মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব – ২

মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব – ২

কখনো ভাবিনি খুব কাছের মানুষ গুলোই একসময় দূরে চলে যাবে। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা আমার সাথে কখনো এতোটা কষ্ট নিয়ে কথা বলেনি। আজ এতো বছর পর কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি সন্তান হিসেবে ব্যর্থ। যে সন্তানের কারণে বাবা মায়ের চোখে জল আসে সে সন্তানের মতো হতভাগা হয়তো পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় জন নেই।

আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিলো,মনে হচ্ছিলো এই যন্ত্রণা থেকে মৃত্যুও অনেক ভালো। কিন্তু আমি মরতে চাই না,জবাব দিতে চাই ওইসব মানুষদের যাদের কারণে আজ আমি নিঃস্ব, আমার আপন মানুষগুলোও আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাদেরকে জবাব দেওয়ার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে। আমার কাছে টাকা পয়সা তেমন ছিলো না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে খুব ভয় কাজ করছিলো। কেথায় যাবো,কি খাবো,কি করবো এরকম হাজারো চিন্তা এসে মস্তিষ্কের মাঝে বাসা বাঁধতে লাগলো। এতোদিন তো থাকা খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হতো না।

সারাদিন যাই করি না কেনো দিন শেষে মায়ের হাতের খাবারটা পেতাম,আরামে চিন্তাহীন ভাবে তুলতুলে নরম বালিশে মাথা রেখে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন কি পারবো? পারবো না। কারণ এখন আমার ওপর বাবা নামক বটগাছটা আর নেই। যার ছায়ায় আমি এতোটাদিন বেঁচে ছিলাম,আজ সেই মানুষটা তাঁর ছায়া আমার ওপর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।

কিছুক্ষণ পরেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে যাবো। জানি না আর কোনোদিন তাদের সাথে দেখা হবে কিনা। বাবাকে বলে রাতটা থেকে যেতে চেয়েছিলাম। মা আর বোনের সাথে শেষ বারের মতো গল্প করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কথাটা বাবাকে বলার মতো সাহস করে উঠতে পারিনি। ওইতো বোনটাকে আজ কতো সুন্দর লাগছে। টেবিলে বসে বই পড়ছিলো, আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। আমাকে দেখে বলল,

“ভাইয়া কিছু বলবে? আমি কিছু বলতে পারলাম না কারণ দুইমাস হতে চলল ঠিকমতো আমার সাথে আমার বোনটা কথা বলেনি সে । আজ আমার সাথে কথা বলল কেবল । তাহলে কি বাবার মতো সেও জানে আজকের পর থেকে তাঁর ভাইটাকে আর সে চাইলেও ভাইয়া ডাকতে পারবে না, শেষবারের মতো ভাইয়া ডেকে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে মন ভরে ? কতো ইচ্ছে ছিলো বোনটাকে নিজের হাতে বউ সাজাবো,বোনকে বউয়ের সাজে দেখার ইচ্ছেটা বোধয় সব ভাইয়েরই পূরণ হয় না। আমারও হবে না। তাতে কি? মানুষের জীবনে তো আর সব ইচ্ছেই পূরণ হয় না।

আমারও হবে না৷ তবে মনের ভিতর দুঃখটা থেকেই যায়। শেষবারের মতো বলতে ইচ্ছে করছিলো,আরেকবার ভাইয়া বলে ডাক। তোর মুখ থেকে ভাইয়া ডাকটা শুনতে অনেক ভালো লাগে৷ কিন্তু আমি বললাম না। কি দরকার শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে? অথচ আজকের পর থেকে এই ডাকটা না শুনেই আমাকে প্রতিটা রাত কাটাতে হবে কেমন একটা বিষয় হলো ।

মায়ের রুমে যখন গেলাম তখন মা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মনে হলো মা আমার সাথে কথা বলতে চায় না,আমার মুখটা দেখতে চায় না। কিন্তু আমি তো তাঁর মুখ না দেখে থাকতে পারি না,অনেক কষ্ট হয়। তাহলে কি মাও বাবার কথাটা জানে? তাহলে যে বাবা মাকে বলতে না বলল। বাবার মতো মাও আমাকে ঘৃণা করে,সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও মা কোনো কথা বলল না,তখনও মা অন্য দিকে চেয়ে আছেন। আমি আর তখন আমার চোখের বিশুদ্ধ পানিটাকে ধরে রাখতে পারলাম না।

নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভিজে গেলো। মা হয়তো আমার চোখের জল দেখতে পেয়েছিলো কিংবা পায়নি। যখন আমি চলে আসতে নিলাম ঠিক তখন মা আমার সাথে কথা বললেন। মায়ের কথাটা শুনে আমার ভিতরটাতে এতো এতো ভালো লাগা কাজ করলো যেটা আমি পাঠকদেরকে লিখে বুঝাতে পারবো না। আমার চোখের জলটাকে তুচ্ছ মনে হলো। মা যখন বলল,

কিছু বলবি বাবা আমাকে ? তখন আমি জল মুছতে মুছতে মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম । বলতে চাইলাম যে ,

মা দেখো বাবা আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছেন আমাকে। আমার কারণে নাকি আমার বোনের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এই কি। তুমিই বলো মা তুমি বল ? আমি কি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো? কখনো কি থেকেছি? জীবনে একটা রাতও তো তোমাদেরকে ছাড়া কাটাইনি।

একটা বছর কিভাবে থাকবো? বাবা কি জানে না আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। বাবা কি জানে না আমার কাছে খাওয়ার মতো কোনো টাকা নাই। বাবা কি জানে না তোমার হাতের রান্না না খেলে আমার পেটে খাবার হজম হয় না। তুমি বাবাকে বলে ম্যানেজ করো মা। আমি থাকতে পারবো না তোমাদের ছাড়া। যতোটা দিন বাঁচবো তোমাদের মাঝেই আমি বেঁচে থাকতে চাই। তোমাদের ছাড়া আমার জীবনটা অপূর্ণ।”

কিন্তু আমি বলতে পারলাম না। বাবার সেই কথাটা মনে পড়ে গেলো৷ আমি মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। মা তখন বলল,

“কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে তোর আমাকে বল?”

আমি মায়ের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে পারলাম না শুধু বললাম যে ,
আমাকে ক্ষমা করে দিও মা তুমি । আমি তোমাদের স্বপ্নটা পূরণ করতে পারিনি আর আমার জন্য মানুষের কাছে তোমাদেরকে অনেক ছোট হতে হয়েছে৷ তবে বিশ্বাস করো মা আমি এমন কিছু করিনি এইটা তুমি বিশ্বাস কর । তোমার ছেলে কি এমন কাজ করতে পারে তুমিই বলো মা বল ? তুমিই তো আমাকে জন্ম দিয়েছো তুমি আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস থেকে বলো না, আমি কি এমন কিছু করতে পারি ?

মা কিছু বলে না। আমিও কথাগুলো বলে চলে আসি। জানি না মা কথাগুলো বিশ্বাস করেছে কিনা। সেটা নিয়ে ভাবছিও না। এখন বিশ্বাস করলেই তো আমি আমার হারানো দিনগুলো আর ফিরে পাবো না। আমার বাইশ বছরের জীবনে কখনো এভাবে মাকে জড়িয়ে ধরিনি।

হয়তো লজ্জা কিংবা সংকোচ যে কারণেই হোক না কেনো মাকে কখনো জড়িয়ে ধরা হয়নি। তবে আজ যখন মাকে জড়িয়ে ধরলাম তখন আমি একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার মতো সুখ এই পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। আমি যখন মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম তখন মনে হলো আমি পৃথিবীর সবচাইতে বিশুদ্ধ আর পবিত্র মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে আছি।

এখন প্রায় রাত বারোটা বাজে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে৷ বাবা বলেছিলেন আমি চলে যাওয়ার কথাটা কেউ যেনো জানতে না পারে। সেটাই করছি। সত্যি বলতে যেতে ইচ্ছে করছিলো না আবার থাকার মতো অবস্থাতেও আমি নেই। বাড়ির বাহিরে চলে এসেছি,আর চাইলেও আমি এই বাসায় যেতে পারবো না। কারণ এই বাসার মানুষগুলোকে আমি সবসময় ভালো দেখতে চাই।

তাদেরকে আমি কোনো সুখ দিতে না পারলেও কোনো দুঃখ দিতে চাই না। তাই বাবার বাঁধ্য সন্তান হয়ে বাবার কথামতো বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। শেষবারের মতো যখন জানালার দিকে তাকালাম তখন কাউকে দেখতে পেলাম না। অথচ আমি আশা করেছিলাম বাবা আমার চলে যাওয়াটা দেখবে,শেষ বারের মতো আমাকে দেখবে। কিন্তু এমনটা হলো না।

ফোনটা আবার হাতে নিলাম। অন্তত কয়েকটা রাত কারো না কারো বাসায় থাকতে হবে। এতো রাতে কার বাসায় যাবো এটা ভাবতেই মনে হলো, এতো রাতে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আজকের রাতটা না হয় ফুটপাতেই কাটাই। কতো মানুষ তো তাদের সারাটা জীবন রাস্তায় কাটালো,আমি না হয় একটা রাতের জন্য ফুটপাতের মানুষ হয়ে গেলাম। যদিও আমি জানি আমার আর ফুটপাতের মানুষগুলোর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই এখন। কারণ তাদের মতো আমারও এখন কোনো আপন মানুষ নেই।

কিছু সময় আগে সবকিছু ত্যাগ করে আমাকে চলে আসতে হয়েছে। এখন আমি একা,বড়ই একা। আমার জীবনে আপন কিংবা পর কেউ নাই। আমার একাকিত্বের জীবনের শুরু আজ। জানি না এই একাকিত্বের সাথে লড়াই করে কতোদিন টিকতে পারবো আমি।

ফোনটা চেক করতেই দেখলাম বাহাত্তরটা মিসড কল। মিলির সাথে কথা বলার পর ফোনটার প্রতি আর মনোযোগ দেওয়া হয়নি। একবার শুধু দেখেছিলাম মিলি অনেকবার ফোন দিয়েছে। তখন ফোনে কথা বলার মতো অবস্থা ছিলো না তাই এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজেই মিলিকে ফোন দিতে চাইলাম।

কিন্তু দেখলাম অনেক রাত হয়ে গেছে। এতো রাতে মিলি হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই ফোন দিবো কি দিবো না এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। সবশেষে যখন রাতটা কোনোক্রমেই পাড় হচ্ছিলো না তখন মিলিকে ফোন দিলাম। ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই মিলি ফোন ধরে ফেলবে এটা ভাবিনি। তাঁর মানে এতোক্ষণ সে জেগে ছিলো। ফোন রিসিভ করে মিলি খুব কড়া গলায় বলল।

“সমস্যা কি তোমার? নিজেকে কি মনে করো তুমি? এতো বড় জঘন্য একটা কাজ করেও তুমি আমার সাথে ভাব নিচ্ছো কাজ টা কি ঠিক? আমাকে ইগনোর করছো? কতোবার ফোন দিয়েছি হিসাব করেছো? আমার তোমাকে এড়িয়ে চলা উচিত সেখানে তুমিই আমাকে এড়িয়ে চলছো।

ব্রেকআপের পর তুমি যদি একটিবার ফোন দিয়ে সরি বলতে তাহলে আমি সব ভুলে যেতাম,তোমাকে বুকে টেনে নিতাম। কিন্তু তুমি সেটাও করোনি। কেনো করোনি? তোমার ইগোর কারণে,তাইতো? আজ যখন এতোদিন পর নিজ থেকে ফোন দিলাম তখন তুমি আমার ফোন ধরতে চাও না , ফোন কেটে দাও কেন ।

আমি মিলিকে আমার কষ্টের কথা বলতে চাইলাম। বলতে চাইলাম আমার নিঃস্ব হওয়ার কথা। তাকে বলতে চাইলাম আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে এক বছরের জন্য বের করে দিয়েছেন। এক বছরের জন্য না সবসময়ের জন্য। কারণ আমি হয়তো আর ওই বাড়িতে কোনোদিন পা রাখবো না৷ কিন্তু বললাম না।

আমার কষ্টের কথা কাউকে জানাতে চাই না আমি। আর মিলি আমার এখন কেউ না। তাকে বললে হয়তো সে মজা নিবে। সুখের কথা মানুষকে বলা যায়,মানুষের সাথে শেয়ার করা যায়। কিন্তু দুঃখের কথা কখনো কাউকে বলতে নেই,তাহলে মানুষ মজা নিবে। আমিও আমার দুঃখটা শুধু আমার মাঝেই লুকায়িত রাখতে চাই,কাউকে বলতে চাই না।

আমি মিলিকে বললাম,
একটু সমস্যা হয়েছিলো তাই ফোনটা ধরিনি । সমস্যা নেই তুমি তোমার যতো রাগ আছে আমার ওপর ঝাড়তে পারো আমি কিছু মনে করবো না তোমার ইচ্ছা । তবে তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আমার ওপর কোনো অভিযোগ রেখো না দয়া করে।

আমার কথা শুনে মিলি ফোনটা রেখে দেয়। তাঁর ফোন রেখে দেওয়ার কারণটা আমি খুঁজতে গেলাম না। হয়তো আমার কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণটা সে মেনে নিতে পারেনি তাই ফোনটা রেখে দিয়েছে।

চলবে..
মেঘে_ঢাকা_আকাশ
পর্ব-২

আপনাদের ভালো লাগলে কমেন্স করবেন তাহলে পরের পার্ট গুলো দিবো….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *