হাশরের ময়দানে কি হবে সেদিন
নক্ষত্র খসে পড়া দিনে কোথায় পালাবে মানুষ !
আল্লাহ বলেন, ‘যখন সূর্য আলোহীন হয়ে পড়বে আর নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে।’ (সূরা তাকভীর, আয়াত : ১-২)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন আসমান ফেটে যাবে আর নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে।’ (সূরা ইনফিতার, আয়াত
১-২)। মানুষ জিজ্ঞেস করে কিয়ামত কবে হবে? যখন চোখগুলো বিস্ফোরিত হবে, চাঁদ জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে, সূর্যের আলো নিভে যাবে। সেদিন মানুষ বলবে, এখন কোথায় পালাব? না, তোমরা পালাতে পারবে না। তোমাদের জন্য এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন নিরাপদ আশ্রয় নেই।’ (সূরা কিয়ামাহ : আয়াত ৬-১২)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন, চন্দ্র-সূর্য দুটোকেই গুটিয়ে ফেলা হবে। ফলে এগুলোর আলো নিভে যাবে।’
সমবেত হওয়ার সেই দিন
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বপ্রথম জমিন থেকে ওঠানো হবে আমাকে। আমার পর আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)কে ওঠানো হবে। এরপর আমি বাকি কবরস্থানে যাব। বাকীবাসীকে আমার সঙ্গে একত্রিত করব। তারপর মক্কাবাসীও আমার সঙ্গে মিলবে। এরপর আমি হারামাঈনবাসীর মাঝে হাশরে মাঠে এক সঙ্গে হব।’ (তিরমিযি)
জেনে রাখা দরকার, যাদের কবরে দাফন করা হয়েছে, তারা তো হাশরের মাঠে ওঠবেই, যাদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে, নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে, বাঘ খেয়ে ফেলেছে ইত্যদি, তাদেরও হাশরের মাঠে ওঠানো হবে।
উদোম গায়ে বেরোবে মানুষ
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, “কিয়ামত দিন মানুষকে খালি পা, উলঙ্গ দেহ, এবং খতনাবিহীন অবস্থায় ওঠানো হবে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সেদিন কি একে অন্যকে দেখতে পাবে? তাহলে তো বড় লজ্জার কথা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আয়েশা! ওই দিন মানুষ এতই ভয়ে থাকবে যে, একজন আরেকজনের দিকে তাকানোরও ফুরসত পাবে না। (বুখারি ও মুসলিম) অন্য হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয় কিয়ামতের দিন তোমাদের খালি পা, উদোম গা এবং খতনা ছাড়া ওঠানো হবে। এরপর তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত
করলেন, ‘যেমনিভাবে আমরা প্রথমবারের সৃষ্টি দিকে ফিরিয়ে নেব তোমাদের।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০৪)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সর্বপ্রথম যাকে কাপড় পরানো হবে তিনি হলেন, আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.)।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
অবিশ্বাসীদের দুঃখ হবে চিরকাল
আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তাদেরকে কিয়ামত দিন অন্ধ, বোবা ও বধির করে চেহারায় ভর করে হাঁটাব।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৯৭)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জন্য রয়েছে কোণঠাসা জীবন। কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাব। সে বলবে, হে রব! আমি তো চোখে দেখতাম। আজ কেন অন্ধ করে উঠালেন? উত্তরে বলা হবে, এমনি করে তোমার কাছে আমার আয়াত এসেছিল আর তুমি সেগুলো ভুলেও চোখ খুলে দেখোনি।’ (সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১২৪-১২৭)।
মুফাসসিরগণ বলেন, ‘দুনিয়াতে যারা আল্লাহর দ্বীন থেকে গাফেল ছিলো, তাদের চোখ-কান ও বলার শক্তি কেড়ে নেয়া হবে। অবশ্য পরে আবার এসব ফিরিয়ে দেয়া হবে যেন তারা আজাবের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। (মাআলিমুত তানযিল)
ফুরাবে এ জীবনের সব লেন-দেন
আল্লাহ বলেন সেদিন অপরাধীদের চোখ নীল রঙের হবে অনেক। তারা চুপি চুপি বলতে থাকবে দুনিয়াতে মাত্র দশ দিন ছিলাম (সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১০২ ১০৩)।
কিয়ামত এত লম্বা ও ভয়াবহ হবে যে, মনে হবে দুনিয়ার জীবন এক সকাল বা এক বিকেল ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘যখন কিয়ামত আসবে তখন মনে হবে দুনিয়াতে শুধু একটি সন্ধ্যা অথবা সকাল অবস্থান করেছিল তারা।’ (সূরা নাজিআত, আয়াত : ৪৬)। ‘যেদিন কিয়ামত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম করে বলবে, আমরা দুনিয়াতে মাত্র অল্প সময় কাটিয়েছি।’ (সূরা রোম, আয়াত : ৫৫)। ‘বিশ্বাসী ও জ্ঞানী বান্দারা বলবে, তোমাদের অবস্থান আল্লাহর কিতাবে লেখা ছিল। এটা কিয়ামতের দিন। আফসোস! তোমরা তা জান না।’ (সূরা রোম, আয়াত : ৫৬)।
দিশেহারা সেদিনের কথা
আল্লাহ বলেন, ‘আর জালেমরা যা কিছু করছে তা সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন। তাদের শুধু ওই দিন পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হয়েছে, যেদিন তাদের দৃষ্টি খুলে যাবে। তারা ভয়ে দৌড়াতে থাকবে। তারা কোন আশার আলো খুঁজে পাবে না।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪২-৪৯)। কবর থেকে বের হয়ে খুব পেরেশানি ও বিস্ময়ে তারা হাশরের মাঠের দিকে দৌড়াতে থাকবে। ভয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা অবাধ্য হও, তবে ওই দিন কেমন করে রক্ষা পাবে যেদিন ভয়ে শিশুও বৃদ্ধ হয়ে যাবে?
কেউ কাঁদবে কেউ হাসবে
হাশরের মাঠে আল্লাহর নেক বান্দাদের চোহারা উজ্জ্বল হবে। আর কাফের ও পাপীষ্ঠের চেহারায় থাকবে বিষাদ ও লাঞ্ছনার ছাপ। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন কিছু চেহারা সাদা হবে আর কিছু চেহারা হবে কালো। যাদের চেহারা কালো হবে। তাদের বলা হবে, তোমরা ঈমান আনার পর কুফরি করেছিলে। এখন কুফরির মজা বোঝ। আর যাদের চেহারা সাদা হবে, তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। থাকবে অনন্তকাল জুড়ে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৬-১০৭)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অনেক মুখ সেদিন আলোকিত হবে। হাসি ফুটবে চেহারায়। আবার অনেক মুখ সেদিন অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। তারাই কাফের-অবিশ্বাসী।’ (সূরা আবাসা, আয়াত : ৩৮-৪২)।
ঈমান ও নেক আমলের কারণে নেক বান্দাদের চেহারা আলোকিত হবে। আর যে হতভাগারা দুনিয়াতে আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল, ঈমান ও নেক আমলের নূর থেকে দূরে থেকেছে, কুফরি ও পাপের শরাবে ডুবে ছিল, কিয়ামতের দিন তারা লাঞ্ছনা ও অপমানের সঙ্গে মুখ কালো করে হাশরের মাঠে ওঠবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সঙ্গে তার পিতা আজরের দেখা হবে। পিতার চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে ওঠবে। হজরত ইবরাহিম (আ.) পিতাকে বলবেন, আমি কি বলিনি যে, আমার অবাধ্য হয়ো না। পিতা বলবে, আজ তোমার অবাধ্য হব না। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহকে বলবেন, হে আল্লাহ! আপনি ওয়াদা করেছেন, কিয়ামতের দিন আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না। আমার পিতা জাহান্নামে যাবে, আমার জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী হতে পারে? আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমি কাফেরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। তোমর পিতা জান্নাতে যেতে পারবে না।’ (বুখারি)
কে ভালো কে মন্দ সেদিন জানা যাবে