মিথ্যা, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার ইত্যাদি পাপের শাস্তি

কবিরা ও সগিরা গুনাহর পরিচয় | 835297 | কালের কণ্ঠ | kalerkantho

মিথ্যা, সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার ইত্যাদি পাপের শাস্তি

হযরত রাসূলে কারীম (সা.)-এর অভ্যাস ছিল, প্রত্যহ ফজরের নামাজ শেষে সাহাবীদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছে কিনা, বা কারো কোনো কথা বলার আছে কি না, জিজ্ঞেস করতেন। কোনো কথা জানতে চাইলে হুজুর (সা.) তাকে যথাযথ উপদেশ প্রদান করতেন ।

অভ্যাসমতো রাসূল (সা.) একদিন বললেন, কারো কিছু বলার আছে কিনা? কেউ কিছু না বলায় তিনি নিজেই বললেন, আজ রাতে আমি অতি সুন্দর ও বিস্ময়কর একটি স্বপ্ন দেখেছি । (নবীদের স্বপ্ন এবং ওহী সম্পূর্ণ সত্য হয়ে থাকে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।) দেখলাম, দুজন লোক আমার নিকট এসে আমার হাত ধরে এক পবিত্র স্থানের দিকে নিয়ে চলল । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম একজন লোক বসে আছে, আর একজন লোক তার নিকট দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির হাতে একটি লোহার আংটাও রয়েছে। সে ঐ আংটা দ্বারা উপবিষ্ট লোকটির মাথাকে ছিড়ছে। একবার মুখের একদিক দিয়ে ঐ লোহার আংটা ঢুকিয়ে দিয়ে মাথার পিছন পর্যন্ত কেটে ফেলে । আবার অন্য দিক দিয়েও এরূপ করে। এক দিক কেটে যখন অন্য দিক কাটতে যায়, তখন প্রথম দিক পুনরায় জোড়া লেগে ভালো হয়ে যায়। আবার ঐরূপভাবে কাটে আবার জোড়া লেগে যায়। আমি এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে সাথীদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধুগণ। ব্যাপার কি? সাথীদ্বয় বললেন, সামনে চলুন। আমরা সামনের দিকে চললাম। কিছুর দূর গিয়ে দেখলাম একজন লোক শুয়ে আছে, আর একজন লোক একটি ভারী পাথর হাতে করে তার নিকট দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়ানো লোকটি ঐ পাথরের আঘাতে শোয়া লোকটির মাথা চুরমাচুর করে দিচ্ছে। পাথরটি এত জোরে নিক্ষেপ করছে যে, মস্তকটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বহুদুরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। লোকটি নিক্ষিপ্ত পাথরটি কুড়িয়ে আনার পূর্বেই বহুধা বিভক্ত মস্তিষ্ক জোড়া লেগে পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। সে ঐ পাথর কুড়িয়ে এনে আবার মাথায় আঘাত করে এবং মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

এভাবে সে পুনঃপুনঃ করতে থাকে। এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। সাথীয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কি ব্যাপার খুলে বলুন। তাঁরা কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, আগে চলুন। আমরা আগে চললাম । কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি প্রকার গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটির মুখ সরু, কিন্তু অভ্যন্তরভাগ অত্যন্ত গভীর এবং প্রশস্ত। যেন একটি তর, তার ভিতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর অনেক উলঙ্গ নারী পুরুষ সে আগুনে জ্বলে ভস্মীভূত হচ্ছে। আগুনের তেজ এত প্রকট ছিল যে, যেন আগুনের ঢেউ খেলছে। ঢেউয়ের সঙ্গে যখন আগুন উপরে উঠে, তখন লোকগুলো উথলিয়ে গর্তের দ্বারদেশে পৌঁছে গর্ত থেকে বের হওয়ার উপক্রম হয়। আবার যখন আগুন নিচে নেমে যায়, তখন লোকগুলোও সাথে সাথে নিচে নেমে যায়। আমি ভীত হয়ে সাথীদেরকে বললাম, বন্ধুগণ। এবার বলুন, এ কি ব্যাপার? কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁরা বললেন, সামনে চলুন! আমরা সামনে অগ্রসর হতে লাগলাম। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আমরা একটি রক্তের নদী দেখতে পেলাম। তীরে একটি লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর নিকট স্তূপীকৃত অনেকগুলো পাথর রয়েছে। নদীর মধ্যে একজন লোক হাবুডুবু খেয়ে অতি কষ্টে তীরের দিকে আসার চেষ্টা করছে। তীরের নিকটবর্তী হতেই তীরস্থ লোকটি তার মুখে এত জোরে পাথর নিক্ষেপ করে যে, সে আবার নদীর মাঝখানে চলে যায়। এভাবে যখনই সে তীরের দিকে আসতে চেষ্টা করে, তখনই তীরস্থ লোকটি পাথর নিক্ষেপ করে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমন নির্মম ব্যবহার দর্শনে ভয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে সাধীদেরকে জিজ্ঞে করলাম, বন্ধুগণ। বলুন, একি ব্যাপার? তাঁরা কোনো উত্তর দিলেন না। বললেন, সামনে চলুন আমরা সামনে চললাম, কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি সুন্দর শ্যামল উদ্যান দেখতে পেলাম।

উদ্যানের মধ্যবাগে একটি উঁচু বৃক্ষ । তার নিচে একজন বৃদ্ধলোক বসে আছে । বৃদ্ধের আশে পাশে অনেক ছেলে-মেয়ে। বৃক্ষটির অপর পার্শ্বে আরো একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছে । তার সামনে আগুন জ্বলছে । ঐ লোকটি আগুনের মাত্রা আরো প্রবলভাবে বৃদ্ধি করছে। সামীদ্বয় আমাকে বৃক্ষে আরোহণ করালেন । বৃক্ষটির মাঝামাঝি গিয়ে দেখলাম, এক সুদৃশ্য অট্টালিকা । এমন সুন্দর ও মনোরম অট্টালিকা এর পূর্বে কখনো আমি দেখনি । অট্টালিকার ভিতরে পুরুষ মহিলা ছেলে-মেয়ে সকল শ্রেণির লোক রয়েছে। অট্টালিকা হতে বের হয়ে এসে সাথীরা আমাকে আরো উপরে নিয়ে গেলেন । তথায় অপর একটি উত্তম অট্টালিকা দেখতে পেলাম, তার ভিতরে দেখলাম শুধু বৃদ্ধ ও যুবক ।

আমি সাথীদেরকে বললাম, আপনারা আমাকে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনলেন । এখন বলুন, ঐসব কি ব্যাপার বলুন তো। ঐসব কি দেখলাম ? সাথীদ্বয় বললেন

১. প্রথম যে লোকটির মস্তিষ্ক ছিড়ে ফেলা হচ্ছে, সে লোকটির মিথ্যা বলার অভ্যাস ছিল। সেযে মিথ্যা বলত তা দুনিয়াময় প্রসিদ্ধ হয়ে যেত।                             ২. দ্বিতীয় যে লোকটির মস্তিষ্ক প্রস্তরাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে, সে দুনিয়ায় আলেম ছিল। কুরআন হাদীস শিক্ষা করেছিল, কিন্তু তদনুযায়ী নিজেও আমল করেনি, অন্যকেও শিক্ষা দেয়নি । যাতে ইলমে দীন প্রচার করতে পারত। রাতে শুয়ে আরামে কাটাত। আলমে বরযথ হাশরের ময়দান হিসাব-নিকাশ না হওয়া পর্যন্ত তার এরূপ শাস্তি হতে থাকবে ।                        ৩. তৃতীয়ত আপনি যাদেরকে আগুনের তন্দুরের ভিতরে দেখেছেন, তারা দুনিয়ায় ব্যভিচারী পরুষ ও ব্যভিচারিণী নারী ছিল কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এরূপ শাস্তি হতে থাকবে ।                                         

৪. চতুর্থত আপনি যে লোকটিকে রক্তের নদীতে হাবুডুবু খেতে দেখেছেন, সে ঘুষ, সুদ খেয়ে, চুরি করে, এতিমের মাল আত্মসাৎ করে মানুষের রক্ত শোষণ করেছিল । কিয়ামত পর্যন্ত তার এরূপ শাস্তি হতে থাকবে ।

৫. অতঃপর বৃক্ষের নিচে যে বৃদ্ধ লোকটিকে দেখেছেন, তিনি হযরত ইবরাহীম (আ.)। ছেলেমেয়েগুলো মুসলমান নাবালেক ছেলেমেয়ে । আর যিনি অগ্নি প্রজ্বলিত করছিলেন, তিনি দোজখের দারোগা মালেক ফেরেশতা। বৃক্ষের উপর প্রথম যে অট্টালিকাটি দেখেছেন, তা সাধারণ মুসলমানদের বেহেশতের বাড়িঘর। তারপর দ্বিতীয় যে অট্টালিকা দেখেছেন, তা ঐ শহীদদের অট্টালিকা, যারা পৃথিবীতে ইসলামের জন্য শহীদ হয়েছেন। আমি জিবরাঈল ফেরেশতা এবং আমার সাথের লোকটি হযরত মীকাঈল ফেরেশতা । (তারপর হযরত জিবরাঈল (আ.) হুজুর (সা.)-কে বললেন) আপনি এখন উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করুন । আমি উপরের দিকে তাকিয়ে এক খণ্ড সাদা মেঘের মতো দেখলাম । হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, তা আপনার অট্টালিকা বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আমার অট্টালিকায় চলে যাই। হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, এখনো সময় হয়নি, এখনো পৃথিবীতে আপনার হায়াত বাকি আছে। দুনিয়ার জীবন শেষে হলে পরে

সেখানে যাবেন ।

উপদেশ : এ হাদীস হতে কয়েকটি বিষয় উপলব্ধি করা যাচ্ছে। প্রথমত মিথ্যার কি ভয়াবহ শাস্তি। দ্বিতীয়ত আমলহীন আলেমের পরিণতি। তৃতীয়ত জেনার প্রতিফল ও চতুর্থত সুদখোরের কঠিন শাস্তি। আল্লাহ সকল মুসলমানকে এ সকল কাজ হতে বাঁচিয়ে রাখুন।

আমীন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *