়ের একধারে নিয়ে দাঁড় করাল। মার্গারেট টের
পেল, তাকে শেষ করার জন্যই জমিদার এখানে নিয়ে এসেছে। ধাক্কা দিয়ে তাকে
হয়তো ফেলে দিবে নিচে।
জমিদারের চোখদুটো লাল আগুনের মতো জ্বলছে।
তোর সঙ্গে আমার ছেলের কেন বিয়ে হবে? কী আছে তোর?
মার্গারেট কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন এসব ঘটনা ঘটছে তাই-বা সে জানবে
কী করে?
হাঁটুগেড়ে সে বসে পড়ল জমিদারের পায়ের সামনে।
আমায় মারবেন না। আমায় মারবেন না।
কাতরস্বরে জীবন ভিক্ষা করতে লাগল মেয়েটি।
শুধু আমায় যেতে দিন। আমার সঙ্গে আর কখনই আপনার কিংবা আপনার
ছেলের দেখা হবে না। আমি কারও ক্ষতি করি নি কোনোদিন। আমি আপনাদেরও
কোনো ক্ষতি করব না। আমি চলে যাব যেখানে খুশি । আপনাদের দেশে আর কখনই
আসব না। আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে।
মার্গারেটের কান্নার সুর পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল ।
মেয়েটির কান্না শুনে জমিদারের নিষ্ঠুর হৃদয় বুঝি একটু গলল । একটু শান্ত হয়ে
জমিদার ভৗবল, মেয়েটিকে মেরে কী লাভ? মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিলেই হয়! জমিদার
মেয়েটির হাত থেকে হীরের আংটি খুলে নিল, যে আংটিটা বিয়ে উপলক্ষে জমিদারের
ছেলে তাকে উপহার দিয়েছে। আংটিটা দু-একবার নেড়েচেড়ে দেখল জমিদার।
তারপর ছুড়ে ফেলে দিল সমুদ্রের গভীর বুকে। সঙ্গে সঙ্গে আংটিটা ডুবে গেল ।
কোথায় গেল কেউ জানে না।
জমিদার তখন বললেন,
মেয়ে, আমি তোমায় যেতে দেব। মুক্ত করে দেব। আমার ছেলের সঙ্গে
তোমার বিয়ে হবে না। আংটিটা ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক
ছিন্ন হবে আমার ছেলের। যদি আবার তোমায় কখনও দেখি, তবে নিশ্চিত থেকো
তুমি বাঁচবে না। যে-কোনোভাবেই হোক আমি তোমায় হত্যা করব । কিন্তু—
জমিদার শান্তস্বরে বলল,যদি কখনও তুমি ওই আংটিটা আবার আমায় দেখাতে পার তবে তোমার
সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দেব। তখন আমার আশীর্বাদ থাকবে তোমাদের প্রতি।
তারপর জমিদার হো হো করে হাসতে লাগল । বললেন— মেয়ে, জীবনে নিজের
পথ নিজেই দেখ । ভালো থেকো ।
জমিদার একা একা ফিরে এলেন ছোটভাইয়ের প্রাসাদে । বললেন, বন্ধ বিয়ে । এ
বিয়ে আর হবে না। কনে তার বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। সে আর কখনই ফিরে
আসবে না।
ছোটভাই আর ছেলেটি বুঝে গেল, বাবা কী বলতে চান। তারা খুব ভালোমতোই
জানে, জমিদারের কাছে আর কোনো প্রশ্ন করলেও উত্তর মিলবে না। কারণ জমিদার
জেদি, রাগী, একরোখা, নিষ্ঠুর মানুষ। একবার তিনি যা ভাবেন, তার বাইরে কোনো
কাজ করেন না।