হীরার মূল্য

*** হীরার মূল্য ****

আমার শায়খ ডা. আবদুল হাই রহ. একটি ঘটনা শুনিয়েছিলেন। ঘটনাটি বিখ্যাত বিজয়ী বাদশাহ সুলতান খুবই শিক্ষণীয়। তিনি বলেছেন— মাহমুদ গজনবি রহ.। তার এক প্রিয় ভৃত্য ছিলো, নাম আয়ায;

যেহেতুতার সাথে ভৃত্যের সম্পর্কে ছিলো খুবই গভীর। সুলতান ভৃত্যকে অধিক আদর করতেন। এ কারণে মানুষ বলাবলি করতো, আয়ায হলো বাদশাহর খুবই মুখড়া গোলাম। আর সুলতান মাহমুদও এ ভৃত্যকে অনেক বড়ো বড়ো ব্যক্তির উপর প্রাধান্য দিতেন।

বাদশাহ আয়াযের কথাকে মন্ত্রী উজিরদের কথার চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ নিয়ে রীতিমতই কানাঘষা চলতো। বিষয়টা যখন সুলতান মাহমুদ গজনবি রহ.

জানতেপারলেন তখন তিনি ভাবলেন, এর মূল রহস্যটি সকলের কাছেই উদ্ভাসিত হওয়া প্রয়োজন। তাই তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন, উজির-মন্ত্রীদের মাঝেআর আয়াযের মাঝে পার্থক্য কি? একবার বাদশাহর নিকট উপহার স্বরূপ একটি হিরা এসেছিলো। হিরাটি যেমন মূল্যবান দেখ তও তেমন সুন্দর। সুলতান দরবারে উপবিষ্ট সকলের সামনে উপহারটি রাখলেন।

সকলেই তা মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো এবং প্রশংসা করতে লাগলো। তারপর সুলতান মাহমুদ তার প্রধানমন্ত্রীকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হিরাটি আপনি দেখেছেন? মন্ত্রী বললেন, জি। সুলতান মাহমুদ পুনরায় প্রশ্ন করলেন, হিরাটি কেমন? প্রধানমন্ত্রী বললেন, আলমপনা, অত্যন্ত মূল্যবান। পৃথিবীতে এর কোনো তুলনা নেই। এ এক অমূল্য উপহার। বাদশাহ বললেন, এ হিরাটি মেঝেতে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলুন। এ কথা শুনতেই প্রধানমন্ত্রী হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, জাহাপনা হিরাটি খুবই মূল্যবান। স্মৃতি হিসেবে এটা আপনার খেদমতে সংরক্ষিত থাকবে। এটা আপনি ভাঙতে বলছেন কেনো?

আমি আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ করবো, এটা আপনি ভাঙবেন না। সুলতান বললেন, ঠিক আছে আপনি বসুন। তারপর ডাকলেন আরেক মন্ত্রীকে। তাকেও নির্দেশ দিলেন, হিরাটি ভেঙে ফেলতে। সেও বিনয়ের সাথে আবেদন করল, বাদশাহ সালামত!

এটা একটা অমূল্য হীরা, এটা ভাঙার মতো সাহস আমি পাচ্ছি না। এভাবে তিনি একের পর এক মন্ত্রীদের ডাকলেন এবং বললেন, হিরাটি ভাঙতে। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই অপারগতা প্রকাশ করলো। অবশেষে বাদশাহ আয়াযকে ডেকে বললেন, এ হিরটি তুলে আছাড় মার এবং ভেঙে ফেল। আয়ায সঙ্গে সঙ্গে হিরাটি তুলে মাটিতে সজোরে আছাড় মারলো।

হিরা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো। বাদশাহ যখন দেখলেন সত্যিই আয়ায হিরাটি ভেঙে ফেলেছে, তখন তিনি ধমকের সুরে বললেন, কেনো তুমি হিরাটি ভাঙলে? বড়ো বড়ো মন্ত্রী মহোদয়গণ যারা অন্যন্ত বুদ্ধিমান এখানে উপবিষ্ট আছেন, তাদেরকেও হিরাটি ভাঙতে বলা হয়েছিলো।

কিন্তু তারা কেউ সেটা করতে সাহস করেনি। তারা কি সকলেই পাগল? তোমাকে বললাম, আর অমনি হিরাটি ভেঙে টুকরা টুকরা করে দিলে? আয়ায প্রথমে বিনয়ের সাথে বলল, জাহাঁপনা ভুল হয়ে গেছে। সুলতান বললেন, তা তো বুঝলাম।

কিন্তু ভাঙলে কেনো?

আয়ায বললো, আমার মন বলছিলো, এটাতো একটা হিরামাত্র। এর মূল্য যতোই হোক ভাঙা যেতে পারে। এটা ভেঙে ফেলা তেমন কোনো কঠিন কথা নয়। কিন্তু আপনার নির্দেশ ভাঙা যায় না। আমার কাছে আপনার নির্দেশ এ হিরার চাইতেও বেশি মূল্যবান। তাই আমি মনে করছি নির্দেশ ভঙ্গ করার চাইতে বরং হীরা ভাঙাটাই সহজ। এই জন্যই আমি হিরা ভেঙে ফেলেছি।

এরপর সুলতান মাহমুদ উপস্থিত মন্ত্রীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, এই হলো আপনাদের ও আয়াযের মধ্যে পার্থক্য। আপনাদের যদি কোনো বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়, তাহলে প্রথমেই আপনারা সেই নির্দেশের কারণ ও নিগূঢ় তত্ত্ব খুঁজতে শুরু করেন। আর আয়ায হলো হুকুমের গোলাম।

তাকে যা বলা হয় সে তাই করে । তার কাছে কারণ ও তত্ত্বের কোনো মূল্য নেই। পাঠক! এবার বলুন, সুলতান মাহমুদ গজনবীর একটি নির্দেশের এমন কি মূল্য আছে? তার বিবেক ও বুদ্ধিমত্তা সীমিত। এই মর্যাদার অধিকারীতো সেই সত্তা, যিনি এ সারা বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।

হিরা ভাঙা যেতে পারে অন্তর ভাঙা যেতে পারে, মানুষের আবেগ ভাঙা যেতে পারে। প্রেরণা ধুলার সাথে নিশে যেতে পারে। স্বপ্ন ও কামনা বাতাসের সাথে মিলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর হুকুম ভাঙার কোনো অবকাশ নেই। এ মর্যদার প্রকৃত অধিকারী তিনিই। সুতরাং তার কোনো নির্দেশের কারণ ও তত্ত্ব অনুসন্ধান করা নির্বুদ্ধিতা।

আর এই নির্বুদ্ধিতারও মূলকারণ হলো পাপ। মানুষ যতো পাপ করে তার বিবেক বুদ্ধি ততই লোপ পায়। উল্টোপথে চলতে থাকে তার বিবেক বুদ্ধি । সারকথা হলো, আকল বুদ্ধির ভ্রষ্টতাই পাপের ফসল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *