হেড ফোন ইসলামিক গল্প
**** হেড ফোন ইসলামিক গল্প*****
শায়খ মুহাম্মাদ সাবি। তিনি একদিনের ঘটনা শোনালেন, আমি সিরিয়ায় গিয়েছিলাম। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটা ক্লাস নিতে।
আমাদের ক্যাম্পাসের পাশ দিয়েই রেল লাইন। মসজিদটাও রেল লাইন ঘেঁষে। ইশার নামায পড়ে সালাম ফিরালাম। রাতের ট্রেনটা সিটি বাজিয়ে যাচ্ছে। একজন লোক চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর আরও অনেকেই হৈ চৈ করে উঠলো। বাইরে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ। দৌড়ে যাচ্ছে। আমরাও বের হয়ে এলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম এক যুবকের দ্বিখণ্ডিত দেহ রেললাইনের ধারে পড়ে আছে।
শরীরটা (লম্বালম্বি) মাঝামাঝিতে কাটা পড়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে। ডানপাশটা অক্ষত আছে। বামপাশটা একদম নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো যুবকের শরীরে তখনো প্রাণ আছে। ভীষণ ব্যাথায় চোখমুখ কেমন হয়ে আছে। আওয়াজ বের হচ্ছে না। আমাদের একজন ছেলেটার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারলো আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। তাড়াতাড়ি গিয়ে তার মাথাটা কোলে তুলে নিল।
কানে কানে বললো, -বলো! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। যুবক আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলল। কী যেন একটা বলতে চাইল। লোকটা আবার কানের কাছে গিয়ে কালিমা পড়তে বললো। আমরা দেখলাম এবার
আর যুবকটা দেরি করল না। বেশ স্পষ্ট আওয়াযে কালিমা পড়লো। পড়া
শেষ করেই মারা গেল। শরীরের কাটা যাওয়া অংশসহ মৃত যুবককে সবাই মিলে ধরাধরি করে মসজিদ চত্বরে নিয়ে এলাম। যুবককে কেউ চিনতে পারছিল না। কিভাবে ট্রেনের নিচে পড়লো কেউ বলতে পারল না। ঠিকানাও জানা নেই। একজন
বললো, -লোকটার জামা-কাপড় হাতড়ে দেখ, ওখানে ঠিকানা মিলতে পারে।
কোলে নেয়া ব্যক্তিটি এগিয়ে শার্ট হাতড়াতে গিয়ে দেখল যুবকের গলায় ক্রুশ ঝুলছে। উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে সুবহানাল্লাহ বলে উঠলো। যুবকের পকেটে মোবাইল পাওয়া গেল। নাম্বার নিয়ে বাড়িতে ফোন করা
হলো। জানা গেলো খুবই কাছেই খ্রিস্টান এলাকায় তার বাসা। আমরা একটা গাড়িতে করে মৃতদেহ নিয়ে চললাম। পরিবারের সম্মতিক্রমে মুসলিম রীতিতে তাকে দাফন করবো।
গাড়ি খ্রিস্টান পল্লীর গলির মুখে পৌঁছতেই এক বৃদ্ধ লোক ছুটে এল। তার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। প্রাথমিক শোকের চাপ কমে এলে আমরা শোকাহত বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা ছেলের মুসলমান হওয়া কথা শুনে চেহারাটা মলিন করে বললেন: -আমি জানতাম এমন একটা কিছু ঘটবে।
কিন্তু সেটা যে এভাবে ঘটবে কল্পনা করতে পারিনি। -কেন আপনি এমন ধারণা করতেন? -সে অনেক লম্বা কাহিনী। তার এক ফুফু থাকে সুইজারল্যান্ডে। আবদে রূহ মানে আমার এই ছেলেটার সাথে সেই নিঃসন্তান ফুফুর খুবই ভাল সম্পর্ক। আমার ভগ্নিপতি মানে ছেলের ফুফা চাকুরি করে সুইস গার্ডে। মানে ভ্যাটিকান সিটিতে। দুই দেশের দুইজনের বিয়েটারও এক চমকপ্রদ কাহিনী আছে।
গত কয়েক বছর আগে, সুইজারল্যান্ডে মসজিদের মিনার নির্মাণ নিয়ে ভীষণ গণ্ডগোল হয়েছিল। তখন আমার ভগ্নিপতি সেই ঘটনার সাথে কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছিল। সে তখন ছুটিতে ছিল। সেসময় সে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে। তার স্ত্রী মানে আমার বোন আরব খ্রিস্টান, তাই মুসলিম না হলেও ইসলাম সম্পর্কে জানবে মনে করে তার কাছে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইল। নিভীন (আমার বোন) বললো, -তোমাকে সন্তুষ্ট করার মতো জ্ঞান আসলে আমারও নেই। একটু অপেক্ষা করো।
আবদে রূহকে ফোন করে বলি, দিমাশক থেকে কিছু আরবী কিতাব পাঠিয়ে দিক। পাঠিয়ে দিল। যে দোকান থেকে কিতাব কিনল, তারা ক্রেতা খ্রিস্টান দেখে, আবদে রূহ তার ফুফা-ফুফুর জন্যে কিতাব কেনার সাথে সাথে কুরআনও
ফ্রি কয়েকটা কুরআন তিলাওয়াতের সিডিও দিয়ে দিল। ফুফুর জন্যে আনা কুরআন তিলাওয়াত আমার ছেলেও শুনতে শুরু করলো।। ছেলেটা আমার উম্মে কুলসুমের খুবই ভক্ত ছিল। সারাদিন কানের মধ্যে হেডফোন লাগিয়ে উম্মে কুলসুমের গান শুনতো। আমি ভাবতাম এখনো বুঝি সে গান শুনছে।
একদিন সে আমার পাশ দিয়ে। যাওয়ার সময়, তার হেডফোন ছাপিয়ে একটা সুরেলা আওয়াজ এলো। ঠিক
গানের মতো লাগল না আওয়াজটাকে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, -কী শুনছিস?
সে থতমত খেয়ে বললোঃ -কেন গান শুনছি! তার চোরা ভাব দেখে আমার সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। একদিন আমি জোর করে তার কান থেকে হেডফোন কেড়ে নিয়ে দেখি সে কুরআন তিলাওয়াত শুনছে। আমি তাকে এসব ছেড়ে দিতে বললাম। সে ছেড়ে দিবে বললো।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল দিনদিন তার শোনার নেশা বেড়েই চলছিল। ওদিকে আমার বোন প্রথমবার পাঠানো কিতাবগুলো পেয়ে যেন পাগল হয়ে গেল, আরও আরও কিতাব পাঠাতে বললো। আমি এত বাড়াবাড়ি আর সহ্য করতে না পেরে, ছেলেকে হুমকি দিলাম, -তুই যদি এসব শোনা বন্ধ না করিস, তোকে পাড়ার ছেলেদের দিয়ে মেরে
ফেলার ব্যবস্থা করবো।
ছেলে বললো,
-তুমি চাইলেও আমাকে মেরে ফেলতে পারবে না। এটুকু বলে বৃদ্ধ বাবা থামলেন। বললেন, -ওই কুরআন শোনা ছাড়া, ছেলেটা আমার খুবই ভাল। লেখাপড়ায় ভাল। স্বভাব-চরিত্রে ভাল। কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে আগেই চলে গেল। এভাবে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো? তারপরও শেষ কটা দিন, আমার ছেলে যেটাকে ভালবেসেছে, আমিও সেটাকে ভালবাসি। যদি একটু সান্ত্বনা পাই।
-আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।